যেভাবে অপদস্থ হলেন ডাকসুর ভিপিসহ অন্যরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের ছাত্র ফরিদ হাসানকে মেরে রক্তাক্ত করার ঘটনায় হল প্রশাসনকে লিখিত অভিযোগ দিতে গেলে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নূরকে অবরুদ্ধ করে লাঞ্ছিত করে হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় ছাত্রীদের উত্ত্যক্তের অভিযোগ উঠে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ছাত্র ফেডারেশন ঢাবি শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির, শামসুন নাহার হলের ভিপি শেখ তাসনিম আফরোজ ইমিসহ ৯ জন আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী এসব ঘটনা ঘটে। হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি তাহসান আহমেদ রাসেল, সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান তাপসসহ হল সংসদে নবনির্বাচিত সদস্যদের নেতৃত্বে এসব ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, বিকেলে এসএম হলে ভিপি নূর প্রবেশ করার পরপরই ছাত্রলীগ সভাপতি তাহসান হোসেন রাসেল ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান তাপসের নেতৃত্বে তাকে অবরুদ্ধ করা হয়। এ সময় হল সংসদের অনুমতি না নিয়ে হলে প্রবেশ করা এবং ছাত্রীদের নিয়ে ছাত্র হলে প্রবেশ করায় নূরকে গালিগালাজ করেন হল সংসদের ভিপি কামাল হোসেন ও জিএস জুলিয়াস সিজার। একপর্যায়ে নূরের গায়ে হাত তোলেন কামাল। এ ছাড়াও নূরের সাথে থাকা আতাউল্লাহ নামে একজনকে মারধর করেন ছাত্রলীগ কর্মীরা। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা নূরের কাছে হলে প্রবেশের কারণ জানতে চাইলে নূর বলেন, অভিযোগ নিয়ে হল প্রাধ্যক্ষের সাথে কথা বলতে এসেছি। এ সময় বাইরে থাকা মেয়েদের ওপর ডিম ছোড়া হয়। সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মাহবুবুল আলম জোয়ার্দার সেখানে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। এরপর সবাই যায় হল প্রাধ্যক্ষের কক্ষে। সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করেন পিয়াস, উর্দু বিভাগ মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তালুকদার শরীফুল ইসলাম ও বহিষ্কৃত মিজানুর রহমান পিকুল। তবে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সেখানে প্রবেশ করেন অনায়াসেই।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় হল প্রাধ্যক্ষ তাদের সেখান থেকে বের করে হলের বাইরে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যেতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি। হল প্রাধ্যক্ষ ও হলের আবাসিক শিক্ষকদের সামনেই নূরসহ অন্যদের অনবরত ডিম ছোড়তে থাকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে এ সময় লাঞ্ছিত হন হল প্রাধ্যক্ষও। হলের বাইরে এলে উম্মে হাবিবা বেনজিরের ওপর হামলা করা হয়। মারাত্মক আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ছাড়া হাবিবুল্লাহ বেলালী এবং অরণী সেমন্তী খান আহত হন। বাকিদের নাম সংগ্রহ করা যায়নি।

এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলেন, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষকদের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যেভাবে নারী শিক্ষার্থীদের হেনস্থা করল তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে আরো একটি কালো অধ্যায়ের জন্ম দিলো। হামলার আগে বারবার প্রক্টরকে কল দেয়া হলেও তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হননি। হামলার সময় এসএম হলের সামনের রাস্তার লাইট অফ করে রাখা হয়। সবমিলিয়ে ছাত্রলীগ হামলা করার জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখে প্রশাসন। তাই এই হামলার সম্পূর্ণ দায় প্রশাসনের। তিনি বলেন, ডাকসু ভিপি নুরুল হক নূরকে এসএম হল থেকে উদ্ধার করা হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে রাখে এবং বাইরে আমরা যারা অপেক্ষা করছিলাম আমাদের ওপর হামলা চালায়। এই হামলায় উম্মে হাবিবা বেনজির আহত হয়ে এখন ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। তখন শামসুন নাহার হলের ভিপি ইমি এবং অরণী সেমন্তী খানের ওপর শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন চালায় তারা।

