পাহাড়ে এত অস্ত্র আসছে কোত্থেকে? তা-ও আবার অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র। রয়েছে এসএমজি, একে-৪৭ রাইফেল, এম-১৬ ও এম-৪ এর মতো অস্ত্র। স্থানীয় সূত্র বলেছে, সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অস্ত্র এগুলো। খুন-জখম, অপহরণ, চাঁদাবাজি এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্যই এসব অস্ত্রের মজুদ গড়ে তোলে সশস্ত্র গ্রুপগুলো।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার লেমুছড়ি সীমান্তে গতকাল বুধবারও একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের সাথে যৌথবাহিনীর সংঘর্ষে এক সন্ত্রাসী নিহত এবং বিপুল অস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে।
নিহত সন্ত্রাসীর নাম জ্ঞ্যান মংকর চাকমা (৪৫)। বাড়ি রাঙ্গামাটি জেলায়। সে ওই এলাকার একটি সশস্ত্র গ্রুপের প্রধান অর্থ সংগ্রাহক বলে র্যাব জানিয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে ৭টি এসএমজি, ১১টি ম্যাগজিন, ৪৩৭ রাউন্ড গুলি এবং ৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। চট্টগ্রাম র্যাব-৭ এর একটি দল এ অভিযান চালায়। অভিযানে সহায়তা করে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা।
র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতা উদ্দিন আহম্মদ গণমাধ্যমকে জানান, গত ১৮ মার্চ রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী দায়িত্ব শেষে ফেরার পথে গাড়িতে সন্ত্রাসী হামলায় সাতজন নিহত হওয়ার পর ওই সন্ত্রাসী গ্রুপটি বান্দরবান সীমান্তে গা-ঢাকা দেয় এমন খবর ছিল যৌথবাহিনীর কাছে।
সেনাবাহিনীর বান্দরবান রিজিয়নের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খন্দকার শাহিদুল এমরান গণমাধ্যমকে জানান, সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি সদস্যরা যৌথভাবে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে। রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সন্ত্রাসীরা সীমান্তে অবস্থান নেয়ার পর সেখানে অভিযান চালানো হয়।
গত ১৮ মার্চের হামলাস্থল থেকে এসএমজি ও একে-৪৭ রাইফেলের গুলির খোসা উদ্ধার হয়েছিল। তখনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলেছিলেন, ঘটনায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে। ঘটনার দিন সন্ধ্যার দিকে উপজেলা নির্বাচনের ভোট গণনা শেষে বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক বাঘাইহাট থেকে দীঘিনালা ফেরার পথে ৯ কিলোমিটার নামক স্থানে ব্রাশ ফায়ারে নিহত হন একজন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারসহ ৭ জন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরো একজন। এ ঘটনায় আরো ১৬ জন গুলিবিদ্ধ হন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় সূত্র বলেছে, পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ লেগেই আছে। মাঝে মধ্যে এই সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপরও আক্রমণ চালায়। ১৮ মার্চের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ছিল ওই ধরনের আক্রমণেরই একটি অংশ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ কোন্দলে গত বছর পাহাড়ি অঞ্চলে সশস্ত্র গ্রুপগুলোর মধ্যে হানাহানিতে অন্তত অর্ধশত নিহত হয়েছে।
এর মধ্যে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটে। গত বছর ১৯ আগস্ট খাগড়াছড়ি জেলা সদরের স্বনির্ভর বাজার এলাকায় ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ-পিসিপির সভাপতিসহ নিহত হয় ৭ জন। নিহতরা হলেন, পিসিপি জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তপন চাকমা, সহসাধারণ সম্পাদক এলটন চাকমা, পলাশ চাকমা, রূপক চাকমা, বরুন চাকমা, জিতায়ন চাকমা।
এর আগে ১৩ জুলাই খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান চঞ্চুমনি চাকমার দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুতর আহত হন। একই দিনে খাগড়াছড়ির আলুটিলায় প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত ইউপিডিএফ কর্মী জ্ঞানেন্দু চাকমা লাশ নিতে এসে তারই ছোট ভাই কালায়ন চাকমাকে (২২) অপহরণ করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। আগের দিন জ্ঞানেন্দু চাকমা নিহত হন। এই ঘটনায় জেএসএস পন্থীদেরকে দায়ী করে ইউপিডিএফ।
