র্যাগিং নামক সামাজিক ব্যাধি থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য হলে একটি নির্দিষ্ট রুম (সিট) বরাদ্দ থাকার কথা রয়েছে। হলগুলোতে সিট প্রদানের দায়িত্ব প্রশাসনের কাছে থাকার কথা থাকলেও দায়িত্বটা অঘোষিতভাবে রয়ে গেছে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের কাছে।
ফলে সিট সংকটের অজুহাতে নবীন শিক্ষার্থীদের প্রথম ৮ থেকে ১২ মাস রাখা হয় গণরুমে। দেড় থেকে দুইশত শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে থাকে ছোট রুমে। এখানে নবীন শিক্ষার্থীদের শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার নামে চলছে র্যাগিং নামক মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। মানববেতর জীবনযাপন করেও সিনিয়রদের অমানবিক নির্যাতন আর টর্চারের কথা ভয়ে স্বীকার করতে চায়ই না কেউ। ফলে প্রশাসনও ব্যবস্থা নিতে ‘পারে না’ অপরাধীদের বিরুদ্ধে।
তবে এবার সকল প্রতিবন্ধকতার বেড়াজাল ছিড়ে, ভয়ভীতির উর্ধ্বে উঠে গণরুমে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন জাবির এক শিক্ষার্থী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরেছেন র্যাগিংয়ের নামে নামে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়টি। পাশাপাশি অত্যাচারের শিকার হয়েও শিক্ষার্থীরা কেন মুখ খোলেনা সেটাও উল্লেখ করেন তিনি।
জাবিতে ‘ওপেন সিক্রেট’ র্যাগিংয়ের নামে নির্যাতনের কথা সাহস করে প্রকাশ্যে আনা শিক্ষার্থীর নাম মোঃ রাজন মিয়া। তিনি সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের ও মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে জাবির সর্ববৃহৎ গ্রুপ ‘আমরাই জাহাঙ্গীরনগর’। আর এই ফেসবুক গ্রুপেই র্যাগিংয়ের নামে নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন তিনি।
ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করা মোঃ রাজন মিয়ার লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘কিছুদিন হলো আমাদের ক্যাম্পাসে অনেক সত্যবাদী মানুষের কথা শুনতে পাচ্ছি। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটিতে পা রাখি তখন অনেক ইচ্ছা হয়েছিলো জীবনে কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু গণরুম আমার জীবনের অনেক ইচ্ছা নিয়ে গেছে। রাত অনেক হয়েছিলো ৪৫ব্যাচের ভাইয়েরা (সংঘববদ্ধ র্যাগার গ্রুপ) আমাদের ফাপর দিচ্ছিলো। তখন তারা কি একটা বলেছিলো আমাকে; আমি বুঝতে পারিনি।
তারপর আমার সাথে যা হলো তা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভুলতে পারবো না।
দুইজন ভাই একে একে ১০ থেকে ১২ টা থাপ্পড় দিয়েছিলো আমার কানে। তারপর আমি আর কানে শুনতে পারছিলাম না। একপর্যায়ে ভাইদের আমি বলি- ‘ভাই খুব লাগছে’। ভাইয়েরা তখন বলে- আজকে তোরে মেরে ফেলবো।
এভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়ার কিছু সময় পর আমাকে যখন বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেলে নেয়ার প্রস্তুতি চলছে, তখন আবার একজন ভাই আমাকে থাপ্পড় দেই। মেডিকেলে নেয়ার সময় আমাকে ‘পরামর্শ’ দেয়, ডাক্তার যদি কিছু জানতে চায় তাহলে বলবি, ‘এমনিতে ব্যাথা পাইছি’।
এরপর আমাকে ক্যাম্পাসের মেডিকেলে নেয়া হলো। সেখানকার ডাক্তার আমাকে দেখে বললেন- এখানে হবে না, সাভারের এনাম মেডিকেলে নিতে হবে। তখন আমি আরো ভয় পেয়ে গেছিলাম। পরে যখন এনাম মেডিকেলে নেয়া হয় ডাক্তার বলে,‘কানটা ফেটে গেছে ঔষধ দিয়ে দিচ্ছি, যদি ভালো না হয় তাহলে অপারেশন করতে হবে।’
এভাবে কিছুদিন গেলো। কান আর ঠিক হলো না। আবার গেলাম মেডিকেলে, ডাক্তার সেই আগের কথাই বলছে।
এর মধ্যে কিছু বড় ভাই আমাকে ডেকে বলছে, নির্যাতনের এসব কথা সাংবাদিকদেরকে বললে তাদের কিছু হবে না। আর তুই হলেও থাকতে পারবি না। আমার ডিপার্টমেন্টের এক বড় ভাই একদিন শুধু আমার সাথে গেছে ডাক্তার এর কাছে, তার পকেটের ৮০০ টাকাও খরচ হয়েছে মনে হয়। এর মধ্যে বাড়িতে গেলাম। বাড়ি গিয়ে কানে তুলা দিয়ে ঘুরি। মা-বাবা, বন্ধুরা সবাই জানতে চাই কি হয়ছে? আমি বলি- একবার পড়ে গেছিলাম, ঠিক হয়ে যাবে। তারপর কাউকে কিছু না বলে আমাদের কিশোরগঞ্জে ডাক্তার দেখালাম। ওই ডাক্তারও এনাম মেডিকেলের ডাক্তার যা বলছে তাই-ই বললো।
