মামলার ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে জনতা ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত দ্বিতীয় বৃহত্তম এই ব্যাংকের মোট মামলা এখন দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৩৮৬টিতে। এ মামলায় আটকে আছে ২১ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। মামলাগুলোর মধ্যে অর্থঋণ আদালতে মামলা রয়েছে ৩ হাজার ২৪০টি। রিট মামলা ২০৭টি। আপিল ও রিভিশন ২৭০টি এবং কিছু রয়েছে অন্যান্য মামলা। জনতা ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
উল্লেখ্য, এক বছরের ব্যবধানে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। ২০১৭ সালে যেখানে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল সাত হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সেখানে গত ২০১৮ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৩০৫ কোটি টাকায়। এর মধ্যে দু’টি প্রতিষ্ঠানের কাছেই পাওনা ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
বিশালসংখ্যক মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের মন্তব্য হচ্ছে, ‘গ্রাহক কর্তৃক দায়েরকৃত রিটসমূহ ভ্যাকেট করার জন্য নিয়মিত ফলোআপ অব্যাহত আছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে রিট ভ্যাকেট করা হলেও গ্রাহক কর্তৃক পুনঃপুন রিট করে সময়ক্ষেপণ করা হয়।
জনতা ব্যাংক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, রিট পিটিশিন দায়ের করা শীর্ষ ১৮ বৃহৎ ঋণগ্রহীতার কাছে আটকে আছে চার হাজার ৭০ কোটি টাকা। এসব তালিকার মধ্যে ‘রানকা সোহেল’র এর কাছে প্রাপ্য ৬৫২ কোটি টাকা। ঋণগ্রহীতা অন্যান্য গ্রাহকের নাম ও সম্পৃক্ত অর্থের পরিমাণ বি আর স্পিনিং-৫৮৫ কোটি টাকা, মেসার্স এস এম স্টিল-৫১২ কোটি, মডার্ন স্টিল ৪০৯ কোটি টাকা, রতনপুর শিপ রিসাইক্লিং-৩১২ কোটি টাকা, লিথুন ফ্যাব্রিকস- ২৯৯ কোটি টাকা, ড্রাগন সোয়েটার ২৭৩ কোটি টাকা, ইব্রাহিম গ্রুপ ১৯৬ কোটি টাকা, সিক্স সিজন ১৮৯ কোটি টাকা, নাসা গ্রুপ ১৬৩ কোটি টাকা, এস এ অয়েল অ্যান্ড সামান্নাজ ১১৮ কোটি টাকা, অ্যালাইন অ্যাপারেলস ১১০ কোটি টাকা, লিনা পেপার মিলন ৬৭ কোটি টাকা, টোটাল ফ্যাশন ৬৩ কোটি টাকা, চয়েস গার্মেন্টস ৫৮ কোটি টাকা, মুন্নু ফ্যাব্রিকস ৩৫ কোটি টাকা, ফাইভ ব্রাদার্স ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট ১৯ কোটি টাকা এবং প্যাসিফিক ডেনিম ১০ কোটি টাকা।
মামলা বিষয়ে জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ঋণ আদায়ের জন্য যাদের বিরুদ্ধে ব্যাংক মামলা করে তারা সবাই প্রভাবশালী। মামলা করলেও তারা সেই মামলা আটকাতে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করে। এর ফলে অনেক খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হলে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি আরো ভালো হতো। তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে দ্রুত রিট মামলাগুলো ভ্যাকেট করার জন্য।
এ দিকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সূচকে জনতা ব্যাংক টার্গেট পূরণ করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন খেলাপি বা শ্রেণীকৃত ঋণ থেকে এক বছরের জন্য আদায়ের টার্গেট দেয়া হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর ২০১৮) আদায় করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ১৫৮ কোটি টাকা। টার্গেট অনুযায়ী এ সময়ে আদায় করার কথা ছিল ২৫০ কোটি টাকা। একইভাবে অবলোপনকৃত (ডেট রিটঅফ) ঋণ হতে আদায় করার টার্গেট রয়েছে ১৫০ কোটি টাকা। এই হিসেবে ছয় মাসে আদায় হওয়া উচিত ৭৫ কোটি টাকা। কিন্তু এ সময়ে জনতা ব্যাংক আদায় করেছে মাত্র ১৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা।
জানা গেছে, জনতা ব্যাংকের মোট ১৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি খেলাপি ঋণের মধ্যে দুটি গ্রুপের কাছেই রয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এই দু’টি গ্রুপ হলোÑ ক্রিসেন্ট গ্রুপ ও অন্যটি হলো অ্যাননটেক্স। অ্যাননটেক্সের প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ঋণের প্রায় পুরোটাই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ইউনুছ বাদল নিজেই নিয়েছেন। অ্যাননটেক্স তার কোম্পানির নামে বিভিন্ন সময়ে কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুললেও টাকা পরিশোধ করেনি। প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে ব্যাংক নিজেই বাধ্য হয়ে বিদেশী রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানকে অর্থ পরিশোধ করেছে। গ্রাহককে তা পরিশোধের কথা থাকলেও তারা তা পরিশোধ করেনি। এসব দায়ের বিপরীতে ফোর্সড ঋণ তৈরি করেছে জনতা ব্যাংক। জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা থেকে এই গ্রুপটি অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে।
অন্য দিকে আলোচিত ক্রিসেন্ট গ্রুপ বিভিন্ন সরকারি তহবিল ও জনতা ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক সুবিধা নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি চামড়ার ভুয়া রফতানি বিল তৈরি করে সরকার থেকে নগদ রফতানি সুবিধা নিয়েছে, আবার রফতানি করেও দেশে টাকা ফেরত আনেনি। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে ক্রিসেন্টের পাদুকা বিক্রির দোকান রয়েছে। এখন বাধ্য হয়ে ৭৫ ভাগ ছাড়ে তারা জুতা বিক্রি করছে বলেও জানা গেছে। এই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার রয়েছেন দুই ভাই। একজন এম এ কাদের এবং অন্যজন এম এ আজিজ। তিনি আবার ‘জাজ মাল্টিমিডিয়ার’ প্রধানও। সম্প্রতি মুদ্রা পাচার আইনে এম এ কাদেরকে এনবিআরের করা মামলায় পুলিশ গ্রেফতার করেছে। জনতা ব্যাংকও এ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সবেমাত্র আইনি আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু খেলাপি ঋণের এই বিশাল অঙ্কের অর্থ শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।