কুখ্যাত জগৎশেঠের কুকর্ম

কুখ্যাত জগৎশেঠের নাম জানেন না, এমন শিক্ষিত লোক ভারতবর্ষে একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। নবাব সিরাজউদ্দৌলা, মীর জাফর এবং জগৎশেঠ- এ তিনটি নামের ত্রিমাত্রিক রসায়নে ইতিহাসের অন্যতম বেদনাবিধুর এবং চক্রান্তের রাজনীতি বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যাকে এমনভাবে সর্বনাশ করে দিয়েছিল, যার কারণে পুরো ভারতবর্ষকে ২০০ বছর ধরে ব্রিটিশদের গোলামি করে ইতিহাসের দায় শোধ করতে হয়েছিল। পলাশী যুদ্ধপূর্ব সময়ে বাংলার অর্থনীতি ছিল ভারতবর্ষের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট। অন্য দিকে, পুরো ভারতবর্ষ ছিল তামাম দুনিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নততর ও শ্রেষ্ঠতম। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমল থেকে শুরু করে ১৭৫৭ সাল অবধি অর্থাৎ দুই হাজার বছরের অধিক সময় ধরে যে ভারতবর্ষ অর্থবিত্ত, জ্ঞানগরিমা, শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে সারা দুনিয়ার কাছে অনুসরণীয় ছিল, যেই ভূখণ্ডটি একজন জগৎশেঠ এবং তার চেলাচামুণ্ডাদের কারণে যে অন্ধকার যুগের মধ্যে পড়ে যায়, তা থেকে আজ অবধি আমরা কেউই বের হয়ে আসতে পারিনি।

ভারতবর্ষের পরাধীনতা তথা বাংলার ভাগ্যবিপর্যয়ের প্রসঙ্গ তুললে সবাই একবাক্যে পলাশীর যুদ্ধের নির্মম প্রহসনের কথা বলে থাকেন। অন্য দিকে পলাশীর কথা বলতে গেলে সবাই একবাক্যে মীর জাফর আলী খানকে বিষোদগার করেন এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন। অথচ পলাশীর ট্র্যাজেডি-পূর্ব এবং তৎপরবর্তী ঘটনার প্রধান হোতা বা নাটের গুরু জগৎশেঠ সম্পর্কে আমরা খুব কমই আলোচনা করি। একজন লোভী, দুশ্চরিত্র ও ধান্ধাবাজ ব্যবসায়ী রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিজের তাঁবেদার বানিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়তে গিয়ে প্রথমে পুরো বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দেয়া এবং পরবর্তীকালে সেই পথ অনুসরণ করে পুরো ভারতবর্ষের স্বাধীনতা হরণের যে ঘটনা ঘটেছে, তার দ্বিতীয় নজির মহাকালের ইতিহাসে নেই। ফলে ইতিহাসের নির্মম বিচারে জগৎশেঠ নামটি আবু জেহেল, আবু লাহাব ইত্যাদি নামের মতোই ঘৃণিত ও পরিত্যাজ্য বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। অর্থাৎ পলাশীর নির্মম ঘটনার পর আজ অবধি কোনো পিতামাতা তার আদরের সন্তানের নাম জগৎশেঠ রেখেছে, এমন খবর আমার জানা নেই।

এখন প্রশ্ন হলো- জগৎশেঠ কেন এত ঘৃণিত হলেন! এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপের আগে জগৎশেঠের পরিচয় এবং তৎকালীন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজনীতি নিয়ে দু-চারটি কথা বলা দরকার। ব্যক্তি জগৎশেঠ সম্পর্কে যত দূর জানা যায়, তাতে প্রতীয়মান হয়- তিনি তার জীবৎকালে সমগ্র ভারতবর্ষ এবং ভারতের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যকারী দেশ, জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বজনপরিচিত এবং প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি সমসাময়িক দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ব্যাংকব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। হুন্ডি, টাকা পাচার, টাকা লগ্নি, বাট্টা ইত্যাদি কাজ করার জন্য ভারতবর্ষ, মধ্য এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য প্রভৃতি অঞ্চলের বাণিজ্য রুট, বন্দর এবং রাজধানীগুলোতে জগৎশেঠের ব্যাংকের শাখা বিস্তৃত ছিল।