এ বিষয়ে হামলা ও লাঞ্ছনার শিকার শামসুন নাহার হলের ভিপি শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি বলেন, আমরা যারা এসএম হলের প্রাধ্যক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিতে গিয়েছিলাম, তাদের ওপর হামলা করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ডাকসুর ভিপি, সমাজসেবা সম্পাদককে অবরুদ্ধ করে রাখে। মেয়েদের লাঞ্ছিত করে। আমাদের গায়ে ডিম ছুড়ে। আমার গায়ে ডিম ছুঁড়েছে। একজন নির্বাচিত হল সংসদের ভিপির সাথে যা করেছে ওরা, তার বিচার করতে হবে। তিনি বলেন, দুই বছরের জন্য বহিষ্কার এসএম হলের সানাউল্লাহ সায়েম তার লোকজন নিয়ে এখন মেয়েদের উত্ত্যক্ত করেছে। আমরা যখন হলের সামনে স্যারদের সাথে কথা বলছিলাম, তখন ওরা আবারো আমাদের ওপর হামলা করে। তবে এ বিষয়ে অভিযুক্তদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দ্বারা মেয়েদের সংবেদনশীল অঙ্গে হাত দেয়ার অভিযোগ করেন শামসুন নাহার হলের ভিপি তাসনীম আফরোজ ইমি। বিশ^বিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা দুই পক্ষের বক্তব্যই শুনেছি। একটি হলে ঘটনার বিষয়ে অভিযোগ সে হলের শিক্ষার্থীরাই দেবে। সেখানে অন্য হলের শিক্ষার্থীরা কেন যাবে? তিনি বলেন, এ ঘটনায় এসএম হলের প্রাধ্যক্ষ তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন। তারা বিষয়টি দেখছেন।
ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট : হামলা ও লাঞ্ছনার পরে ভুক্তভোগীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিল শেষে ভিসির বাসভবনের সামনে গিয়ে তারা অবস্থান ধর্মঘট পালন করে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা অবস্থান করবেন বলে জানা যায়। এ বিষয়ে নূর বলেন, হামলার বিচার এবং হল থেকে অছাত্র, বহিরাগতদের না তাড়ানো পর্যন্ত ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি চলবে। এ রিপোর্ট লেখা (রাত পৌনে ১টা) পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করছিলেন। এর পাশেই স্লোগান দিচ্ছিল এসএম হলের ভিপি কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে হল শাখার অন্যান্য নেতাকর্মী।

এর আগে বিকেলে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এক মানববন্ধনে সংহতি জানাতে এসে ছাত্রলীগের মনোনয়ন না পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হল সংসদে স্বতন্ত্র পদে নির্বাচন করতে চাওয়ায় উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী ফরিদ হাসানকে মেরে রক্তাক্তকারীদের আগামী তিন দিনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নূর। ফরিদ হাসানকে মারধরের প্রতিবাদে বিশ^বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা এ মানববন্ধনের আয়োজন করেন। মানববন্ধনে উপস্থিত হয়ে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নূর বলেন, এই সন্ত্রাসী হামলার সাথে যারা জড়িত রয়েছে তিন দিনের মধ্যে সিন্ডিকেট মিটিং ডেকে তাদের বহিষ্কার করতে হবে। যদি বহিষ্কার করা না হয় তিন দিন পর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

মানববন্ধনে আরো উপস্থিত ছিলেন ডাকসুতে স্বতন্ত্র জোট থেকে ভিপি পদে নির্বাচন করা অরণী সেমন্তী খান, ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির, কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্লাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন, যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান, ফারুক হাসান প্রমুখ। মানববন্ধন শেষে ক্যাম্পাসে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে প্রক্টর অফিসের সামনে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখান থেকে হামলাকারীদের বহিষ্কার দাবিতে প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়।
প্রসঙ্গত, সোমবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ফরিদ হাসানকে পিটিয়ে হল থেকে বের করে দেন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসাধীন আছেন। তার কপালের ডান পাশ থেকে ডান কান পর্যন্ত ৩২টি সেলাই দেয়া হয়েছে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top