গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা এখন প্রশ্নের মুখে। কিছু দিন আগেই ইন্টারমিডিয়েট রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস ট্রিটি বা আইএনএফ চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। এর পর থেকেই পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কায় কাঁপছে পৃথিবী। শুধু তাই নয়, ইউরোপের গণ্ডি ছাড়িয়ে এই ভয় এখন তাড়া করছে এশিয়াকেও। একদিকে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ। পুলওয়ামা হামলার পরবর্তীতে দুই পরমাণুশক্তিধর প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যে যুদ্ধং দেহি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, হ্যানয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প-কিম জন উনের পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ বৈঠক নিষ্ফলা হওয়ায় এশিয়ার আকাশে যুদ্ধের কালো মেঘ আরো ঘনিয়ে এসেছে। চুক্তি ও কূটনীতিকে সরিয়ে রেখে এই ভয় দেখানোর রাজনীতি যে যেকোনো সময় বিপজ্জনক বাঁক নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছে গোটা বিশ্ব। ভাবা হচ্ছে দু’টি উপায়। এক, বিশ্বজুড়ে সমস্ত পরমাণু অস্ত্রগুলোকে নিষ্ক্রিয় করা। দুই, মহাকাশে একটি প্রোটেকটিভ মিসাইল ডিফেন্স শিল্ড (ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধক ব্যবস্থা) স্থাপন করা। দ্বিতীয় রাস্তাটিই নেয়ার কথা ভাবছে একাধিক দেশ। কারণ, এতে কোনো দেশকেই পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের পথে হাঁটতে হবে না। স্নায়ু যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে হওয়া বিভিন্ন নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিগুলি এত দিন রাশিয়া ও আমেরিকার পরমাণু অস্ত্রভাণ্ডার গড়ার প্রতিযোগিতায় রাশ টেনেছিল। কিন্তু সেই দিন আর নেই।
৯/১১ হামলার পরই রাশিয়ার সঙ্গে হওয়া ১৯৭২ সালের অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র চুক্তি থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে আমেরিকার জর্জ বুশ সরকার। পাল্টা ১৯৯৩ সালের স্ট্র্যাটেজিক আর্মস রিডাকশন চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে রাশিয়ার পুতিন সরকারও। এবং এমআইআরভি ক্ষেপণাস্ত্র বিভিন্ন জায়গায় মোতায়েন করে তারা। যেকোনো রকম হামলার আশঙ্কা তৈরি হলেই সেই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার হুমকি দিয়ে রেখেছে রাশিয়া। এই পরিস্থিতিতে গত বছর আগস্ট মাস থেকে আইএনএফ চুক্তি নিয়ে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ শুরু হয় দুই অসীম ক্ষমতাধর দেশের মধ্যে।
স্নায়ু যুদ্ধের সময় ১৯৮৭ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভের মধ্যে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। চুক্তির আওতায় ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য পাঁচ শ’ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার পাল্লার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি নিষিদ্ধ করা হয়। পরে দুই দেশ প্রায় ২,৭০০টি মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে। সম্প্রতি দু’টি ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ তুলেছে রাশিয়া।
প্রথমত, ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা তৈরির জন্য আমেরিকা মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। দ্বিতীয়ত, মার্কিন সরকার এমন একটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নির্মাণ করেছে, যা দিয়ে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা সম্ভব। এরপরই গত ১ ফেব্রুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে আমেরিকা আর এই চুক্তি মানবে না। ঠিক তার পর দিন ২ ফেব্রুয়ারি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও আইএনএফ চুক্তি স্থগিত রাখার পাল্টা ঘোষণা করেন। গত ৪ মার্চ সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি এই সংক্রান্ত ডিক্রিতে সই করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, যতদিন আমেরিকা এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তি লঙ্ঘন করবে, তত দিন রাশিয়াও তা মানবে না।
এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট, ইতিহাস থেকে বিন্দুমাত্র শিক্ষা নেয়নি রাশিয়া ও আমেরিকা। দুই দেশের হঠকারি সিদ্ধান্তে ফিরেছে ‘কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস’-এর ভয়াবহ দিনগুলো। ইউরোপে নয়া মিসাইল মোতায়েন করলে আমেরিকাকে পাল্টা হামলার হুমকি দিয়েছেন পুতিন। এই হুমকির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে আমেরিকা-সহ ন্যাটো দেশগুলো। রাশিয়ার সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে মার্কিন স্বরাষ্ট্র দপ্তর সাফ জানিয়েছে, কোনো নয়া মিসাইল বানানো হচ্ছে না। মিথ্যে তথ্য পরিবেশন করছে মস্কো। এদিকে, ২০২১ সালে এসটিএআরটি চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। রাশিয়া-আমেরিকার কাছে সর্বোচ্চ কতগুলি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র থাকবে, তা নিয়েই ওই চুক্তি হয়েছিল। এই টানাপোড়েনের জেরে ওই চুক্তির মেয়াদ বাড়া নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আমেরিকা মহাকাশে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করলে, পাল্টা একই পথে হাঁটতে পারে রাশিয়া-চীন। তাতে যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়বে বই কমবে না।
এই পরিস্থিতিতে মার্কিন কংগ্রেসকেই সঠিক ভূমিকা নেয়ার দাবি জানাচ্ছে শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন দেশগুলি। কারণ,একদিকে রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্কটে। তাই হুমকি দিলেও আমেরিকার মতো প্রযুক্তিতে বলীয়ান দেশের সঙ্গে দুম করে যুদ্ধে যাওয়া পুতিনের পক্ষে এখনই সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এখনো ২ বছর দেরি আছে। ততদিন পর্যন্ত যদি এই যুদ্ধ আটকানো যায়, তাহলে ফের নতুন, ভয়হীন বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখতে পারে মানুষ। না হলে, দ্বিতীয় হিরোশিমা-নাগাসাকি দেখার জন্য মনকে প্রস্তুত করতে হবে বিশ্ববাসীকে।