রাজধানীর বনানীতে কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে দমকল বাহিনী। রাতে একপর্যায়ে মৃতের সংখ্যা ২৫ উল্লেখ করলেও তা ১৯-এ নামিয়ে আনে সংস্থাটি। ঘটনাস্থলে স্থাপিত ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে দুবার এই দুই ধরনের তথ্য দেয়া হয়। ফলে কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
রাজধানীর বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের ১৭ নম্বর রোডে বহুতল ভবন এফআর টাওয়ারে গতকাল বৃহস্পতিবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
রাত সোয়া ৮টায় আগুন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। উদ্ধারকর্মীদের আগে থেকেই আশঙ্কা ছিল ভবনের ভেতরে লাশ থাকতে পারে। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেখানে লাইটের ব্যবস্থা করে উদ্ধারকর্মীরা ভবনের ভেতরে ঢোকেন। সেখানে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখেন লাশ। কোনটি আগুনে পুড়ে গেছে। কোনটি অর্ধ পোড়া। আর কয়েকটি অক্ষত; হয়তো শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গেছেন।
সেলিম নামের এক উদ্ধারকর্মী বলেন, রাত সোয়া ৮টার দিকে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ভেতরে ঢোকার মতো অবস্থা হয়। আগুন তখন নিয়ন্ত্রণে। তারপরেও বিভিন্ন পয়েন্টে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দিয়ে তারা পানি ছিটিয়ে যাচ্ছিলেন। উদ্ধারকর্মীরা ওর ভেতরেই ভবনের মধ্যে প্রবেশ করেন। এ সময় বেশ কিছু লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। এক এক করে লাশগুলো নামিয়ে আনতে শুরু করেন তারা।
রাতে যাদের লাশ উদ্ধার হয় তাদের অনেকের চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে।
বেলা ১টার দিকে এফ আর টাওয়ারের ৯ তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে ফায়ার সার্ভিস। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ করে। পাশাপাশি বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যরা আগুন নিভানোর কাজ করেন। বিকেল ৫টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে ফায়ার সার্ভিস জানায়।
এফআর টাওয়ারে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিস ও ব্যাংক। গার্মেন্টে বায়িং হাউজ ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অফিস, বিক্রয় কেন্দ্র, রেস্তোরাঁ এবং একটি কনভেনশন সেন্টার রয়েছে ওই ভবনে। এ ছাড়া তৃতীয় তলায় রয়েছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের একটি শাখা। সেসব প্রতিষ্ঠানে কত মানুষ কাজ করেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।
বিকেলে বনানী থানার ওসি ফরমান আলী আগুনে সাতজনের প্রাণহানি হয়েছে বলে জানান। তারা হলেন পারভেজ সাজ্জাদ (৪৭), আমেনা ইয়াসমিন (৪০), মামুন (৩৬), শ্রীলঙ্কার নাগরিক নিরস চন্দ্র, আবদুল্লাহ আল ফারুক (৩২), মাকসুদুর (৬৬) ও মনির (৫০)।
ঘটনায় স্থাপিত বনানী থানার কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয়, আমেনা মারা গেছেন অ্যাপোলো হাসপাতালে, পারভেজ সাজ্জাদ বনানী ক্লিনিকে, নিরস চন্দ্র কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে এবং মামুন, মাকসুদুর ও মনির ইউনাইটেড হাসপাতালে। এ ছাড়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন আবদুল্লাহ আল ফারুক। নিহত অন্যান্যের পরিচয় এখনও জানা যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী, ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানায়, বেলা ১টার দিকে ভবনের নবম তলায় হঠাৎ আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুনের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়তে থাকে ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে। ভবনে এ সময় শত শত লোক অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আগুন ও ধোঁয়া দেখে আতঙ্কিত লোকজন প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটি শুরু করে। কেউ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকেন, কেউ ছাদে চলে যান। কিন্তু সময় যত গড়াতে থাকে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় ভবনটি। ফলে শত শত লোক আটকা পড়ে ভবনের মধ্যে। আগুনের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার খবরে হাজার হাজার লোক জড়ো হয় সেখানে। এ সময় আগুন থেকে বাঁচতে কয়েকজন ভবন থেকে লাফ দেন। নিচে পড়ে যাওয়ার পর তাঁদের উদ্ধার করেন উপস্থিত লোকজন। আগুনের খবর শুনে স্বজনেরা এসে উপস্থিত হন ঘটনাস্থলে।
খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি অগ্নিনির্বাপক গাড়ি ছুটে আসে। কিন্তু কোনোভাবেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসছিল না। পর্যায়ক্রমে ফায়ার সার্ভিসের ২০ অগ্নিনির্বাপক গাড়ি যোগ দেয় আগুন নেভানোর কাজে। একই সাথে যোগ দেয় বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে আটকেপড়াদের উদ্ধার ও আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ক্রেন লেডার (যন্ত্রচালিত মই) নিয়ে আসা হয়।
টাওয়ারের ১৪-তলার একটি প্রপার্টিজ অফিসের কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন সাংবাদিকদের জানান, আগুনের খবর পেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু ততক্ষণে সিঁড়িতেও ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। পরে ১৪-তলা থেকে ছাদে গিয়ে পাশের আওয়াল সেন্টারে চলে যান। সেখান থেকে নেমে আসেন তিনি।
ঘটনাস্থলে আহাজারি করা ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, তার ছেলে ফাহাদ ইবনে কবীর এই ভবনে কাজ করত। ছেলে ফোন করে তাকে জানায়- আগুনের ধোঁয়ায় তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এরপর আর কথা হয়নি তার সাথে।
ভবনের সামনে উদ্বিগ্ন লোকদের ভিড়ের মধ্যে মহিউদ্দিন নামের একজন জানান, তার ভাই মোতাহার ১৪ তলায় একটি বায়িং হাউজে কাজ করেন। বেশ কয়েকজন সহকর্মীর সাথে তিনি ভেতরে আটকা পড়ে আছেন। ফোনে ভাইয়ের সাথে তার কথাও হয়েছে।
ধোঁয়ার কারণে উদ্ধার কাজে সমস্যা : বেলা ২টার পর আগুনের তীব্রতা কিছুটা কমে এলেও ধোঁয়ার কারণে আটকেপড়াদের উদ্ধারে বেগ পেতে হয়। ৩টার পর থেকে আটকেপড়াদের উদ্ধার কাজ শুরু হয়। তাদের বেশির ভাগ ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য তাদের রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে নেয়া হয়। উদ্ধার কাজে অংশ নেয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মী মোস্তাফিজ বলেন, আমরা লেডার নিয়ে আটকেপড়াদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। তবে প্রচণ্ড ধোঁয়ায় কাজ করতে বেগ পেতে হয়েছে। বেলা ৩টার দিকে তিনি জানান, এখনো ভেতরে আটকে পড়া অনেককে হাত বাড়িয়ে সাহায্য চাইতে দেখা যাচ্ছে। আমরা চারটি লেডার নিয়ে কাজ করছি। বেলা ৩টার পর ফায়ার সার্ভিসের মই দিয়ে ১২ তলার কাচ ভেঙে কয়েকজনকে বের করে আনা হয়। তখনো অষ্টম তলায় দেখা যাচ্ছিল আগুনের শিখা। ভবনের সামনে জড়ো হওয়া জনতার অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের দেরির কারণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে বেশি।
হাত বাড়িয়ে উদ্ধারের আকুতি : টাওয়ারের বিভিন্ন তলার জানালা থেকে হাত বাড়িয়ে উদ্ধারের আকুতি জানাতে দেখা গেছে আটকে পড়া লোকদের। সেজুতি স্বর্ণা নামের একটি ফেসবুক ওয়াল থেকে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যায় লোক একজন বলছেন, আমাদের জন্য সিঁড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তা না হলে ধোঁয়ায় আমরা মারা যাব। আরেকটি ভিডিওতে তিনি জানালা দিয়ে নিচের রাস্তা দেখিয়ে বলছেন, আমরা ভেতরে আটকা।
উদ্ধারকর্মী আকরাম হোসেন জানান, ভবনের আট তলা থেকে একটি মেয়ে তাকে ধরে নামার চেষ্টা করছিল। তখন হাত ফসকে সে মাটিতে পড়ে যায়। এর পরপর আরো দুইজন পুরুষ পড়ে যায়। তিনি নিজে এই তিনজনকে সেখান থেকে উদ্ধার করেন। মেয়েটার পুরো শরীরে কাচ লেগে ছিল বলে জানান আকরাম।
বাঁচতে ভবন থেকে লাফ : আগুন থেকে বাঁচতে বেশ কয়েকজন লাফ দিয়েছেন। ভবন থেকে লাফ দিয়ে গুরুতর আহত হন শ্রীলঙ্কার নাগরিক। পরে কুর্মিটোলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। একইভাবে লাফ দিয়ে হাত- ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বেশ কয়েকজন।
ভবনে ছিল না ফায়ার ফাইটিংয়ের ব্যবস্থা : ভবনটি বাইশতলা হলেও এতে ছিল না ফায়ার ফাইটিংয়ের কোনো ব্যবস্থা। ফলে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্লানিং) সিদ্দিক মো: জুলফিকার আহমেদ এ কথা জানান। সন্ধ্যার পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি আগুন ৯৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলেও জানান।
জুলফিকার আহমেদ বলেন, বিল্ডিংগুলোতে যতদিন পর্যন্ত আগুন নির্বাপণের নিজস্ব সক্ষমতা না থাকবে, ততদিন এ ধরনের দুর্ঘটনা হতেই থাকবে। আর হতাহতের সংখ্যাও বাড়তে থাকবে।