আরব বিশ্ব জুড়ে কি নতুন এক ‘আরব বসন্তের’ পদধ্বনি শুরু হয়েছে? তিক্ত ব্যর্থতার মধ্যে সিরিয়ার রক্তঝরা আরব বসন্ত পরিসমাপ্তির দিকে এগোচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। এর মধ্যে আলজেরিয়ার ৮২ বছর বয়সী পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রেসিডেন্ট আবদুল আজিজ বুতেফ্লিকা আরেক দফা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাওয়ায় দেশটির সর্বস্তরের জনগণ রাস্তায় নেমেছে। প্রতিদিনই সেখানে বিক্ষোভ হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান ও দমনের অযোগ্য অহিংস এই ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে বুতেফ্লিকা ঘোষণা দিয়েছেন, তার যুগের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। তিনি আর প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবেন না। ডিসেম্বর পর্যন্ত এ নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে নবনির্বাচিতের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন তিনি।
বুতেফ্লিকার অঙ্গীকার ও ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’
তবে বুতেফ্লিকার এই অঙ্গীকারে আস্থা রাখতে পারছেন না আলজেরিয়ার মানুষ। ২০১১ সালে আরব বিশ্বজুড়ে ‘বসন্ত’ শুরু হলে আলজেরীয় জনগণ বুতেফ্লিকা শাসনের অবসানের দাবিতে রাজপথে নেমেছিলেন। তখন বুতেফ্লিকা পরের নির্বাচনে আর প্রার্থী হবেন না বলে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, দেশটিতে স্থিতি আনতে তিনি একগুচ্ছ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন। প্রতিশ্রুত সংস্কারের খুব সামান্যই তিনি বাস্তবায়ন করেছেন। ২০১৩ সালে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার পরও তিনি আরো এক মেয়াদে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়ে ৭৪ শতাংশ ভোট পেয়ে নিজেকে নির্বাচিত ঘোষণা করেন। এবার যখন তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর সরে দাঁড়ানোর কথা বলেন, মানুষ মিথ্যাবাদী রাখালের বাঘ আসার গল্পের মতো আর তার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না।
আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়া আব্দুল আজিজ বুতেফ্লিকা ২৬ বছর বয়সেই দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকারী মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্য ছিলেন তিনি, যে বাহিনী ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে দেশকে স্বাধীন করার পর রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীতে রূপ নিয়েছিল। বুতেফ্লিকা সেনাপ্রতিষ্ঠান ছেড়ে রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণে যোগ দিলেও সামরিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা এবং ব্যবহার, দুটোই তিনি করেছেন। ’৯০-এর দশকের শুরুতে বহুদলীয় নির্বাচনের প্রথম পর্বে ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট জয়লাভ করার পর নির্বাচন বাতিল এবং ইসলামিস্ট দমনে দশকব্যাপী সেনাবাহিনীর অভিযানের সময়ে বুতেফ্লিকাকে ফ্রান্সে নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে এনে শাসক দলের নেতৃত্বে বসানো হয়। এরপর বুতেফ্লিকার এক সর্বাত্মকবাদী শাসন যুগের সূচনা হয়। বহু দলের মোড়কে কার্যকর একদলীয় শাসনের নতুন আমল শুরু হয় তখন থেকে।
আরব দেশগুলোর মধ্যে একেক সময় একেকটি বৃহৎ বা আঞ্চলিক শক্তির প্রভাব বলয় তৈরি হতে দেখা যায়। সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক হিসেবে আলজেরিয়ায় প্রভাব ছিল ফ্রান্সের। এই বৃহৎ শক্তি তার প্রভাব বজায় রাখার ক্ষেত্রে আলজেরিয়ার সেনাবাহিনীকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল নেয়। আর এই সেনাবাহিনী স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকেই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে বিশেষ ভূমিকা।
সুদানিরা কেন সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে?
