রোহিঙ্গারা জালিয়াতি করে বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয়পত্র-পাসপোর্ট জোগাড় করছে এই অভিযোগ বহু পুরনো। কিন্তু এখন পুরো উল্টো ঘটনা ধরা পড়েছে। বাংলাদেশি নাগরিকরাই রোহিঙ্গা সেজেছে এবং রোহিঙ্গা ডাটাবেজে নাম তুলেছে। ত্রাণের আশায় নিজের নাম পরিচয় বদলে এবং অন্যের সন্তানকে নিজের দাবি করে রোহিঙ্গা ডাটাবেজে নাম তুলছে কিছু বাঙালি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শরণার্থী অধ্যুষিত কক্সবাজারে উখিয়া-টেকনাফে ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা পাওয়ার আশায় ‘রোহিঙ্গা’ সেজেছে কমপক্ষে পাঁচশ বাংলাদেশি। তারা ত্রাণের লোভে স্থানীয় বাসিন্দা পরিচয় গোপন রেখে রোহিঙ্গা ডাটাবেজে নাম তুলেছে। টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন শরনার্থী ক্যাম্প থেকে নিয়মিত ত্রাণও নিচ্ছে তারা। ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণকারী রোহিঙ্গা নেতারা টাকার বিনিময়ে তাদের এ পরিচয়পত্র পেতে সহযোগিতা করছেন।
উল্লেখ্য, মিয়ানমার সেনাবাহিনীদের নিধন থেকে বাঁচতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের খাদ্যসহ নানা সহায়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। এ সহায়তা পেতেই স্থানীয় বাঙালিরা সাজছেন রোহিঙ্গা বলে জানা গেছে।
টেকনাফ উপজেলার লেদা, নয়াপাড়া, শামলাপুর ও উখিয়ার শিবিরের রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া এ তথ্যের সতত্য স্বীকার করেছেন খোদ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম। তিনি বলেন, ‘বাঙালিদের রোহিঙ্গা সাজার বিষয়টি খতিয়ে দেখে তাদের কার্ড বাতিল করা হবে। একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ২২ শ’ পরিবারের ১৩ হাজার রোহিঙ্গা টেকনাফের শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবিরের বসবাস করছেন। এ শিবিরটির অবস্থান টেকনাফ থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে মেরিন ড্রাইভ সড়কের কাছাকাছি। তবে ২৩ নম্বর এই শিবিরটির সঙ্গে অন্য শিবিরের তফাত হলো, এখানে বাঙালি আর রোহিঙ্গা একই গ্রামে থাকে। এই শিবিরের পাশে অবস্থিত নয়াপাড়া শিলখালী একটি গ্রাম। সেখানে ১ নং ওয়ার্ডে টিন শেড ইটের ঘরে বসবাস করছেন এক বাঙালি নারী। তাদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। এই নারীর একদিকে ভোট প্রয়োগ করছে, অন্যদিকে শরণার্থী হিসেবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করছে। বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয় পত্রে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তার নাম ছেনুয়ারা বেগম, বয়স ৪০। স্বামী আবদুল হক। পরিচয় নম্বর ২২১৯৭৬৫৯৫৫০৭। আবার বিশ্ব খাদ্য সংস্থার রোহিঙ্গাদের ডাটাবেজে তিনিই রহিমা। স্বামী করিম উল্লাহ।
শুধু তাই নয়, অন্য দুজনের দুই বাংলাদেশি শিশু সন্তানকে নিজের সন্তান বানিয়ে রোহিঙ্গা ডাটাবেজ করেন এই নারী। তাদেরও দুই দেশের পরিচয়, দুটি নাম রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-আহমদ (১০), রোহিঙ্গা কার্ডে রেদোয়ান এবং ফাতেমা আক্তার (৯), রোহিঙ্গা কার্ডে রেহেনা বেগম। তবে তাদের আসল পরিবার রোহিঙ্গা বানানোর খবর পাওয়ার পরে জোর প্রতিবাদ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছে। তাদের মতে, ছেনুয়ারা বেগমই শুধু নয়, এই রোহিঙ্গা শিবিরে শতাধিক বাঙালি একইভাবে রোহিঙ্গা সেজেছে।
অভিযুক্ত ছেনুয়ারা বেগমের উত্তর থমকে যাওয়ার মতো। নিজেকে মিয়ানমার নাগরিক পরিচয় দিয়ে বিশ্ব আন্তজাতিক খাদ্য সংস্থা কার্ড বের করে দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি অনেক পুরনো রোহিঙ্গা। ত্রাণের মাধ্যমে কোনও রকম সংসার চলে। আমি-তো বাংলাদেশি না। তাই কোনও কাজকর্ম করতে পারি না।’ আসলেই তিনি রোহিঙ্গা কিনা জানতে চাইলে আর কথা বলতে রাজি হননি।
এই নারীর স্বামী আবদুল হক প্রথমে তার স্ত্রী ছেনুয়ারা বেগম মানসিক রোগি বলে দাবি করেন। পরে আবার সব স্বীকার করে দোষ চাপিয়ে দেন স্ত্রীর ওপর। দাবি করেন, তার স্ত্রী লোভের কারণে ও শুধু ত্রাণের আসায় বাঙালি থেকে রোহিঙ্গা সেজেছে। বিষয়টি তিনি জানতেন না। আরেক লোকের সন্তানকে নিজের সন্তান বানিয়ে রোহিঙ্গা কার্ডে নাম তুলেছে বলে এক লোক অভিযোগ করার পর তিনি বিষয়টি জেনেছেন। আবদুল হক বলেন, ‘এই বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি করবেন না। কারণ এরই মধ্যে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের পরিবারে খুব সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।’
স্থানীয় ও রোহিঙ্গা শিবিরের নেতারা বলেন, এই রোহিঙ্গা শিবিরে কোনও ধরনের সমস্যা নেই বললেই চলে। তবে শিবিরটি গ্রামের সঙ্গে লাগোয়া হওয়ায় বাঙালিরা অনেক সময় রোহিঙ্গা সাজার চেষ্টা করে। এতে কিছু রোহিঙ্গা লোকজন টাকার বিনিময়ে তাদের সহযোগিতাও করেছে।
শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা আবুল কালাম জানান, তার শিবিরে অর্ধশতাধিকের বেশি বাঙালি রোহিঙ্গা সেজেছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। পুরো রোহিঙ্গা শিবিরের হিসাব করলে এই সংখ্যা দুই শতাধিক হবে।
‘রোহিঙ্গা’র পরিচয় নেওয়া শিশু আহমদের বাবা শামসুল আলম বলেন, তার সন্তানকে জোর করে নিয়ে স্থানীয় ছেনুয়ারা বেগম নিজের সন্তান বানিয়ে রোহিঙ্গা সাজিয়েছে। এটি খুবই লজ্জাজনক। বিষয়টি রোহিঙ্গা শিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জকে জানানো হয়েছে। তার মতোই আরেক স্থানীয় অভিযোগ করেছেন তার শিশু মেয়েকে একইভাবে রোহিঙ্গা সাজানো হয়েছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, ‘এলাকায় বেশকিছু বাঙালি রোহিঙ্গা সাজার খবর আমি শুনেছি। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।’
এছাড়া লেদা শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ রশিদ জানান, ‘সেখানেও ক্যাম্প সংলগ্ন গ্রামের দুই শতাধিক বাঙালির রোহিঙ্গা পরিচয়ের নথিপত্র রয়েছে। যা দেখিয়ে তারা ত্রাণ সংগ্রহ করে বাইরে বিক্রি করছে।’ সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন