বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনের যেন হিড়িক পড়েছে। দুর্ঘটনার গভীরে না গিয়ে কিংবা সঠিক অনুসন্ধান না চালিয়ে অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ যেন তদন্ত করার নামে কমিটি গঠনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
বনানীর ১৭ নম্বর রোডের ২২ তলা ভবনের মর্মান্তিক এই আগুনের ঘটনার মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বেশকিছু দতন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে প্রতিটি দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হয় ঠিকই কিন্তু তাদের রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখে না কিংবা সুপারিশের ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়ন হয়না। নিকট অতীতের পুরান ঢাকার নীমতলী কিংবা চকবাজারের চুড়িহাট্টার ঘটনা এমনটারই ইঙ্গিত বহন করে।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এফআর টাওয়ারের আগুনের ঘটনায় ইতোমধ্যে ৮ টি দতন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এসব তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। ফায়ার সার্ভিস, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়(বুয়েট), ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (আইইবি) এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে পৃথক পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বনানীর আগুনের এই ঘটনার পর পরই ফায়ার সার্ভিসের সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হুসাইন সাংবাদিকদের জানান, ভবনের ভেতরে আগুন লাগার কারণ ও কিংবা কি কি ত্রুটির কারণে এই অগ্নিকান্ড ঘটেছে তা নির্ধারণের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে আট সদস্যের দতন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এফআর টাওয়ারের পাশের ভবনে হোটেল সেরিনাতে ২৮ মার্চ বিকেলে তিনি দতন্ত কমিটি গঠনের এ তথ্য জানান।
অন্যদিকে অগ্নি-দুর্ঘটনায় পতিত এফআর ভবনের নকশা অনুমোদন এবং নির্মাণ সংক্রান্ত কোন কাজে ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল কি না, সে বিষয়ে তদন্ত করার জন্য ০৬ (ছয়) সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী জনাব শ. ম. রেজাউল করিম, এমপি’র নির্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে মন্ত্রণালয় এ তদন্ত কমিটি গঠন করে।
মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মোঃ ইয়াকুব আলী পাটওয়ারীকে আহ্বায়ক এবং মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মোঃ ফাহিমুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটির অপর ০৪ (চার) সদস্য হলো স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসীর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর সদস্য (পরিকল্পনা) আবু সাঈদ চৌধুরী, গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মোঃ মইনুল ইসলাম এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর নগর পরিকল্পনাবিদ মোঃ আশরাফুল ইসলাম।
এ কমিটি বনানী মডেল টাউনের এফ আর টাওয়ারের নকশা অনুমোদন ও ভবন নির্মাণে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তা সনাক্ত করবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করবে। কমিটিকে বিষয়টি সরেজমিনে তদন্তপূর্বক ৭ (সাত) কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
এফ আর টাওয়ারের আগুনের ঘটনা তদন্তে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের তথ্য জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. তরুণ কান্তি শিকদারকে আহ্বায়ক করে গঠিত তদন্ত কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের যুগ্মসচিব পর্যায়ের প্রতিনিধি, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পর্যায়ের ঢাকা প্রতিনিধি, গুলশান জোনের উপপুলিশ কমিশনার এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান ভুঁইয়া। এই কমিটি দ্রুততম সময়ের মধ্যেই রিপোর্ট জমা দেবে বলে জানানো হয়েছে।
বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিকান্ডের ঘটনায় যথাযথ কারণ অনুসন্ধানের নিমিত্তে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি) আট (৮) সদস্য বিশিষ্ট ‘অগ্নিকান্ডের যথাযথ কারণ অনুসন্ধান ও সুপারিশমালা প্রনয়ন’ কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২৯ মার্চ আইইবি’র সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী মো. নুরুল হুদাকে আহব্বায়ক এবং আইইবি’র সম্মানী সহকারী সাধারণ সম্পাদক (একাডেমিক ও আন্তর্জাতিক) প্রকৌশলী কাজী খায়রুল বাশারকে সদস্য সচিব করে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন, আইইবি’র কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য প্রকৌশলী হামিদুল হক, প্রফেসর ড. প্রকৌশলী মুনাজ আহমেদ নুর, আইইবি’র সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. হাবিবুর রহমান, আইইবি’র যন্ত্রকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. প্রকৌশলী মো. আব্দুর রশিদ সরকার, আইইবি’র তড়িৎকৌশল বিভাগের সদস্য ড. প্রকৌশলী ইয়াছির আরাফাত এবং কেমিক্যালকৌশল বিভাগের সদস্য ড. প্রকৌশলী ইয়াছির আরাফাত খাঁন। উক্ত কমিটিকে আগামী ৭ দিনের মধ্যে আইইবি’র সম্মানী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী খন্দকার মনজুর মোর্শেদের নিকট জমা দিতে বলা হয়েছে।
একই ঘটনায় পৃথক তদন্ত কমিটি করেছে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। অতিরিক্ত সচিব ফজলুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের এই কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। ২৮ মার্চ বনানীতে এফআর টাওয়ার পরিদর্শনে এসে তিনি এই কমিটির কথা জানান।
তিনি আরো জানান, তার মন্ত্রণালয়ের গঠিত এই কমিটিতে আরো একজন অতিরিক্ত সচিববে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে। এছাড়া তদন্ত কমিটিতে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ঢাকা জেলা প্রশাসন, বুয়েট ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে একজন করে প্রতিনিধি নেয়া হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)’র পক্ষ থেকেও ঘটনার তদন্তের কথা জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার মো: আছাদুজ্জামান মিয়া। তিনি ২৯ মার্চ বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত হবে। তবে এই তদন্তে ডিএনসিসি, রাজউক ও বুয়েটকে সম্পৃক্ত করা হবে। তিনি ডিএনসিসিকে নগরীর মাথা আর ডিএনসিসি’র মেয়রকে নগরীর পিতা উল্লেখ করে বলেন, মেয়রের নেতৃত্বেই আমরা কাজ করবো। তিনি তাৎক্ষনিকভাবে পুড়ে যাওয়া ভবনের আশপাশে যে কোন একটি ছাউনির ব্যবস্থা করে তদন্ত কাজ দেখভাল করার জন্য নির্দেশ দেন। একই সাথে বুয়েটের চূড়ান্ত ছাড়পত্র ছাড়া ভবনটি ব্যবহার না করারও পরামর্শ দেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম শক্তিশালী কমিটির মাধ্যমে দুর্ঘটনার সঠিক তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন। ২৯ মার্চ সকাল ১১ টায় এফআর টাওয়ার পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আমরা আর কোন কথা বলতে চাই না। তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করে আমরা এখন এ্যকশনে যেতে চাই