এমন স্নিগ্ধ নদী কাহার?
ওথায় এমন ধুম্র পাহাড়?
কোথায় এমন হড়িৎ ক্ষেত্র
আকাশ তলে মেশে?
এমন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায়
বাতাস কাহার দেশে
প্রকৃতির লীলাক্ষেত্র আমাদের এ রূপসী বাংলাদেশ। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়, জলপ্রপাত, বনভূমি এদেশকে করে তুলেছে অপূর্ব রূপময়।এছাড়াও বাংলাদেশের কিছু পাহাড়-পর্বত ছাড়া সমগ্র বাংলাদেশ এক বিশাল বদ্বীপ। অর্থাৎ, সমভূমি অঞ্চল।
আয়তনঃ বাংলাদেশ এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এ দেশ ২০° ৩৪’ উত্তর অক্ষরেখা থেকে ২৬° ৩৮’ উত্তর অক্ষরেখার মধ্যে এবং ৮৮°০১’ পূর্ব দ্রাঘিমারেখা থেকে ৯২° ৪১’ পূর্ব দ্রাঘিমারেখার মধ্যে অবস্থিত। বাংলাদেশের মাঝামাঝি স্থান দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশের আয়তন ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ছাড়া সারা দেশটির চারপাশ ঘিরে রেখেছে ভারত।
বাংলাদেশের নদনদীঃ নদী মাতৃক দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ একটি ছোট্ট আয়তনের সবুজ শ্যামলে ঘেরা একটি দেশ। যার সর্বোত্র ছোট-বড় অসংখ্য জলাশয় জালের মত ছড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ১৯৯৬-৯৭ সালের তথ্য অনুসারে দেখা যায়, বাংলাদেশের নদী অঞ্চলের আয়তন ৯,৪০৫ বর্গ কিলোবাইট। বাংলাদেশের নদীর সংখ্যা প্রায় ৭০০। আর নদীবহুল দেশ বলে স্বাভাবিকভাবেই এ দেশের মানুষের জীবনযাত্রার ওপর নদীর প্রভাব রয়েছে। পদ্মা, বহ্মপুত্র, যমুনা মেঘনা ও কর্ণফুলী বাংলাদেশের প্রধান নদী। এ নদীগুলোর উপনদী ও শাখানদী রয়েছে। উপনদী ও শাখানদী সহ বাংলাদেশে নদীর মোট দৈর্ঘ্য হল প্রায় ২২,১৫৫ কিলোমিটার। এ সকল নদনদী এর সমভূমি অঞ্চলকে করেছে শস্য শ্যামলা ও অপরুপ সৌন্দর্যের অধিকারী। প্রকৃতি যে কি আশ্চর্য সুন্দর তা বাংলাদেশের প্রতিটি ঋতুকে দৃষ্টিতে লক্ষ না করলে বুঝা যায় না। তাই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এদেশে যুগে যুগে এসেছেন বহু পর্যটক, কবিরা লিখেছেন কবিতা। কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ভাষায়—
“পদ্মা যমুনা মধুমতি আর
মেঘনার মালা কন্ঠে পরি,
দাঁড়ায়ে রয়েছে সুজলা যে দেশ
সেই দেশে বাস আমরা করি।”
ভূ-প্রকৃতিঃ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রূপ, লাবণ্যের কথা বলে শেষ করা যায় না। যতই বলি মনে হয় যেন কম বলা হয়েছে। এদেশের অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চিরকাল ধরে মুগ্ধ কবিচিত্তে কাব্যস্রোত বইয়ে দিয়েছে—
ভাবুকের হৃদয়ে অনির্বচনীয় ভাবের ঢেউ জাগিয়েছে। বাংলাদেশে যে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে যে কোন দিকেই দৃষ্টিপাত করি না কেন চোখ দুটো প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে ধন্য হয়, মনপ্রাণ আনন্দে ভরে ওঠে। কি পাহাড় টিলার রমনীয় শোভা, কী গাছপালা ও তৃণমূল শোভিত বনের মনোরম দৃশ্য, কী কলনাদিণী নদনদীর অপরূপ সৌন্দর্য, কী শ্যামল শোভাময় ফসলের ক্ষেত সবই এদেশে সুন্দর ও অনুপম । বাংলাদেশের প্রকৃতির এরূপ সৌন্দর্য দেখেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছেন—
“ধনধান্যে পুষ্পেভরা আমাদের এই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে এছে দেশ এক-সকল দেশের সেরা;