সুদানের ওমর আল বশিরও বুতেফ্লিকার মতো জনবিক্ষোভের তরঙ্গ মোকাবেলা করছেন। এর মধ্যে তিনি ক্ষমতাসীন দলের চেয়ারম্যানের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন এবং এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছেন, যা তার সংসদ অনুমোদন করেছে ছয় মাস বাদ দিয়ে।
সুদানে ইতোমধ্যে কে সামনে আসবেন তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে ভেতরে ভেতরে। মিডলইস্ট আইয়ের এক রিপোর্ট অনুসারে, ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান ইয়োসি কোহেন সুদানের সম্ভাব্য উত্তরসূরি নির্ধারণ নিয়ে এক তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনার সাথে যুক্ত হয়েছেন। সুদানি গোয়েন্দা প্রধান সালাহ গোশে গত মাসে জার্মানিতে মোসাদের প্রধানের সাথে এই গোপন আলোচনা চালিয়েছেন। এ সময় ওমর আল বশিরকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে ইসরাইলের উপসাগরীয় মিত্ররা তাকে প্রেসিডেন্ট পদে উন্নীত করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এই আলোচনা করেন বলে সুদানের সেনাবাহিনী সূত্রের বরাত দিয়ে মিডলইস্ট আইয়ের রিপোর্টটিতে বলা হয়।
সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সহায়তায় মিসরীয় মধ্যস্থতাকারীদের পরিচালিত সভা মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সের সাইড লাইনে সুদানের জাতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সার্ভিসের (এনআইএসএস) প্রধান গোশে ইয়াসি কোহেনের সাথে আলোচনা করেছেন। সৌদি আরব, আমিরাত ও মিসরীয়রা গোশেকে ‘তাদের লোক’ হিসেবে দেখে থাকেন।
সরকারবিরোধী বিক্ষোভের কয়েক মাস পরই বশিরের পর ক্ষমতায় আসার জন্য খার্তুমে নেপথ্য লড়াই চলছে। অনেকে মনে করছেন, বশিরের তিন দশকের শাসনের অবসানের সূচনা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, বশিরকে ক্ষমতাসীন দল ও সেনাবাহিনী থেকে সরে যেতে হবে। বড় প্রশ্ন হলো- ক্ষমতার এ লড়াইয়ে এর পরে কে আসবেন?
মিউনিখের গোশে এবং কোহেনের মধ্যে ‘অভূতপূর্ব’ বৈঠক সম্পর্কে বশির অবগত ছিলেন না। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল, গোশেকে বশিরের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হিসেবে তুলে ধরার পরিকল্পনায় মার্কিন সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য ইসরাইলকে সামনে নিয়ে আসা। ইসরাইলকে আয়োজকেরা তাদের সহযোগী হিসেবে দেখেন, যে ওয়াশিংটনের দরজা খুলে দিতে পারে।
গোশে ওয়াশিংটনে সুপরিচিত যিনি ২০০০-এর দশকে একটি গুপ্তচর বাহিনীর প্রধান হিসেবে সেখানে কাজ করেছিলেন। সিআইএ আলকায়েদার বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসের যুদ্ধ’ কর্মসূচিতে তার সাথে কাজ করেছে বলে মনে করা হয়। ২০০৫ সালে সুদান যখন সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্র হিসেবে তালিকাভুক্ত ছিল তখনো আমেরিকা ভ্রমণে তার কোনো সমস্যা হয়নি। গত সপ্তাহে আফ্রিকার গোয়েন্দা ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় থাকতে না পারলে সিআইএ বশিরের পছন্দের উত্তরাধিকারী হিসেবে তাকে চিহ্নিত করেছে।
ওমর আল বশির এ ব্যাপারে পাল্টা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন কি না তা স্পষ্ট নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের তিনি পদোন্নতি প্রদান করেন এবং প্রেসিডেন্টের ডিক্রি দ্বারা জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগ করে তার কর্তৃত্বকে জোরদার করার চেষ্টা করেছেন। দেশব্যাপী প্রতিবাদ বন্ধ করার জন্য এটি ছিল তার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা। খার্তুমে সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির নেতার পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করবেন এবং ২০২০ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেবেন না। এর পরই বশির তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল আওয়াদ ইবনুকে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ করেন। তিনি দেশের ১৮টি প্রদেশের গভর্নর হিসেবে ১৬ জন সেনাকর্মকর্তা এবং দু’জন এনআইএসএস কর্মকর্তা নিযুক্ত করেছেন। তিনি নবনির্বাচিত উপনেতা আহমেদ হারুনকে পার্টির নেতৃত্ব দেন।
এসব ঘটনায় একটি বিষয় স্পষ্ট যে, সুদানে নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়তোবা আসন্ন। এই পরিবর্তনে সৌদি, আমিরাত ও মিসরের পছন্দের ব্যক্তি ক্ষমতায় এলে আঞ্চলিক ভারসাম্য ভেঙে পড়তে পারে। বশির সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্ক ও কাতারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছিলেন। লিবিয়ার গৃহযুদ্ধেও দেশটির একটি ভূমিকা ছিল। কিন্তু অতি সম্প্রতি তিনি সৌদি আরব ও মিসরের ঘনিষ্ঠতা অর্জন করতে চাইছেন বলে মনে হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি ক্ষমতায় থেকে যেতে চাইতে পারেন অথবা নিজের উত্তরাধিকারীর হিসেবে পছন্দের ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা দিতে চাইতে পারেন। তবে সুদান সৌদি বলয়ে বেশি ঝুঁকে পড়ুক- এটা আঞ্চলিক শক্তি ইরান আর তুরস্ক চাইবে না।
সুবিধাভোগীর ভূমিকা সেনাবাহিনীর!
মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোতে সেনাবাহিনীকে একটি বিশেষ ভূমিকা দেয়ার ব্যাপারে একটি গোপন কৌশল অনেক দিন ধরেই কাজ করছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দু’পক্ষই যার যার পক্ষে এই কৌশল কাজে লাগিয়েছে। বিশ্বরাজনীতিতে রাশিয়া-চীন যুক্তরাষ্ট্রের একক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার পর পুরনো প্রবণতা এখন ফিরে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে এই কৌশলকে বিশেষভাবে সামনে এগিয়ে নেয়ার বিষয়টি দেখা যাচ্ছে। সৌদি আরব মুসলিম দেশগুলোর সমন্বয়ে যে নিরাপত্তা জোট গঠন করেছে সেটি ছিল এই কৌশলের একটি অংশ। মুসলিম দেশগুলোর ক্ষমতার পরিবর্তনে সেনাপ্রতিষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। মিসরে সিসিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করার বিষয়টি মুরসির ক্ষমতা আরোহণে সৌদি আরবের প্রধান শর্ত ছিল। মুরসিকে বিদায় করার সামরিক অভ্যুত্থানে সেই সিসিকে ব্যবহার করেছে সৌদি আরব ও ইসরাইল।
২০১১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মিসরে সেনাবাহিনী যে ভূমিকা নিয়েছিল, তেমন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা সেনা প্রতিষ্ঠান পালন করতে পারে সুদান ও আলজেরিয়া উভয় দেশে। মিসরীয় সেনাবাহিনী প্রথমে বিপ্লবের দিকে নত হয়ে মোবারককে সরিয়ে দেয়। তাহরির স্কোয়ারের ইসলামপন্থী ও উদারপন্থী উভয়কেই তাদের পক্ষে থাকার প্রতিশ্রুতি সেনাবাহিনী। মাঝে মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও পালন করেছে তারা।
মিসরীয় সেনাবাহিনী সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের ভাগ্যে কী ঘটছে, না ঘটছে তার ওপর নজর রাখা বন্ধ করে দেয়নি। আরব বসন্তের দুই বছর পার হওয়ার পরও বাশার আল আসাদ ইরান ও হিজবুল্লাহ বাহিনীর সহায়তায় সেখানে ক্ষমতায় ছিলেন। মিসরীয় সেনাবাহিনী সবুজ সঙ্কেত এবং সৌদি আরব ও আরব আমিরাত থেকে অর্থ পাওয়ার পর মুরসির বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের মহড়া দিয়ে মিসরের স্বল্পকালীন গণতন্ত্র পরীক্ষাটির অবসান ঘটায়।
১৪ আগস্ট ২০১৩ সালে কায়রোতে রাবা গণহত্যার এক সপ্তাহ পর, আসাদ দামেস্কের চারপাশে বিরোধী পক্ষের নিয়ন্ত্রিত শহরতলিতে ৩০০ থেকে ১৭০০ জন লোককে হত্যা করেন। এই কাজে মিসরের ঘটনার যোগসূত্রতা নিছক কাকতালীয় ছিল না। রাশিয়া দাবি করেছে, হামলা চালানো হয়েছিল সত্যি, কিন্তু রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদ ধ্বংস করার জন্য সিরিয়ার একটি চুক্তির প্রয়োজন ছিল বলে সেটা করা হয়েছে। এ চুক্তিটি বহুবার ভাঙা হয়েছে, কিন্তু বাকি দশকের ‘গল্প নির্মাণে’ এটি একটি ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
হয় ‘আমাদের’ নিয়ন্ত্রণ নতুবা অরাজকতা