তিনি জাতিতে মাড়োয়ারি হলেও তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের কেন্দ্রভূমি ছিল তৎকালীন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদ। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর ভারতবর্ষের সর্বত্র দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের আধিপত্য ক্রমান্বয়ে শিথিল থেকে শিথিলতর হতে থাকে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের ঘনিষ্ঠ সুবেদার তথা প্রাদেশিক গভর্নরেরা যার যার মতো স্বাধীনভাবে রাজকার্য চালাতে আরম্ভ করলে দিল্লির সিংহাসনে আসীন আওরঙ্গজেব-পরবর্তী মোগল সম্রাটেরা তা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন। ফলে দিল্লির নামমাত্র কর্তৃত্ব স্বীকার করে প্রাদেশিক গভর্নরেরা প্রথমে যে যার মতো চলতে আরম্ভ করলেন এবং পরবর্তীকালে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত আরম্ভ করে দিলেন। ফলে বাংলা থেকে দাক্ষিণাত্য ও অরুণাচল থেকে কাবুল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্ষমতার পালাবদল এবং বহিরাগত শক্তির নাক গলানোর পাশাপাশি রাজ দরবারগুলোতে জগৎশেঠের মতো ধুরন্ধর ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বহুগুণ বেড়ে গেল।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে তার নাতি আজিমউসসান যখন বাংলার গভর্নর ছিলেন, তখন সম্রাট তার বেহিসেবি এবং উচ্ছৃঙ্খল নাতির কর্মকাণ্ডের লাগাম টেনে ধরার জন্য সুবেদার মুর্শিদকুলি খানকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। মুর্শিদকুলি খান ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ, অতিশয় বিচক্ষণ এবং ব্যতিক্রমী রাজ আনুগত্যের প্রতীক। তিনি বাংলা থেকে এত বিপুল পরিমাণ রাজস্ব দিল্লিতে পাঠাতে লাগলেন, যা না হলে হয়তো দিল্লি সালতানাতে বিদ্রোহ দেখা দিত। রাজস্ব আদায় এবং তা যথানিয়মে দিল্লিতে প্রেরণ নিয়ে মুর্শিদকুলি খানের সাথে শাহজাদা আজিমউসসানের বিরোধ দেখা দিলে তিনি সম্রাটের পরামর্শে অর্থ মন্ত্রণালয় ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুর্শিদকুলি খান অনেকটা স্বাধীনভাবে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। ১৭০৭ থেকে ১৭১৭ সাল পর্যন্ত তিনি দিল্লির তৎকালীন মোগল সম্রাট প্রথম বাহাদুর শাহ, জাহান্দার শাহ এবং ফররুখ শিয়ারের নামমাত্র অধীনতা স্বীকার করেন এবং ১৭১৭ সালে নিজেকে নবাব ঘোষণা দিয়ে স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা আরম্ভ করেন।

মুর্শিদকুলি খান প্রথমে দেওয়ান বা অর্থমন্ত্রী, তারপর সুবেদার বা গভর্নর এবং শেষে নবাব হিসেবে বাংলা শাসন করেন প্রায় ২৭ বছর। এই ২৭ বছরে বাংলা প্রদেশ সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে ধনসম্পদ, সুশাসন, সামরিক শক্তিমত্তা, বৈদেশিক বাণিজ্য তথা রফতানি এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাপকাঠিতে উল্লেখযোগ্য সুনাম ও সমৃদ্ধি অর্জন করে। মুর্শিদকুলি খানের মৃত্যুর পর তার জামাতা সুজাউদ্দিন বাংলার সিংহাসনে বসেন ১৭২৭ সালে। তিনি অত্যন্ত উঁচু মার্গের ভালো মানুষ এবং সুশাসক ছিলেন। কোনো রকম ঝক্কিঝামেলা ছাড়াই তিনি তার শ্বশুরের রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যে সুশাসন অক্ষুন্ন রেখে রাজ্য পরিচালনা করেন ১৭৩৯ সাল অবধি। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র সরফরাজ খান নবাব হন মাত্র এক বছরের জন্য। সরফরাজ খানের তারুণ্য ও অদক্ষতার সুযোগ নিয়ে তার সেনাপতি আলিবর্দী খান বাংলার মসনদ অধিকার করেন ১৯৪০ সালে।

আলিবর্দী খান অত্যন্ত দক্ষ শাসক, ব্যতিক্রমী সামরিক প্রতিভা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। তিনি মুর্শিদকুলি খান ও নবাব সুজাউদ্দৌলার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার পাশাপাশি রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জনজীবনে সর্বাধিক নিরাপত্তা বিধান করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফলে ১৭৫৬ সালে তার মৃত্যুর পর তিনি তার তরুণ দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলার জন্য যে রাজ্য রেখে গেলেন সেটির জৌলুশ, সামরিক শক্তিমত্তা, রাজভাণ্ডারের টইটম্বুর অবস্থা এবং রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক জীবনে সুখশান্তি ও স্থিতিশীলতার সাথে তুলনা করা যায়, এমন কোনো রাজ্য ভারতবর্ষ তো দূরের কথা- এশিয়ার কোথাও ছিল না।

