আবারো নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এবার উপজেলা নির্বাচনে ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা ঘটে৷ পুলিশ বলছে, তারা ধর্ষকদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছেন৷ কিন্তু এখন সবার প্রশ্ন, সুবর্ণচরে বারবার কেন ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে?
এর আগে ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ধানের শীষে ভোট দেয়ায় ওই রাতে আওয়ামী লীগ নেতা রহুল আমিনের নির্দেশে এক গৃহবধূকে তার সন্তানদের সামনেই ধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। শুরুতে ওই ঘটনায় পুলিশ মামলা নিতে এবং আসামিদের আটকে নানা টালবাহানা করলেও শেষ পর্যন্ত ব্যাপক সমালোচনার মুখে তৎপর হয়। রুহুল আমিনসহ আসামিরা এখন কারাগারে আছেন। সম্প্রতি রুহুল আমিনের জামিন হলেও তা বাতিল হওয়ায় সে কারাগার থেকে বের হতে পারেনি। তবে মামলায় এখনো চার্জশিট দেয়া হয়নি।
ওই ঘটনার তিন মাসের মাথায় গত উপজেলা নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় ওই এলাকায় আরো একজন গৃহবধূ ছয় সন্তানের মা গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট দেয়াকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের সমর্থকরা তাকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
নির্যাতিতা ওই নারী জানান, সুবর্ণচর উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে তিনি ও তার স্বামী চশমা প্রতীকের প্রার্থী তাজউদ্দিন বাবরকে ভোট দেন। এতে প্রতিপক্ষ ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী ফরহাদ হোসেন বাহারের (তালা প্রতীক) লোকজন ক্ষিপ্ত হয়। নির্বাচনে বাহার জয়ী হন।
সন্ধ্যায় আমি ও আমার স্বামী মোটর সাইকেলে করে উত্তর বাগ্যা গ্রামে নিজ বাড়িতে ফেরার পথে তালা প্রতীকের প্রার্থী নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ফরহাদ হোসেন বাহারের সমর্থক ইউসুফ মাঝির নেতৃত্বে ১০-১২ জন আমাদের মোটর সাইকেল থেকে নামিয়ে মারধর করে। পরে তাদের উত্তর বাগ্যা গ্রামের রুহুল আমিনের (আগের ধর্ষণের মূল ব্যক্তি) মৎস্য খামারে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমাকে খামারের পাশে কলাবাগানে নিয়ে বেচু মাঝি, বজলু ও আবুল বাসার মারধর ও ধর্ষণ করে। এ সময় আমার স্বামীর চিৎকারে লোকজন এসে আমাদের উদ্ধার করে।
রাতেই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ তার স্বামী বাদী হয়ে মোট আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন৷ পুলিশ ইউসুফ মাঝি ও আবুল বাশার নামে দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
ধর্ষণের শিকার নারীর স্বামী অভিযোগ করেন, ‘‘পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তারে দেরি করে৷ আগেই তৎপর হলে সবাইকে গ্রেপ্তার করা যেত। এখন বিচু মাঝি ও তার লোকজন আমার ছেলেমেয়ে এবং আমাকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে, ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। আমি এখন আতঙ্কের মধ্যে আছি।
সুবর্ণচর থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) এবং এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. ইব্রাহিম খলিল জানান, আমরা অভিযোগ পাওয়ার পরপরই ঘটনাস্থলে গিয়েছি। দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছি। মামলায় আটজনের নাম উল্লেখ করে আরো অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। তবে তিনি বলেন, আসামিদের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবারের পূর্ব বিরোধ ছিল৷ তবে ভোটের দিন ভোট দেয়া নিয়েও ঝামেলা হয়। তারই জেরে এই ঘটনা।
এদিকে সুবর্ণচরের নবনির্বাচিত উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফরহাদ হোসেন বাহার দাবি করেন, আমি ধর্ষণের ঘটনা শোনার পর ওই এলাকায় গিয়েছি। যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারা আমার লোক নয়, আমি তাদের চিনিও না। আমিও এই ধর্ষণের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
কেন সুবর্ণচরে বার বার গণধর্ষণ?
ফরহাদ হোসেন বাহার বলেন, এই সুবর্ণচরে ভোটের আগে, ভোটের রাতে, ভোটের পরে আরো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। আমারও প্রশ্ন, কেন এই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে৷ এর কারণ কী? এটা আমারও প্রশ্ন৷ আমি পুলিশকে বলছি এটা দেখতে। সাংবাদিকরাও এটা নিয়ে কাজ করলে ভালো হয়।
ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মো. ইব্রাহিম খলিল বলেন, চর এলাকা হওয়ায় এখানকার মানুষের মধ্যে শিক্ষার অভাব আছে। তাদের মধ্যে জমিজমা নিয়ে ও রাজনৈতিক বিরোধ আছে। এইসব বিরোধে প্রতিশোধ নিতে তারা ধর্ষণের পথ বেছে নেয়। প্রতিপক্ষের নারীদের টার্গেট করে৷ এর মাধ্যমে তারা ভয় ও ত্রাস সৃষ্টি করতে চায়। অনেক দুর্গম এলাকা আছে যেখানকার খবর আমরা দেরিতে পাই।
তবে মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, নির্বাচন, রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে যখন নারীকে ধর্ষণ করা হয় তখন এটা ভয়াবহ ব্যাপার৷ এখানে ক্ষমতা ও ক্ষমতা প্রদর্শনের বিষয় আছে।
তিনি বলেন, সুবর্ণচরে ৩০ ডিসেম্বর ভোটের রাতে যে নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে সেখানে পুলিশের ভূমিকা গ্রহণযোগ্য ছিল না। মূল আসামিকে তারা বাদ দিয়েছিল৷ এর একটা প্রভাব পড়েছে। প্রতিবাদের মুখে পুলিশ এই মামলায় হয়তো পরে সঠিক পথে গেছে। কিন্তু আগে আরো অনেক ঘটনা হয়তো ঘটেছে, যা আমরা জানিই না। ফলে সুবর্ণচরে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আবারো সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শুধু সুবর্ণচর নয়, সারাদেশেই নারীরা ক্ষমতার কাছে ভালনারেবল৷ তাদের ওপর হামলা, নির্যাতন বা তাদেরকে ধর্ষণ করে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়৷