আরব জাগরণের পর রাশিয়ান বোমাবর্ষণ, ইরানি মিলিশিয়ার আক্রমণ অথবা উপসাগরীয় রাজাশাসিত রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা যে মোড়কে যেদিন থেকে প্রতিবিপ্লবের প্রবাহ শুরু হয় তার সবটার মূল বার্তাটি ছিল একই রকম : ‘এটি হয় আমাদের জন্য হবে নতুবা রাষ্ট্রের পতন ঘটবে। আমাদের সরাতে চেষ্টা করলে সবার স্থান হবে ইউরোপমুখী ডিঙি।’
আলজেরিয়া ও সুদানের ঘটনায় নতুন এবং তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, সেখানকার লোকেরা এই আবর্জনা (বুতেফ্লিকা বা বশিরের) আর বহন করতে চাইছে না। ২০১১ সালে আলজেরিয়ায় আপেক্ষিক নীরবতার মধ্য দিয়ে আরব বসন্তকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। আলজেরীয়রা এক দশক ধরে গৃহযুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেছে এবং তাদের কেউই এটিকে নতুন করে কামনা করেনি।
‘আরব বসন্ত’ এক নতুন তরঙ্গ?
কিন্তু আজ সেই মেজাজ নেই। কেন আলজেরিয়া এবং সুদান এমনকি জর্দানের নতুন প্রজন্ম ১৯৯১ বা ২০১১ সালে কী ঘটেছিল তা জেনেশুনেই রাস্তায় নেমেছে? আমরা কি সত্যিই রাস্তায় জনপ্রিয় প্রতিবাদের নতুন এক তরঙ্গ দেখছি? এর উত্তর নির্ভর করবে স্বৈরাচারের আসলেই পতন ঘটবে কি না এবং সেই প্রক্রিয়াটি শান্তিপূর্ণ থাকবে কি না তার ওপর। দুই দেশেরই বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক বা উপজাতীয় গোত্রীয় রূপ নেয়নি এখনো।
যে কেউ বলতে পারেন, আলজেরীয় ও সুদানিরা রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য গণবিক্ষোভের ক্ষমতায় তাদের বিশ্বাস হারিয়েছেন কি না। কিন্তু মানুষের মৌলিক এবং রাজনৈতিক অধিকারের দাবি জানাতে জনগণ ক্লান্ত হয়ে উঠছে না। আলজেরিয়া ও সুদানে সেটিই দেখা যাচ্ছে।
বুতেফ্লিকা যে কার্ডই খেলতে চান না কেন, পথের গতিময়তা এখনো রয়ে গেছে। আর রাস্তায় সঠিক ও যাচাইযোগ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন যতক্ষণ না আসে, এটি সেখানে থাকা যুক্তিপূর্ণ। সুদান ও আলজেরিয়ার জনবিদ্রোহ বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি এবং অভিজাতদের সম্পদ লুট ও বিশেষ ক্ষমতায় সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ভোগান্তির জন্যই কেবল হচ্ছে তা নয়; বশির ও বুতেফ্লিকা উভয়ের বিদায়ের জন্যই বিশেষভাবে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
ডিসেম্বরে সংবিধান পরিবর্তন করতে উদ্যোগী হওয়ার পর নতুন সঙ্কট দেখা দেয়ার আগে সুদানে বশিরের ক্ষমতার মেয়াদ ৩০ বছর পূর্ণ হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে বুতেফ্লিকা ক্ষমতায় আছেন; আর তিনি পঞ্চম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাইছেন। দুই দেশের জনগণের পক্ষ থেকে আওয়াজ উঠেছে- ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়’।
এটি নতুন কোনো বক্তব্য নয়। মিসরীয় বিক্ষোভকারীরাও এই ‘যথেষ্ট’ শব্দটিই উচ্চারণ করেছিলেন যখন মোবারক সিংহাসনে তার পুত্র জামালকে উত্তরাধিকারী হিসেবে বসানোর চেষ্টা করেছিলেন। আর বুতেফ্লিকা বা বশিরের তুলনায় ছোট প্রজন্মের সিসি নিজের ৬৪ বছর বয়সে সাংবিধানিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ২০৩৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা করে সেই ভুলই করছেন বলে মনে হয়।