বাংলার উল্লিখিত স্বর্ণযুগে দেশ-বিদেশের বেনিয়ারা সদলবলে এ দেশে আসতে থাকেন। ইউরোপ, আরব, মধ্য এশিয়া, চীন, পারস্য প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা এসে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা অঞ্চলে তাদের বাণিজ্যিক কুঠি স্থাপন করতে থাকলেন। অন্য দিকে, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, মোহনচাঁদের মতো ধুরন্ধর মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা দক্ষিণ ভারত ছেড়ে বাংলায় এসে স্থায়ী বসতি স্থাপন শুরু করেন। জগৎশেঠ গং টাকা রোজগার করতে করতে একসময় ধনসম্পদের আধিক্যের কারণে প্রকৃতির অভিশাপের কবলে পড়েন। প্রকৃতির সাধারণ নিয়ম হলো- মানুষ যথাযোগ্য পরিশ্রম করে অর্থবিত্ত অর্জন করবে এবং সেই অর্থ নিজের জন্য এবং অপরের জন্য হিতকর উপায়ে খরচ করবে। কোনো মানুষ যদি বিনা পরিশ্রমে অর্থবিত্ত লাভ করে, তবে তারা কৃপণ ও অলস হয়ে যায়। তাদের ধৈর্য-সহ্য শক্তি কমে যায় এবং সমাজ সংসারের সবাইকে সে সন্দেহের চোখে দেখে। অন্য দিকে, যারা অবৈধভাবে বেশুমার অর্থবিত্ত হাসিল করে তারা স্বাভাবিক মানবিক গুণাবলি হারিয়ে ফেলেন। কেউ কেউ মানসিক বৈকল্য অথবা বিকৃত রুচির কবলে পড়ে নিজেকে পৃথিবীর জন্য ভয়াবহ জন্তুতে পরিণত করে ফেলেন।

জগৎশেঠের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তাকে একজন বিকৃত রুচির ভারসাম্যহীন পাষণ্ড বলেই মনে হয়। ধারণা করা হয়, তিনি তার পৈতৃক নিবাস গুজরাট ত্যাগ করে বাংলায় এসেছিলেন নবাব আলিবর্দী খানের শাসনামলের প্রথম দিকে। রাজ আনুকূল্য এবং বাংলার ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের কারণে জগৎশেঠের অর্থবিত্তের পরিধি সীমানা অতিক্রম করে এমন অবস্থায় পৌঁছে, যা সমসাময়িক দুনিয়ায় বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। তার ধনলিপসার সাথে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করা এবং বাংলার সিংহাসনকে তাঁবেদার বানানোর স্বপ্ন দিনকে দিন বাড়তে থাকে। নবাব আলিবর্দী খাঁর আমলে জগৎশেঠরা টুঁ-শব্দটি করতে পারেননি নবাবের কঠোর অনুশাসন, দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব এবং বিচক্ষণতার কারণে। আলিবর্দী খানের মৃত্যুর পর তার তরুণ দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা যখন নবাব হলেন, তখন জগৎশেঠদের লোভ রীতিমতো লালসায় পরিণত হলো। তারা তরুণ নবাবকে নিজেদের ইচ্ছেমতো পুতুলের মতো ব্যবহার করে নিজেদের লুটেরা মনোবৃত্তি চরিতার্থ করার অপচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। পরবর্তীকালে তারা একজন ব্যক্তিত্বহীন, স্বার্থপর, বিবেকহীন কাপুরুষের সন্ধান করতে গিয়ে মীর জাফরকে পেয়ে যান এবং তাকে কেন্দ্র করে দেশ-জাতির সর্বনাশ করার চক্রান্ত আরম্ভ করেন।

