একের পর এক পাবলিক পরীক্ষা আর সৃজনশীল ব্যবস্থার কারণে অভিভাবকদের কয়েক গুণ শিক্ষা ব্যয় বেড়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হতে কোচিং প্রাইভেট আর নোট গাইডের আদৌ কোনো প্রয়োজন হতো না একসময়। এমনকি সাধারণ আয়ের অনেক অভিভাবক এসএসসি, এইচএসসি পর্যন্ত তাদের সন্তানদের কোচিং প্রাইভেটের কথা ভাবতেই পারতেন না।
অনেক শিক্ষার্থী বিশেষ করে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট প্রয়োজন হতো না। কিন্তু বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণীতে ওঠার সাথে সাথে প্রায় সব অভিভাবক হন্যে হয়ে ছুটছেন সন্তানকে কোচিংয়ে ভর্তি করানোর জন্য। এর একমাত্র কারণ পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা। সমাপনী পরীক্ষার কারণে শহরের অনেক অভিভাবক চতুর্থ শ্রেণীতে থাকা অবস্থাতেই কোচিংয়ে ভর্তি করান।
রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরের অনেক অভিভাবক পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি মাসে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করেন কোচিং প্রাইভেট বাবদ। অনেকের ব্যয় এর চেয়েও বেশি। অভিভাবকেরা জানিয়েছেন, সমাপনী পরীক্ষা না থাকলে তারা তাদের পঞ্চম শ্রেণী পড়–য়া সন্তানদের নিয়ে এতটা উদ্বিগ্ন হতেন না এবং কোচিং প্রাইভেটের কথাও চিন্তা করতেন না। একইভাবে অষ্টম শ্রেণীর জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা ঘিরেও কয়েক গুণ ব্যয় বেড়েছে অভিভাবকদের।
সন্তানদের পাবলিক পরীক্ষা ঘিরে কোচিং প্রাইভেটের পেছনে ছোটার আরেকটি কারণ হলো সৃজনশীল পদ্ধতি আর জিপিএ ৫ প্রতিযোগিতা। অনেক অভিভাবক জানিয়েছেন, যত টাকা লাগুক তারা খরচ করতে রাজি; কিন্তু জিপিএ ৫ কোনো অবস্থাতেই তারা মিস করবেন না। এটি অনেকের জন্য একটি প্রেসটিজ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। সন্তান নিয়ে তারা তীব্র মানসিক যুদ্ধে লিপ্ত। বর্তমানে জিপিএ ৫ না পাওয়া অনেকের জন্য আত্মীয়, পরিচিতজন এবং সমাজের কাছে তীব্রভাবে হেয় হওয়ার শামিল।
অনেকে সন্তানের জিপিএ ৫ নিশ্চিত করার জন্য যত খুশি টাকা খরচ করার সামর্থ্য থাকলেও অনেকের আদৌ সে সামর্থ্য নেই। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে স্বল্প আয়ের অনেক লোকজনও পঞ্চম শ্রেণীতে ওঠার সাথে সাথে কোচিং প্রাইভেটের দ্বারস্থ হচ্ছেন। অনেকের কোচিং প্রাইভেট তো দূরের কথা সন্তানের জন্য গাইড কেনারও সামর্থ্য নেই। কিন্তু পরিবারের অনেক প্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে তারাও বাধ্য হচ্ছেন গাইড, টেস্ট পেপারসহ বিভিন্ন খাতে টাকা খরচ করতে।
রাজধানীর উত্তর গোড়ানের বাসিন্দা রিদুল বলেন, আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বল্প বেতনে চাকরি করি। আমার তিন সন্তান। একজন পঞ্চম শ্রেণীতে আরেকজন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। বাসাভাড়া আর পরিবারের জন্য খাবার কিনতেই মাস শেষ হওয়ার আগে অনেক সময় বেতন শেষ হয়ে যায়। ছেলেমেয়ে অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখানোর কোনো সামর্থ্যও আমরা রাখি না।
এভাবে অনেক প্রয়োজনীয় খাতে আমরা টাকা খরচ করতে পারি না। কিন্তু আমার স্ত্রী বছরের শুরু থেকে বলে আসছে পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়েকে কোচিংয়ে ভর্তি করানোর জন্য অথবা বাসায় প্রাইভেট টিউটর রাখার জন্য। আমি কোনো অবস্থাতেই রাজি নই। কারণ আমার সে সামর্থ্য নেই। আমার মেয়েকে পড়াত আমার স্ত্রী; কিন্তু কোচিং প্রাইভেট না দেয়ায় সে আর পড়াবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে অনেক ঝগড়াবিবাদ চলছে দীর্ঘ দিন ধরে। অবশেষে আমি বাধ্য হয়েছি কোচিংয়ে দিতে। এ জন্য মাসে আমার দুই হাজার টাকা করে খরচ হচ্ছে।
রিদুল জানান, সমাপনী পরীক্ষা আর জিপিএ ৫ না থাকলে আমার এই অতিরিক্ত খরচের দরকার হতো না এবং সংসারে অশান্তিও সৃষ্টি হতো না। কোচিংয়ের পেছনে টাকা খরচ করায় সংসারে টানাটানি আরো বেড়েছে। এখন অনেক সময় ঠিকমতো প্রয়োজনীয় খাবারও কিনতে পারি না পরিবারের জন্য।
খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা আলতাফ হোসেন বলেন, আমার মেয়ে এবার পঞ্চম শ্রেণীতে উঠেছে। আমার স্ত্রী অনেক দিন ধরে বলে আসছে কোচিংয়ে ভর্তি করানোর জন্য। আমি রাজি হয়নি। কিন্তু আমার আপত্তি উপেক্ষা করে আমার স্ত্রী নিজেই আমার মেয়েকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে কোচিংয়ে। আমি বলেছি যা ইচ্ছা তাই করো। আমি এর সাথে নেই।
আর্থিকভাবে নিতান্ত অসহায় ছাড়া পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে কিন্তু কোচিং বা প্রাইভেটের দ্বারস্থ হচ্ছে না দেশে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা বর্তমানে খুবই কম। আর কোচিং প্রইভেটের সামর্থ্য না থাকলেও একাধিক গাইড ও টেস্ট পেপার কেনা থেকে রক্ষা নেই কারোরই। অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষই এসব কেনার জন্য অভিভাবকদের বাধ্য করে।
অপর দিকে একসময় নবম-দশম ও একাদশ শ্রেণীতে যারা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ত তাদের প্রায় সবাই প্রাইভেট পড়ত শিক্ষকদের কাছে। বিজ্ঞান বিভাগে লেখাপড়া প্রাইভেট নির্ভরতার কারণে স্বল্প আয়ের বা দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা সাধারণত মানবিক বিভাগ বেছে নিত নবম শ্রেণীতে। ফলে এসএসসি থেকে শুরু করে মাস্টার্স পর্যন্ত কোনো শেণীতেই কোনো বিষয়ে তাদের প্রাইভেট পড়ার প্রয়োজন হতো না।
এর কারণ তখনকার শিক্ষাব্যবস্থা ও পরীক্ষাপদ্ধতি। কিন্তু বর্তমানে সে সুযোগ আর নেই। বর্তমান শিক্ষা ও পরীক্ষাপদ্ধতির কারণে সবাইকেই কম বেশি কোচিং প্রাইভেটের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায় থেকে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে তো কথাই নেই তা যে বিভাগেই হোক না কেন। পঞ্চম শ্রেণীর মতো অষ্টম শ্রেণীতেও পাবলিক পরীক্ষা আর জিপিএ ৫ প্রতিযোগিতার কারণে সামর্থ্যবানেরা কোচিং প্রাইভেটের পেছনে ছুটছেন।
অপর দিকে সৃজনশীল ব্যবস্থার কারণেও তারা কোচিং প্রাইভেট-নির্ভর হতে বাধ্য হচ্ছেন। মুখস্থ প্রবণতা আর কোচিং প্রাইভেট ও গাইড-নির্ভরতা কমানোর নামে সৃজনশীল ব্যবস্থা চালু করা হলেও মূলত এ পদ্ধতিই এখন কোচিং প্রাইভেট আর গাইড ব্যবসার নতুন এক দুয়ার খুলে দিয়েছে। বর্তমানে সৃজনশীল মানেই হলো গাইড-নির্ভরতা আর কোচিং প্রাইভেট।
শুধু সৃজনশীল পদ্ধতি নয়, পাঠ্যবইও আগের তুলনায় অনেক কঠিন এবং জটিল করা হয়েছে বলে জানান অভিভাবকেরা। বাড়ানো হয়েছে বইয়ের সংখ্যা। এত বেশি বই যে, গণিত, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন কঠিন বই পড়ার জন্য এক মাসও ভাগে পায় না একজন শিক্ষার্র্থী। আর এত কঠিন বই একজন শিক্ষার্থী এক মাসেরও কম সময়ে কিভাবে আয়ত্ত করতে পারবে? এর কারণেও তারা কোচিং প্রাইভেট-নির্ভর হতে বাধ্য হচ্ছে।
আগে ষষ্ঠ শ্রেণীতে মাত্র ছয়টি বই পাঠ্য ছিল। এর সাথে বাংলায় একটিমাত্র গল্পের বই ছিল; কিন্তু বর্তমানে ষষ্ঠ শ্রেণীতে সরকারিভাবেই ১৪টি বই পাঠ্য করা হয়েছে। এর বাইরে বিভিন্ন স্কুল থেকে আলাদা করে বাংলা ও ইংরেজি গ্রামার বই পাঠ্য করেছে। রয়েছে প্রতিটি বিষয়ে একাধিক গাইডের বোঝা। এত পড়ার বোঝা শিশুরা বইতে পারছে না বলে জানান অনেক অভিভাবক।
অভিভাবকেরা জানিয়েছেন, কোচিং প্রাইভেট আর গাইড ছাড়া বর্তমানে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার কথা কল্পনাও করা যায় না। আর এ কারণে বেড়েছে শিক্ষা খাতে অভিভাবকদের ব্যয়। যেসব পরিবারে দুই থেকে তিনজন সন্তান লেখাপড়ার সাথে যুক্ত তাদের অবস্থা শোচনীয় বলে জানিয়েছেন অনেকে। রাজধানীতে সন্তানদের লেখাপড়ার পেছনে খরচ হয়ে যাচ্ছে অনেকের আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ। ব্যয় বৃদ্ধির তুলনায় তাদের আয় না বাড়ায় জীবনমান নিম্নমুখী হচ্ছে তাদের।
গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে বিভিন্ন জিনিসের দাম। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে সমাপনী পরীক্ষা আর ২০১০ সাল থেকে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর পর থেকে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ। সন্তানদের লেখাপড়ার পেছনে অধিক খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন স্বল্প আয়ের লোকজন।