প্রতিবেশীদের স্নায়বিক চাপ
প্রশ্ন উঠতে পারে, সুদান ও আলজেরিয়ার ঘটনায় কে কে নৈরাশ্য ভরে তাকিয়ে আছে? সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মোহাম্মদ বিন সালমান তাদের একজন। আমিরাতের মুহম্মদ বিন জায়েদও একজন, যিনি আরব বসন্তের প্রতিবিপ্লবের কারিগর এবং প্রতিটি আরব দেশে জাগরণের ব্যাপারে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন।
তবে সাম্প্রতিক ঘটনায় সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ব্যক্তিটি আবদেল ফাত্তাহ সিসি নিজেই। তাকে সম্প্রতি একটি সামরিক সমাবেশে বক্তব্য রাখার সময় টেলিভিশনে স্নায়বিকভাবে বেশ আক্রান্ত বলে মনে হচ্ছিল। সিসি এ সময় বলেছেন, ‘এসব বক্তব্যের (প্রতিবাদ-বিক্ষোভের) জন্য জনগণকে মূল্য দিতে হয়।’
সিসির সিনিয়র সহযোগী, প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে চাওয়া আহমেদ শফিক ও সামি আনানকে গ্রেফতার ও কারাগারে পাঠানোর পরও বিদ্রোহের শঙ্কা দূর হয়নি মিসরে। নির্বাসিত মিসরীয় রাজনীতিবিদ আইমান নূরের মালিকানাধীন তুর্কি ভিত্তিক মিসরীয় টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আলশার্কের মিসরীয় টিভি উপস্থাপক মোয়াতাজ মাতর মিসরীয়দের উদ্দেশ করে বলেছিলেন : ‘বিশ্বাস করুন যে, আপনি মোটেই একা নন।’ ব্যাংকনোটে লেখা হয় এই বক্তব্য ব্যাপকভাবে। মাতরের সাড়া এত ব্যাপক ছিল যে, মিসরীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক স্লোগান লেখা নোট নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়। মিসরে প্রতিবাদ বিক্ষোভের সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে গেলে এটি হতো না।
২০১৫ সালে মাতরকে ‘সরকারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত’ করার জন্য, তার অনুপস্থিতিতে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। তারপর তার দুই ভাই ও তাদের স্ত্রী-সন্তান কায়রোতে ‘অদৃশ্য’ হয়ে গেছেন।
মিসরের সিসি সরকারের এসব কাজ আত্মবিশ্বাসী সরকারের কর্মকাণ্ড নয়। দুই দফায় ১৫ জনের যে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে, এটাও তেড়ে আসা ভয়ের কারণেই সিসি করেছেন বলে মনে হয়। ২০৩৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে আস্থাশীল যদি তিনি হতেন, তাহলে এসব কাজ করার কথা নয়। ডেভিড হার্স্টের পর্যবেক্ষণটি এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো। তিনি লিখেছেন, ‘সিসি আসলেই এক মৃত মানুষ, যাকে আমরা হাঁটতে দেখছি।’
মিসরের মতো দেশে কিছুতেই এই অবস্থা থাকতে পারে না। সামাজিক ও রাজনৈতিক যে শক্তি ‘আরব বসন্ত’ নিয়ে এসেছিল, দীর্ঘমেয়াদে সে শক্তিই জয়লাভ করবে। এ জন্য সময় কত লাগবে সেটিই হলো দেখার বিষয়। তবে খাবার দিয়ে বড়শিতে মাছ ধরার মতো নতুন জাগরণ কোনো ফাঁদ কি না, এ বিষয়টিও নজরে রাখা প্রয়োজন। সুদানের ঘটনা অন্তত সেই সতর্কবাণীই উচ্চারণ করছে।