হালদায় মা রুই-কাতলার আনাগোনা, ডিম ছাড়ার পূর্বাভাস

মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক কারণে বিপন্নপ্রায় দেশের রুইজাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের অন্যতম প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে মা মাছের আনাগোনা শুরু হয়েছে। বিপন্ন হালদায় রুই-কাতলার ডিম ছাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছেন হালদা নদী নিয়ে চার দশকের অধিক সময় ধরে গবেষণারত ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মৎস্যবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী। একই সাথে হালদা ও সন্নিহিত নদীগুলোয় প্রজননক্ষম মা মাছ বাড়ানোর ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।

ড. আজাদী বলেন, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের ফলে উজানের পানি এসে হালদা নদীতে ঢল নামে। নদীতে পানির তীব্র স্রোত সৃষ্টি হয়। এর ফলে পানির তাপমাত্রা ২৭-২৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে নেমে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ডিমে তা দেয়ার উপযুক্ত হয়। ওই সময় প্রবল স্রোতের কারণে পানি ঘূর্ণনের ফলে ডিম পরিণত হয়ে ফোটে এবং পোনার জন্য অক্সিজেন প্রাপ্তি বাড়ে। এ রকম প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি হলে চলতি এবং আবহাওয়া অনুকূলে অর্থাৎ পরিমিত বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা ও স্রোত থাকলে হালদা নদীতে রুই-কাতলা চলতি বছর (২০১৯ সাল) এপ্রিল মাসের ৩ তারিখ থেকে ৮ তারিখের ভেতর প্রথমবার এবং এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখ থেকে ২৩ তারিখের ভেতর দ্বিতীয়বার ডিম দেয়ার সম্ভাবনা আছে। এপ্রিল মাসে পর্যাপ্ত ডিম না ছাড়লে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে মে মাসের ২ তারিখ থেকে ৮ তারিখের ভেতর একবার এবং মে মাসের ১৬ তারিখ থেকে ২২ তারিখের ভেতর আরেকবার ডিম দেয়ার সম্ভাবনা আছে। যদি মে মাসেও ডিম না ছাড়ে তাহলে জুন মাসের ১ থেকে ৭ তারিখের মধ্যে অথবা জুনের ১৫-২০ তারিখের ভেতর ডিম ছাড়ার শেষ সম্ভাবনা আছে। এ সময় অনুযায়ী ডিম আহরণকারীদের কুয়া নির্মাণসহ নৌকা এবং অন্যান্য ডিম ধরার সরাঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। ডিম ধরার একটি দলকে দুই ভাগে ভাগ হয়ে এক দল নৌকা নিয়ে উজানে (কেরামতলী থেকে সত্তার ঘাট এলাকায়-আপস্ট্রিম) এবং আর এক দল নৌকা নিয়ে ভাটিতে (ডাউন স্ট্রিম) থাকলে ডিম যেখানে (উজান-ভাটির) ছাড়ুক না কেন, ডিম ধরা মিস হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে এবং তাতে ডিম পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে।

ড. আজাদী বলেন, মা মাছ দুই ধরনের ডিম ছাড়ে। প্রথমত নমুনা ডিম এবং পরে পর্যাপ্ত ডিম। আবহাওয়ার অনুকূলের ওপর নির্ভর করে প্রথমে অল্প পরিমাণ ডিম ছাড়ে, যাকে স্থানীয় ভাষায় নমুনা ডিম বলে। পূর্ণিমা অমাবস্যার তিথিতে পর্যাপ্ত বৃষ্টির ফলে নদীতে ঢল নেমে স্রোত বাড়লে এবং পানির তাপমাত্রা কমলে (২৭-২৯ ০ সে:) প্রচুর পরিমাণ (লার্জ স্কেল) ডিম ছাড়ে। প্রাকৃতিক অনুকূল পরিবেশ না হলে মা মাছ ডিম ছাড়ে না।

হালদা নদীতে মা মাছ এবং ডিম আহরণ হ্রাসের পেছনে প্রাকৃতিক নানা কারণের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণকে দায়ী করেন তিনি। মানবসৃষ্ট কারণের মধ্যে উজানে ফটিকছড়ির ভুজপুরে কৈয়ার ছড়া হালদা নদীর ওপর এবং হালদার উপনদী হারুয়ালছড়ি খালের ওপর নির্মিত দুইটি রাবার ড্যাম এবং হালদার উপনদী ধুরং খালের ওপর নির্মিত ওয়ের ড্যাম দিয়ে শুকনা মওসুমে (ডিসেম্বর থেকে ৩১ মার্চ) উজানে পানি আটকে ধান চাষ করায় শুকনো মওসুমে হালদা নদীর ইকোলজির পরিবর্তন সাধন দায়ী। পাশাপাশি ১৯৭৪-৭৫ এবং ১৯৮২-৮৩ সালে ভাটিতে নদীর প্রজনন এলাকার ১৬টি উপখালে ১৬টি স্লুইস গেইট দিয়ে পানি আটকে চাষাবাদ করাও হালদার বিপন্নতার কারণের মধ্যে অন্যতম। এর বাইরে মাদারী খাল, চ্যাংখালি খাল, কাটাখালি খাল, খন্দকিয়া খাল দিয়ে কলকারখানার বর্জ্য এবং নদীর দুই পাড় থেকে সরাসরি নদীতে এবং নদীর উপখালগুলোয় ব্যাপকহারে পোলট্রির বর্জ্য নিক্ষেপ করা এবং সর্বোপরি অতি-আহরণের ফলে মা মাছের সংখ্যা কমে যাওয়াকে দায়ী করেন তিনি।

