ওয়াজ মাহফিলে করারোপসহ ৬ সুপারিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওয়াজ মাহফিলের বক্তাদের বয়ানে বিভিন্ন বিষয় আমলে নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ (ইফাবা), জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারি কয়েকটি দফতরকে প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

একই সাথে ওয়াজ মাহফিলে বক্তাদের বয়ানে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদে উৎসাহ দেয়া, ধর্মের নামে বিভিন্ন উপদল ও শোবিজ তারকাকে নিয়ে বিষেদগার, নারীদের পর্দা করা নিয়ে কটূক্তিসহ বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে ছয়টি সুপারিশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ (ইফাবা), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও সব বিভাগীয় কমিশনারের কাছে পাঠানো হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এসব সুপারিশের মধ্যে মাহফিলে বক্তাদের মধ্যে যারা চুক্তিভিত্তিক অর্থগ্রহণ করেন তারা আয়কর দিচ্ছেন কি না তা দেখা ও দেশবিরোধী বক্তব্য দিলে আইনের আওতায় আনার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। একই সাথে উচ্চশিক্ষিত বক্তাদের নিবন্ধনের আওতায় আনতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে জরুরি পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এসব বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে এরই মধ্যে তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে ইফাবা।

সুপারিশ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, ওয়াজ মাহফিলে কী ধরনের বক্তৃতা হয় তা সবসময় আমাদের কাছে প্রতিবেদন আকারে আসে। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করি। আর বক্তারা কিভাবে করের আওতায় আসবেন তা দেখবে আয়কর বিভাগ।

সূত্রে জানা গেছে, মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা-২ থেকে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এতে মাহফিলের ১৫ জন বক্তার নাম উল্লেখ করে জানানো হয়েছে ‘এই বক্তারা সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ, জঙ্গিবাদ, গণতন্ত্রবিরোধী ও দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী বয়ান দেন বলে লক্ষ করা গেছে।’ এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা রেডিক্যালাইজড হয়ে উগ্রবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে বিশেষ করে শীত মওসুমে আলেম-ওলামাদের ইসলামি বক্তব্য শোনানোর জন্য ওয়াজ মাহফিল হয়ে থাকে। এসব আয়োজন ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রচার হয়।

মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে ১৫ জন বক্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এরা হলেন, আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসূফ (সালাফি), মাওলানা মুফতি মাহমুদুল হাসান (মুহতামিম, জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া, মোহাম্মদপুর), আল্লামা মামুনুল হক (যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস), মুফতি ইলিয়াছুর রহমান জিহাদী (প্রিন্সিপাল, বাইতুল রসূল ক্যাডেট মাদরাসা ও এতিমখানা, ক্যান্টনমেন্ট), মুফতি ফয়জুল করিম (সিনিয়র নায়েবে আমির, ইসলামী আন্দোলন), মুজাফফর বিন মুহসিন, মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন (যুগ্ম মহাসচিব, ইসলামী ঐক্যজোট), মতিউর রহমান মাদানী, মাওলানা আমীর হামজা, মাওলানা সিফাত হাসান, দেওয়ানবাগী পীর, মাওলানা আরিফ বিল্লাহ, হাফেজ মাওলানা ফয়সাল আহমদ হেলাল ও মোহাম্মদ রাক্বিব ইবনে সিরাজ।

প্রতিবেদনে বর্তমান সময়ের বক্তাদের আলোচ্য বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে নারী সম্পর্কিত বয়ানে কী কী আলোচনা করা হয়, মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ পয়লা বৈশাখে নববর্ষ পালন নিয়ে বক্তাদের মন্তব্যের সারাংশ ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নিয়ে বক্তাদের কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। মূর্তি ভাঙা ধর্মীয় কাজ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাফির, অমুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায় বলে মন্তব্য করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে রাষ্ট্রের আইনবিরোধী হিসেবে মাহফিলের বিভিন্ন বক্তাদের মন্তব্য যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মুশরিকদের কাজ, শহীদ মিনারে ফুল দেয়া, মূর্তিতে ফুল দিয়ে নীরবতা পালন করা শিরক, গণতন্ত্র ইসলামে নেই, এটি হারাম এবং জাতীয় সঙ্গীত কওমি মাদরাসায় চাপিয়ে দেয়া যাবে না। জঙ্গিবাদকে উসকে দেয়া বক্তব্য হিসেবে বক্তাদের ‘আল্লাহর রাস্তার প্রতিষ্ঠায় উত্তম জিহাদ হচ্ছে সশস্ত্র জিহাদ, আল্লাহ রাসূলকে গালি দিলে কোপাতে হবে, ইসলামের বিরুদ্ধে আইন করলে কোপাতে হবে এমন মন্তব্যগুলো প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এ ছাড়া ওয়াজের বক্তারা প্রযুক্তির নানাবিধ ব্যবহারের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষ করে ইউটিউবে বিভিন্ন নামে চ্যানেল খুলে তাদের বিদ্বেষপূর্ণ ও উগ্রবাদী ওয়াজ প্রচারণা চালিয়ে আসছে। এ ধরনের ওয়াজ লাখ লাখ দর্শক এবং ওয়াজকারী ও শেয়ারকারীদের অধিকাংশই সরলমনা ধর্মপ্রাণ তরুণ মুসলিম। সে জন্য ওয়াজকারীদের উগ্রবাদী কথাবার্তা ও মনোভাব অবিরত দেশের তরুণ মুসলিম সমাজে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করছে। তারা দেশীয় সংস্কৃতি পালনে বিভ্রান্ত হচ্ছে। ফলে কিছুসংখ্যক লোক প্রতিশোধপরায়ণ ও জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছয়টি সুপারিশ হলো:

১. ওয়াজি হুজুররা যেন বাস্তবধর্মী ও ইসলামের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সংহতিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন, সে জন্য তাদের প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণের ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন ও কমিউনিটি পুলিশের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।

২. যারা ওয়াজের নামে হাস্যকর ও বিতর্কিত বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে ধর্মের ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট করার চেষ্টা চালান তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রো-অ্যাকটিভ উদ্বুদ্ধকরণ করা।

৩. অনেক আলেমের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রির মতো উচ্চশিক্ষা ব্যতীত যারা ওয়াজ করে তারাই জঙ্গিবাদ ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তাই মাদরাসায় উচ্চশিক্ষিত ওয়াজকারীদের নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসা।

৪. অনেকেই আছেন, যারা হেলিকপ্টারে ওয়াজ মাহফিলে যোগ দেন এবং ঘণ্টাচুক্তিতে বক্তব্য দিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ গ্রহণ করেন। তারা নিয়মিত ও সঠিকভাবে আয়কর প্রদান করেন কি না তা নজরদারির জন্য আয়কর বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগে কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি করা।

৫. ওয়াজি হুজুরদের বক্তব্য স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক সংরক্ষণ ও পর্যালোচনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া এবং উসকানিমূলক ও বিদ্বেষ ছড়ানোর বক্তব্য দিলে তাদের সতর্ক করা। প্রয়োজনে পরবর্তী সময়ে তাদের ওয়াজ করার অনুমতি না দেয়া।

৬. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে ও রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য প্রদানকারীদের আইনের আওতায় আনা।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top