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা;
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমা,
সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।”
বাংলাদেশে এমন কোন স্থান নেই যেখানে সৌন্দর্যের এতটুকু ভাটা পড়েছে। সাগর রাতদিন তার পা ধুয়ে দিচ্ছে, নদী তার কটিদেশ ও গলায় মেঘলা ও চন্দ্রহারের মতো শোভা পাচ্ছে, মাঠের শ্যামলিমা তাকে শাড়ির মতো ঘিরে রেখেছে এবং সবুজ বনরাজি তার শিড়ে মুকুট পরিয়ে দিয়ে রানীর সাজে সাজিয়েছে। চট্টভূমি থেকে বরেন্দ্রভূমি পর্যন্ত সবখানে এ রূপের জোয়ার উতলে উঠেছে— কোথাও এতটুকু কমতি নেই।
বর্ষার পরে আসে শরৎকাল। তখন গ্রীষ্মের তীব্রতা কিছুটা কমে আসে। শরতের চাঁদনী রাতে কি বনের গাছ-পালা, কী নদী তীরের কাশবন, কী গৃহস্থের কুটির, কী গতিশীল নদীস্রোত নতুন নতুন রূপে আমাদের চোখে ধরা দেয়। নানা রকমের ফুল ফোঁটে। শরতের শেষে কিছুটা শীতের আমেজ শুরু হয়। এর ফঁকে চলে আসে হেমন্তকাল। সোনালি ধানে মাঠ ভরে যায়। ফসলের সওগাত গৃহস্থের ঘরে ঘরে তুলে দিয়ে ধরনী এক সময় রিক্ত হয়। তখন আসে শীতকাল। সে সময় বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। তীব্র শীত অনুভূত হয় এবং শ্যামল প্রকৃতি যেন বুড়োদের মতো শীর্নমূর্তি ধারন করে। এরপর একটা সময় আসে যখন শীত ও গ্রীষ্মের মিশ্র আমেজ অনুভূত হয়। আসে বসন্তকাল । গাছ-পালা ও তরুলতায় নতুন পাতা গজায় এবং বিচিত্র রঙের ফুল ফুটে। প্রকৃতি যেন নতুন সৌন্দর্যে তার যৌবন ফিরে পায়।
ঋতু প্রকৃতি: বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ছয়টি ঋতুতে প্রকৃতির ছয় রকম অবস্থা দেখা যায়। গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশের প্রকৃতি হয়ে ওঠে এক উদাসীন সন্ন্যাসীর মতো। তার রুক্ষ রৌদ্রের দাবদাহে মানবজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এ সময়ে কালবৈশাখি তার উদ্দামতা নিয়ে আসে। গ্রীষ্মের পর আসে বর্ষা। বর্ষায় এ দেশের প্রকৃতিতে যেন নতুন করে প্রানের সঞ্চার হয়। তখন প্রকৃতি হয়ে ওঠে সজীব ও সতেজ। ফসল ভরা ক্ষেতগুলো দেখলে মনে হয় আবহমান। ধানসিঁড়ির সমুদ্র। তখন মনে হয় প্রকৃতি যেন তার সমস্ত গ্লানি মুছে ফেলে। চাঁদনী রাতের শোভা তখন বড়ই মনোলোভা মনে হয়। কবি তাই বলেন-
“চাঁদনীর সাথে প্রতি রাতে রাতে
গোলা সোনা রং ঢালে যে
খুব মনোচোর শরতের ভোর
আলোছায়া ঋতু বড়সে।”
শরতের শেষে, শীতের আগে আসে হেমন্ত ঋতু। এ সময় সোনালী ফসলে ভরা থাকে মাঠ-ঘাট। আর সোনালি ধানের শীষে যখন বাতাসের খেলা চলে তখন বাংলার নিসর্গে স্বর্গের ছোঁয়া লাগে। হেমন্তের পর শুষ্ক শীতল চেহারা নিয়ে আসে শীত। এ সময়ে প্রকৃতি বিবর্ন ও বিষন্ন হয়ে পড়ে। শীতের শেষে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। গাছপালা তখন সজীব হয়ে ওঠে। গাছে গাছে নতুন পাতা গজায় নতুন নতুন ফুল ফোঁটে।
