ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী ভবন নির্মাণের পর বসবাস বা ব্যবহারের জন্য অকুপেন্সি সনদ বাধ্যতামূলক হলেও ভবন মালিকরা তা নিচ্ছেন না। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকও বিষয়টি নিয়ে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এর ফলে ভবন মালিকরা ভবনের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে নিজেদের ইচ্ছেমতো ভবন তৈরি ও ব্যবহার করে যাচ্ছে। আর সনদ নেওয়া কার্যকর করা গেলে ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণ করা যেতো না। বাড়তো না অগ্নি নিরাপত্তা ঝুঁকিও।
তবে রাজউক চেয়ারম্যান বলছেন, ভবন নির্মাণের পর রাজউক চাইলেও অকুপেন্সি সনদ দিতে পারে না। তবে সনদ সংগ্রহে ভবন মালিককে বাধ্য করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই সনদ ছাড়া বিদ্যুৎ গ্যাস ও পানি সংযোগ দেওয়া হবে না। এই বিষয়টি আইনে না থাকলেও মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন।
২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ভবনের আংশিক বা সম্পূর্ণ নির্মাণ শেষের পরে তা ব্যবহার বা বসবাসের জন্য সনদ নিতে হবে। এই সনদ পাওয়ার আগে ইমারত আংশিক বা সম্পূর্ণ কোনও অবস্থাতেই ব্যবহার করা যাবে না। এই সনদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। পাঁচ বছর পরপর এটি নবায়নও বাধ্যতামূলক।
রাজউকের তথ্য মতে, বর্তমানে সংস্থাটির আওতাধীন এলাকায় ২২ লাখের বেশি ইমারত রয়েছে। এর মধ্যে ৮৪ শতাংশ ভবন ১ তলার। আর তিন হাজার ২৭৩টি বহুতল ভবন রয়েছে। এই তথ্য ২০১৬ সালের। এছাড়া চলতি অর্থবছরে ৮ হাজার ৭৩০টি ভবনের প্লান পাস হয়েছে। ফলে বর্তমানে এর সংখ্যা বেড়েছে। তবে ইমারাত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ সালে প্রণীত হয়েছে। এরপর গত ১১ বছরে কমপক্ষে সাড়ে ৬০ হাজার থেকে ৮০ হাজারের মতো ভবন নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত রাজউক থেকে ১৬৫টি ভবন ব্যবহারের অনুমতিপত্র বা অকুপেন্সি সনদ সংগ্রহ করেছেন ভবন মালিকরা।
এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অকুপেন্সি সনদ সংগ্রহ না করায় ভবনটি নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়েছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যাবে না। আর রাজউক মালিক পক্ষকে এই সনদ সংগ্রহে বাধ্য করতে না পারায় ভবনটি সঠিকভাবে নির্মাণ হচ্ছে কিনা তা তদারকি করা যাচ্ছে না। একারণে কেউ নকশা ব্যত্যয় করে ভবন নির্মাণ করলে তা ধরা যাচ্ছে না। আর সনদ সংগ্রহ না করায় রাজউকও এখন পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
রাজউকের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ শাখা সূত্রে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে সংস্থাটির ৮টি জোনের আওতায় ৫ হাজার ৫৫৪টি নকশা অনুমোদনের জন্য আবেদন জমা পড়েছে। এ থেকে পাঁচ হাজার ১২৭টি নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪২৭টি নকশা বাতিল হয়েছে। বর্তমানে এর সংখ্যা আরও বেড়েছে। এর পর সংস্থাটি আর কোনও বাৎসরিক রিপোর্ট প্রণয়ন না কলেও সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন- প্রতিবছর প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়। এ হিসেব গত ১১ বছরে নগরীতে সাড়ে ৬০ হাজার ভবন নির্মাণ হয়েছে। এসবের অনুপেন্সি সনদ সংগ্রহের হার শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ।
রাজউকের সংশ্লষ্ট শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, নকশা অনুমোদনের পর ভবন নির্মাণকারীরা আয়তন বাড়িয়ে বা নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন বানিয়ে ফেলে। এসময় রাজউকও সঠিকভাবে তদারকি করে না। ফলে নির্মাণ শেষ ভবন মালিকরা এই সনদ সংগ্রহ করে না। কেউ সনদ না নিয়ে ভবন ব্যবহার করলে তাদের বিরুদ্ধেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সে কারণেই আজ নগরীর এই দশা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আইনটি যদি রাজউক কার্যকর বা প্রয়োগ করতে পারতো তাহলে নগরীর চেহারা বদলে যেতো। কেউ আর অবৈধ উপায় অবলম্বন করে ভবন নির্মাণ করতো না।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যার্নাসের সাধারণ সম্পাদক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই আইনটি একারণে করা হয়েছে- আগে অনুমোদিত প্ল্যানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নানাভাবে ভবন নির্মাণ করা হতো। যাতে এর ব্যত্যয় না ঘটে। অর্থাৎ ভবন মালিক যদি অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী তার ভবনটি নির্মাণ করেন তাহলে তিনি এই সনদ পাবেন। এখন সনদ না নেওয়া কারণে আগে থেকে এখন কোনও পার্থক্য তৈরি হয়নি। এতে আমরা খুব উপকৃত হয়নি। ব্যত্যয় ঘটানোর কারণে মালিকরা সনদ সংগ্রহ করতে যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, আইন অনুযায়ী এই সনদ সংগ্রহ না করে ভবন ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু আইনটি প্রয়োগ না করার কারণে এই সমস্যাটা হচ্ছে। ত্রুটি পূর্ণ ভবন নির্মাণ বেড়েই চলছে।
জানতে চাইলে মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) রাতে রাজউক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ভবন নির্মাণের পর রাজউক চাইলেও অকুপেন্সি সনদ দিতে পারে না। কারণ, যারা মালিক তারা কিছু না কিছু ত্রুটি করে। তারা যদি নকশা না মেনে ত্রুটি পূর্ণ করে ভবন নির্মাণ করে তাহলে তাকে তো এই সনদ দিতে পারি না।
তিনি বলেন, সম্প্রতি আমরা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একট সিদ্ধান্ত নিয়েছি অকুপেন্সি সনদ ছাড়া কোনও ভবনের বিদ্যুৎ-গ্যাস ও পানি সংযোগ দেওয়া যাবে না। কিন্তু, বিষয়টি হচ্ছে ভবন নির্মাণের সময় যখন তারা এই সংযোগগুলো নেয় পরে আর এগুলো বিচ্ছিন্ন করা হয়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা দেখার দায়িত্ব অবশ্যই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর। তবে আমরা এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এর আর ব্যত্যয় হবে না। বর্তমানে আমাদের তদারকিতে যে আট হাজার ৭৩০টি ভবন নির্মাণ হচ্ছে সেগুলোতে কোনও ছাড় নয়। সম্প্রতি কয়েকটি ভবন নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়াও হয়েছে। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন