সরকারের প্রত্যাশা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছে না বৈদেশিক অনুদান। কিন্তু ব্যয় না কমে ক্রমেই বেড়েই চলছে। এর পরেও একের পর এক প্রকল্প অনুমোদন করছে। ফলে বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থান না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণনির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে নগদ টাকার সঙ্কটে থাকা ব্যাংকগুলো পড়েছে মহাবিপাকে। ব্যাংকারেরা জানিয়েছেন, এমনিতেই নগদ টাকার সঙ্কট, এর ওপর সরকারের ঋণ গ্রহণের হার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি বিনিয়োগ আরো সঙ্কোচিত হয়ে যাচ্ছে। ফলে এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানের ওপর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নিট ঋণ নিয়েছে তিন হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে বরং পরিশোধ করা হয়েছিল ৮ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে ছয় মাসে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে প্রকৃত ঋণ নেয়া হয়েছে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা। আর বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে ২৬ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৪ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। ফলে ছয় মাসে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে ২৯ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ছয় মাসে সরকারের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ বেড়েছে ১৩ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা, যা শতকরা ৮৫ দশমিক ৩৯ ভাগ।
বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ঋণ নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তুওই সময়ে কাঙ্ক্ষিত হারে অবমুক্ত হয়নি বিদেশী ঋণ। আবার কাক্সিক্ষত হারে এ সময়ে রাজস্ব আদায় হয়নি। যেমন, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল মাত্র ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ২০ শতাংশের ওপর।
কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় না হলেও সরকারের ব্যয় থেমে ছিল না, বরং নির্বাচনকে সামনে রেখে ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। আর এ জন্যই ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে। ঋণনির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে গেছে ঋণ পরিচর্যাব্যয়ও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শঙ্কার বিষয় হলো সরকারের ঋণ নেয়ার ভুল নীতির কারণে জাতির ঘাড়ে দেনা বেড়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প ব্যাংকঋণ থেকে নেয়া হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকসহ দাতাসংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিলে যেখানে দীর্ঘ সময়ের গ্রেস পিরিয়ড পাওয়া যায়, সেই সাথে সুদ হার থাকে ১ শতাংশেরও কম। বলা চলে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের নিচে ঋণ পাওয়া যায়। কিন্তু এসব প্রকল্পের ব্যয় মেটানো হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো এসব ঋণের বড় একটি অংশ মেটানো হচ্ছে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিয়ে। সঞ্চয়পত্রে সুদহার যেখানে সাড়ে ১১ শতাংশ, সেখানে ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সুদ পরিশোধ করতে হয় ক্ষেত্রবিশেষ ৬ শতাংশের নিচে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ছয় মাসে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে যেখানে ২৯ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা, এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র থেকেই ঋণ নেয়া হয়েছে ২৪ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বিশেষ করে সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি হারে ঋণ নেয়ায় সরকারের সামগ্রিক সুদব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বলা চলে জাতীয় বাজেটের বড় একটি অংশ চলে যাচ্ছে সরকারের সুদ পরিশোধে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সরকারের যে পরিমাণ ব্যয় বেড়ে গেছে সেই হারে আয় বাড়েনি। এতেই সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের ব্যয় মেটাতে গিয়ে আর্থিক ব্যবস্থাপনা বেশ চাপে পড়েছে। যার ফলে ঋণ গ্রহণ বেড়ে গেছে।
মূলত, সরকারের আয়ের প্রধান খাত হলো রাজস্ব আহরণ ও বৈদেশিক অনুদান। কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আহরণ হচ্ছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রাজস্ব আদায় বেড়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২০ দশমিক ১৭ শতাংশ। এ থেকে দেখা যায়, সরকারের রাজস্ব আদায় কমে গেছে।
রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণগ্রহণ বেড়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণগ্রহণ বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়ে যাবে। এতে জনভোগান্তি বেড়ে যাবে। পাশাপাশি নানামুখী চাপে পড়বে অর্থনীতি। অপর দিকে ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর খেলাপিঋণ বেড়ে গেছে। ফলে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণগ্রহণ বেড়ে গেলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আরো কমে যাবে, যা কর্মসংস্থানের বাধা সৃষ্টিসহ জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।