বিভিন্ন দৃশ্য: বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান দেশ । তার প্রত্যেকটি গ্রাম যেন প্রকৃতির এক অপূর্ব রঙ্গশালা। যেদিকে চোখ যায়- অবারিত সবুজ মাঠ, ফুলেফলে ভরা গাছপালা, তৃন গুল্মশোভিত বন-বনানী ও শ্যামল শস্যেক্ষত- এই অনুপম রূপসুধা পান করে সকলের হৃদয়ে এক অভিনব আনন্দের শিহরন জাগে। কোথাও প্রকৃতির সবুজ ঘোমটা ভেদ করে পাকা শস্যের সোনালি সুন্দর মুখখানা বের হয়ে আসছে, আবার কোথাও বিশালদেহ বটবৃক্ষ প্রান্তরের এক স্থানে উধ্বর্বাহু হয়ে মৌন তাপসের মত দাঁড়িয়ে সুশীতল ছায়া দিয়ে পথিকের ক্লান্তি দুর করছে । কোথাও তালগাছ এক পায়ে দাড়িঁয়ে আকাশ থেকে নীলিমা ছিনিয়ে আনার জন্যে ওপর দিকে হাত বাড়িয়েই চলছে, আবার কোথাও দীঘির কাকচক্ষু কালো পানিতে লাল সাদা শাপলা ও কুমুদ ফুঁটে অপরূপ সৌন্দর্য বিস্তার করছে। বাংলাদেশের এই সৌন্দর্য বৈচিত্র্য সবার মন আনন্দে ভরে দেয়।
অবশেষে বলব বাংলাদেশ ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ। ষড়ঋতুর খেলা চলে এদেশে। প্রত্যেক ঋতুতে এদেশে নতুন নতুন রূপ ধারন করে। নতুন আনন্দ আর সৌন্দর্যে আমাদের মন ভরিয়ে দেয়া। বাংলাদেশের মতো মনোরম প্রকৃতিক সৌন্দর্য পৃথিবীর আর কোন দেশে নেই। তাই কবি বলেছেন-
“সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।
সার্থক জনম মাগো, তোমায় ভালবেসে।”
সম্প্রতি আমি গ্রামে গিয়েছিলাম। আমি আমার জীবনের প্রথম ট্রেনে উঠেছিলাম। আমি, আমার মা, আমার ছোট দুই বোন, আমার খালা এবং আমার বড় মামা আমারা সকাল ৬:০০টায় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দ্যেশে রওয়ানা হলাম। সেখানে গিয়ে আমরা নির্ধারিত ট্রেনে উঠে বসলাম। আমি বসেছিলাম জানালার কাছে। ট্রেনটি ৭:১৫ মিনিটে ছেড়েছিল। ট্রেনটি ছিল অনেক বড়। ট্রেনটি খুব জোড়ে চলছিল। জানালা দিয়ে প্রচন্ড বাতাস আসছিল। ভোরের বাতাসকে আমি বেশ উপভোগ করলাম। শহরের কিছু পুরাতন ও কিছু নতুন ও মন মোহনীয় কিছু স্থানের পাশ দিয়ে ছুটল ট্রেনটি। ট্রেনটি ঝকঝক আওয়াজ তুলে ও হর্ণ বাজিয়ে বিকট গর্জন তুলে ছুটছে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। ধীরে ধীরে ট্রেনটি শহর পেরিয়ে গ্রামে চলে এলো। আবহাওয়া ছিল অনেক ভাল। উপরে পরিষ্কার আকাশ, নিচে সবুজ শ্যামলা সুন্দর ও মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ৯ ঘন্টা পর আমরা গ্রামে এসে পৌঁছালাম। আমার গ্রামের বাড়ি লক্ষীপুর জেলার গুপিনাথপুর গ্রাম। তবে আমরা প্রথমে উঠি আমার নানাবাড়িতে সাহ্পুর গ্রামে। প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য আমাকে এতটাই মুগ্ধ করেছে যে, ক্লান্ত হয়ে আছি যে, তা ভুলেই গিয়েছিল। রাতের বেলায় দেখলাম প্রকৃতির আরেক রূপ ও রঙ। রাতের আকাশ চাঁদের আলোয় আলোকিত করে ফেলে। চাঁদের আলোয় রাতের বাঁশঝাড় ও গাছপালা গুলো অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল। সুন্দর বাতাস বইছিল। অপূর্ব সুন্দর লাগছিল। দিনের বেলা কৃষাণীরা শীতল পাটি তৈরী করে এবং ধান ভানে, রোদে শুকায়। যে দিকে তাকাই সবুজের সমারোহ। প্রকৃতি যেন অপূর্ব সাজে সজ্জিত হয়ে আছে। প্রকৃতি যেন শ্যামলের সিংহাসন করে বসে আছে। আমরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে গিয়েছিলাম । এক এক জায়গায় এক এক রূপ বৈচিত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার দুই ধারে খেজুর গাছ, নারকেল গাছ মাথা উঁচু করে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় যেন এরা এখানকার চিরন্তর প্রহরী। পথিকদের স্বাগতম জানাচ্ছে। অতঃপর আমাদের ছুটির দিন শেষ হয়ে এল। আমরা বাসে করে ঢাকায় ফিরলাম। বুঝতে পাড়লাম বাংলাদেশ শুধু সুন্দর নয়, অপূর্ব, অতূলনীয় ও অসাধারণ সুন্দর।