জগৎশেঠের ইতিহাস সম্পর্কে আজকের নিবন্ধে আমি আর বিস্তারিত আলোচনায় যাবো না। কারণ, ১৭৫৬ থেকে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধের দিন পর্যন্ত বাংলার তৎকালীন রাজনীতিতে জগৎশেঠরা কী কী করেছিলেন তা আমরা কমবেশি সবাই জানি। পলাশী-পরবর্তী সময়ে জগৎশেঠদের কী ধরনের নির্মম ও করুণ পরিণতি হয়েছিল, তা-ও অনেক পাঠক জানেন। কাজেই ওসব বিষয় আলোচনা না করে জগৎশেঠদের চরিত্র নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করব। জগৎশেঠদের মতো চরিত্রহীন ব্যবসায়ী নামধারী দুর্বৃত্তরা যেমন অতীতকালে ছিলেন, তেমনি বর্তমান জমানাতেও রয়েছেন। এই শ্রেণীর লোকদের কোনো স্থান-কাল-পাত্র নেই; নেই কোনো বিশেষ ভাষা বা ধর্ম।

তাদের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো- তারা প্রথমে কিছু দিন ব্যবসা-বাণিজ্য করে বিত্তবৈভব অর্জন করে। তারপর টাকা ও ক্ষমতার লোভে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে নির্লজ্জ, বেহায়া ও বেপরোয়া হয়ে পড়েন। তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য রাজনীতির কেন্দ্রস্থলের মূল চরিত্রে অভিনয় করার জন্য পাপেট বা পুতুল জাতীয় শাসকরূপী মীর জাফর তৈরি করার জন্য সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেন। পরবর্তীকালে নিজেদের কাক্সিক্ষত মীর জাফর পাওয়া গেলে বা পয়দা হলে তারা রাষ্ট্রক্ষমতা ও রাজভাণ্ডার উভয়টি বগলদাবা করে নারকীয় তাণ্ডব শুরু করে দেন।

যুগ-যুগান্তরের রাজনীতির সাথে জগৎশেঠদের রয়েছে বহুমাত্রিক রসায়ন। এই রসায়নের কারণে কখনো-সখনো মীর জাফরেরা তাদের পাপেট রাজনীতি মঞ্চায়িত করার জন্য চেষ্টা-তদবির করে সমাজ-সংসারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বড় শয়তান-মেঝো শয়তান ও ছোট শয়তানরূপী জগৎশেঠদের কুড়িয়ে এনে সিংহাসনের আশপাশে জায়গা করে দেন। তারপর তাঁবেদার জগৎশেঠদের সহযোগিতায় দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ লুট, জনগণের আমানত লুট এবং ব্যবসা-বাণিজ্য কুক্ষিগত করে নিজেদের ঔরসজাত সন্তানসন্ততি, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের মধ্যে মীরন, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ ও মোহাম্মদী বেগের মতো দুরাচার সৃষ্টি করে ফেলেন। এই শ্রেণীর মীর জাফরেরা তাদের পালিত জগৎশেঠদের লেলিয়ে দিয়ে বিদেশী বেনিয়ারূপী দানবদের নিজ দেশে ঢুকিয়ে তাবৎ ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি কাজকর্ম, ব্যাংক-বীমা, অবকাঠামো উন্নয়ন, গৃহায়ন ও গণপূর্তের মতো স্পর্শকাতর সিভিল কনস্ট্রাকশনের পাশাপাশি অর্থভাণ্ডার ও অস্ত্রভাণ্ডারের কর্তৃত্ব ও চাবিকাঠিও বিদেশীদের হাতে তুলে দেন।

জগৎশেঠ এবং মীর জাফর যেন একই বৃত্তের দুটো ফুল। তাদের পারস্পরিক লেনদেন, মহব্বত ও সোহবত যেন হংস-মিথুনের রসায়ন সৃষ্টি করে। তাদের চিন্তা-চেতনা-আত্মার মিল দেখেই কবি-সাহিত্যিকেরা ‘হরিহর আত্মা’ নামের বাগধারা রচনা করতে পেরেছেন। তারা একই সাথে বেড়ে ওঠেন- একই সাথে ভোগবিলাসে মত্ত হন এবং খোদায়ি গজবে একই পরিণতি ভোগ করে ভবলীলা সাঙ্গ করেন। তাদের তিরোধানের পর জাতীয় জীবন, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থায় এমন বীভৎস বিপর্যয় নেমে আসে, যার কারণে সব মানুষ, জন্তু-জানোয়ার এবং বৃক্ষলতা তাদের অভিসম্পাত করতে থাকে। ফলে জগৎশেঠ ও মীর জাফরেরা কিয়ামত পর্যন্ত জমিনে মানুষের ঘৃণা-অভিশাপ এবং বিরক্তির বিমূর্ত উপলক্ষ হিসেবে অমরত্ব লাভ করেন।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top