আবার ক্যাম্পাসে আসলাম। আসার পরে ক্লাসে যাই কানে তুলা দিয়ে। এটা যে নিজের কাছে কি কষ্টের তা বলে বোঝানো যাবে না। তারপর ডিপার্টমেন্টের শিক্ষাসফর শুরু হলো, ঐ জায়গায় গিয়েও কানে তুলা দিয়ে ঘুরতে হয়ছে আমাকে। সত্যি খুব কষ্ট হয় আমার কানটা নিয়ে, এখনো ঠিক হয় নাই আমার কানটা। কানের ভিতরে কেমন জানি একটা শব্দ হয় যার জন্য ঘুমালেও শান্তিতে ঘুমাতে পারি না। এই কানের পিছনে যে টাকার মেডিসিন গেছে আমার- তা কেবল আল্লাহ-ই জানে। কোথায় ঐ সব সিনিয়র, যারা আমার কানটা নষ্ট করে দিছে! তারা তো এখন কেউ আমার পাশে থাকে নি! আমিও একটা ছাত্র, আমার বাবার কাছ থেকেও মাস শেষে টাকা চেয়ে আনতে হয়।
কিছু বলবো না জাহাঙ্গীরনগর’কে, শুধু বলবো ক্যাম্পাসে এসে মনে হয়েছিলো অনেক কিছু পেয়ে গেয়েছি কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর মনে হয়েছিলো আমি হয়তো মারা যাচ্ছি। একটা কথা বলি সিনিয়র আমিও হয়েছিলাম। কোথায় আমি তো আমার কোনো জুনিয়রের গায়ে হাত দেই নাই। তাতে কি সম্মান করবে না আমাকে তাদের গায়ে হাত দেই নাই বলে? সম্মানটা নিতে হয় যে কোনো মানুষের কাছ থেকে সে ছোট বা বড় হোক।
কথায় আছে- শিক্ষা নাকি পরিবার থেকে নিয়ে আসে, যার পরিবার যেমন তার শিক্ষাটাও তেমন। সমস্যা নাই আমার কানটা যেমন আছে তেমন হয়তো থাকবে না। একদিন ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঐ সব সিনিয়রদের সাথে যতোই হাসি মুখে কথা বলি না কেন, তারা কোনো দিন আমার চোখে ভালো মানুষ প্রকাশ পাবে না। একজন মানুষকে কষ্ট দেয়ার আগে নিজের ব্যাপারে ১০০বার ভাবা দরকার।
সবশেষে বলি- অনেকে বলবেন ঐ সময় কেনো এঘটনা প্রকাশ করি নাই। তখন প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কয়েকজন বড় ভাই আর শিক্ষক এর কথা শুনে ভয় পেয়ে গেছিলাম। যার জন্য সাহস করে বলা হয়নি কথাগুলো। সবশেষে মাফ চেয়ে নিচ্ছি আমার কোনো কথায় কষ্ট পেয়ে থাকলে। সব সিনিয়র এক না, কিছু কিছু সিনিয়র আছে যাদের দেখলে কথা বলতে যাই নিজে থেকে। আজ ১০০ডিগ্রীর বেশি জ্বর নিয়ে কথা গুলো লিখে ফেলছি। অনেক দিন ধরে মনে হচ্ছিলো আমি অপরাধী, যদি এই কথা গুলো প্রকাশ না করি। তাহলে ঐসব সিনিয়রদের সম্পর্কে মানুষ জানতে পারবে না। আজকে অনেক ভালো লাগতাছে যে মনের কষ্টগুলো প্রকাশ করতে পারছি।’
এ বিষয়ে ‘আমরাই জাহাঙ্গীরনগর’ গ্রুপে পোস্ট দেয়া পর শতাধিক সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে নির্যাতনকারীদের নাম প্রকাশ করতে বলেন এবং প্রশাসনের কাছে তদন্তসাপেক্ষ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
এদিকে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী রাজন মিয়া দৈনিক নয়াদিগন্তকে জানান, মেডিকেল সার্টিফিকেটগুলো সাথে না থাকায় অভিযোগ করতে পারিনি। আগামী রোববার নির্যাতনের বিবরণ দিয়ে মীর মশাররফ হোসেন হলের ৪৫ব্যাচের দুই শিক্ষার্থীর নামে প্রক্টর বরাবর মেডিকেল সার্টিফিকেটসহ লিখিত অভিযোগ করা হবে। সার্টিফিকেটগুলো তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে রয়েছে।
এ বিষয়ে জাবি প্রক্টর আসম ফিরোজ-উর হাসান জানান,‘রাজন এখন হলে থাকে না, ক্যাম্পাস সংলগ্ন গেরুয়ায় থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ পোস্টটি দেয়ার পরে আমি নিজ থেকে তার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেছি। সে আমার সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ছাত্র শোনার পরে তার বিষয়টি সে জানানোর আগেই, আমি নিজ থেকে জানার চেষ্টা করেছি। শুনলাম সে এখনও অসুস্থ্য। র্যাগিংয়ের ব্যাপারে কোনো ছাড় নয়। অভিযোগপত্র পেলে তদন্তসাপেক্ষে দৃষ্টান্তমূলক বিচার করা হবে।’