প্রফেসর আজাদীর নেতৃত্বে হালদা ও হালদাসংযুক্ত চারটি নদীর (কর্ণফুলী, সাংগু, চাঁদখালী এবং শিকলবাহা চ্যানেল) পানির গুণাগুণ, হাইড্রলজি, মৎস্য এবং মৎস্য সম্পদের ওপর তিন বছরব্যাপী (২০১০-২০১৩) বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে এক গবেষণা কর্ম (স্টাডিজ অন দ্য লিমনোলজি, হাইড্রলজি, ফিশ অ্যান্ড ফিশারিজ অব দ্য রিভার হালদা অ্যান্ড ইটস ফোর লিংকড রিভারস (সাংগু, চাঁদখালী, শিকলবাহা চ্যানেল অ্যান্ড কর্ণফুলী) পরিচালিত হয়। গবেষণার আলোকে ড. আজাদী বলেন, সব রুই-কাতলা হালদার নিজস্ব আবাসিক মাছ নয়। হালদা একটি টাইডাল রিভার বা জোয়ার-ভাটার নদী। হালদার সাথে সংযুক্ত আরো চারটি জোয়ার-ভাটার নদী (সাংগু, চাঁদখালী, শিকলবাহা চ্যানেল অ্যান্ড কর্ণফুলী) রয়েছে। প্রাক-প্রজনন মওসুমে এসব নদী থেকে মাইগ্রেট করে রুই-কাতলা হালদায় ডিম ছাড়তে আসে এবং ডিম দেয়ার পর নিজ নিজ নদীতে ফিরে যায়। সরকারি গেজেট সব কয়টি নদীতে বাস্তবায়ন না হওয়ায় ওই সব নদীতে সারা বছর এবং মাইগ্রেট করে আসা-যাওয়ার পথে বছরের পর বছর নির্বিচারে মাছ ধরার ফলে মা মাছ তথা ব্র“ড ফিশ এখন অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। ড. আজাদী বলেন নতুন নতুন মানবসৃষ্ট সমস্যাবলি এবং সেই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দিন দিন হালদার প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। নদীর বাঁকগুলো কেটে দিয়ে ব্র“ড-মাছের আবাস নদীর কুমগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। প্রজনন এলাকায় নদীর খালগুলোর মুখে রয়েছে ১২টি স্লুইস গেট। এগুলো অধিকাংশ অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে।
নদীর গভীরতা বাড়ানো এবং স্রোত সৃষ্টির জন্য অকার্যকর স্লুইস গেটগুলো তুলে দেয়া একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজন ভরাট হয়ে যাওয়া হালদার উপনদীগুলো খনন করে পূর্বের গভীরতা ফিরিয়ে আনা। এতে মাছের আবাস পুনঃস্থাপন হবে। অন্যদিকে নানান দূষণে মা মাছের ডিম ছাড়ার পরিবেশকে বিপন্ন করে তোলা হয়েছে।

দেশের রুইজাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহের অন্যতম প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে নদীটিকে বাঁচাতে নানামুখী সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু হালদার জন্য বরাদ্দকৃত এই বিপুল পরিমাণ অর্থের কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। এমনকি হালদা যাদের জীবিকার উৎস সেই স্থানীয় জেলে এবং জনগণের চাওয়া এবং নানামুখী উদ্যোগেও হালদাকে বাঁচানো যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, নদীর প্রাকৃতিক কারণেই হালদায় আবারো বাঁক তৈরি হবে। তিনি এসব বাঁকগুলো রক্ষার পরামর্শও দিয়েছেন। তিনি বলেন, আইন করে লুপ কাটিং (বাক) নিষিদ্ধ করতে হবে। হালদার মেজর কার্পের স্টক এসেসমেন্ট ও মাইগ্রেটরি রুট জানা, সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য একান্ত প্রয়োজন। মার্ক অ্যান্ড রিক্যাপার (ট্যাগিং) প্রক্রিয়ায় তা করা যেতে পারে। তিনি অনাগত ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে হালদা স্টক মেজর কার্প লুপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষায় প্রাকৃতিকভাবে তৈরি একটি হালদা ব্র“ড ব্যাংক এবং একটি জিন ব্যাংক অত্যন্ত জরুরি বলে জানান।

ড. আজাদীর মতে আবাসিক এবং শিল্প বর্জ্য দূষণ থেকে নদীকে বাঁচাতে এখনই দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া একান্ত জরুরি। ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে বর্জ্য শোধন করার পরামর্শ তার। পোলট্রির বর্জ্য যাতে নদীতে না ফেলে সে জন্যে আইন তৈরি করতে হবে। তা ছাড়া অতি-আহরণের ফলে কমে যাওয়া ব্রুড (মা মাছ) মাছের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এর পদক্ষেপ হিসেবে হালদাসহ হালদাসংযোগ চারটি নদীতেও হালদার পোনা থেকে তৈরি সাব-এডাল্ট কার্প মাছ প্রতিবছর স্টক করা একান্ত জরুরি মনে করেন তিনি।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top