গত ৩ মে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তি চাকমাকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনার পর অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন বড় ধরনের সহিংস ঘটনার। অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমা ২০১০ সালে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি থেকে বেরিয়ে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা) নামে গঠিত নতুন দলে যোগ দেন। সংস্কারপন্থী এই নেতা ছিলেন ওই সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি।
ওই আশঙ্কা ঠিকই একদিন পর প্রমাণ হয়। পরদিন ৪ মে শক্তিমান চাকমার দাহক্রিয়ায় অংশ নিতে গিয়ে পথে সশস্ত্র হামলায় নিহত হন ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা, একই দলের নেতা সুজন চাকমা, সেতুলাল চাকমা ও টনক চাকমা। তাদের বাঙালি গাড়িচালক সজীবও নিহত হন। ওই ঘটনার মাস তিনেক আগে নিহত হয়েছেন ইউপিডিএফের ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি মিঠুন চাকমা। মিঠুন হত্যার কয়েক দিন আগে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। মিঠুন ওই দলে যোগ দিয়েছিলেন। গত ৩ জানুয়ারি কোর্টে হাজিরা শেষে বাড়িতে গেলে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিটি ঘটনায় ভারী অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে। গোপনে এই আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করছে পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। এবারে নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হামলার ঘটনায় প্রাথমিকভাবে জেএসএস সন্তু গ্রুপকে সন্দেহ করা হয়। তাদেরকে সহায়তার অভিযোগ উঠেছে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের বিরুদ্ধে। সরাসরি দায়ী করা হয় বাঘাইছড়ি উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জেএসএস সন্তু গ্রুপের নেতা বড় ঋষি চাকমাকে।
সূত্র জানায়, পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কাছে এসএমজি, একে-৪৭ রাইফেল, এম-১৬ এবং এম-৪ এর মতো আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। প্রতিবছর যৌথবাহিনী এসব সন্ত্রাসী ও তাদের আস্তানা থেকে বিপুল অস্ত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উদ্ধার করে। সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কাছ থেকে ১২০টি, ২০১৮ সালে ১৩০টি এবং চলতি বছরের এ পর্যন্ত প্রায় ৩০টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
গত বছর বেশ কয়েকটি বড় অপারেশন চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গত ১৮ এপ্রিল রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় একটি গোপন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে এসএমজি ও অ্যাসল্ট রাইফেলসহ পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
গত বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি লামা থেকে ২৫টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২০০০ গুলিসহ চারজনকে আটক করে সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। ওই বছরের ১৫ জানুয়ারি খাগড়াছড়ির রামগড় এলাকা থেকে অত্যাধুনিক একে-২২ রাইফেলসহ দু’জনকে আটক করে সেনাবাহিনী। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাহাড়ে বর্তমানে চারটি সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। জেএসএস, জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। এদের হাতে সাধারণ মানুষ এখন জিম্মি। এরা আধিপত্য বিস্তার, হত্যা, সন্ত্রাস, অপহরণ ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে আসছে। পাহাড়কে অশান্ত করতে তারা প্রায়ই খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে।
পার্বত্য এলাকায় অস্ত্র মজুদ সম্পর্কে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি মিডিয়া সোহেল রানা বলেছেন, পার্বত্য এলাকায় স্থানীয় উপজাতি সন্ত্রাসী সংগঠনের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ চলে আসছে। তাদের নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মাঝে মধ্যে অস্ত্র প্রদর্শনের ঘটনাও ঘটে। তবে এসব এলাকা দুর্গম হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে নিয়মিত অস্ত্র উদ্ধার করে থাকে। মূলত আধিপত্য বিস্তার করতে নিজেদের ক্ষমতা বা সক্ষমতা প্রদর্শন করতে তারা এসব অস্ত্র সংগ্রহ করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসব অস্ত্রধারীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও অস্ত্র উদ্ধারে সক্রিয় তৎপর আছে।