তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের বিরোধের প্রভাব পড়ছে কওমি মাদরাসার শিক্ষা বোর্ডগুলোর সমন্বয়ে গঠিত সর্বোচ্চ শিক্ষা বোর্ড ‘আল হায়আতুল উলয়া’য়ও। তাবলিগের সা’দপন্থী হওয়ার অভিযোগে মুফতি ইজহারুল ইসলামের পরিচালনাধীন চট্টগ্রামের লালখান বাজার মাদরাসা ও ঢাকার অপর একটি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষাকেন্দ্র বাতিল এবং মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদের অবস্থান জানার জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করার পর বিষয়টি সামনে এসেছে। এ নিয়ে কওমি ঘরানার কিছু অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
বেফাকারুল মাদারিসুল আরাবিয়ার (বেফাক) মহাপরিচালক মাওলানা যোবায়ের আহমদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাবলিগের বিরোধ কওমি শিক্ষা বোর্ডে ঢুকে যাওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে সেটি যেতে পারে। শিক্ষা বোর্ডের পরও আমাদের একটা পরিচয় আছে- আমরা উলামায়ে হক্কানি এবং মুসলমান। শুধু শিক্ষা বোর্ড বলে বিষয়টি ধামাচাপা দিলে চলবে না। শিক্ষা বোর্ডের বাইরে আমাদের ঈমানিয়ত ও মুসলমানিত্ব রয়েছে। মুফতি ইজহার সাহেবের সা’দপন্থী হওয়ার বিষয়টি আমাদের মুরব্বিদের কাছে ক্লিয়ার হয়ে যাওয়ার কারণে তাকে কোনো শোকজের প্রয়োজন পড়েনি বলেও জানান তিনি।
গত বছর দশম সংসদের শেষ অধিবেশনে ‘কওমি মাদরাসাগুলোর দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান আইন, ২০১৮’ পাসের মধ্য দিয়ে ‘আল-হায়আতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ নামে যে সর্বোচ্চ বোর্ডের অধীনে কওমি শিক্ষাক্রমের দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের মানের সনদ প্রদানের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই আইন পাস হওয়ার পর এই প্রথমবারের মতো দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা শুরু হবে আগামী ৮ এপ্রিল। এই পরীক্ষাকে সামনে রেখে গত ১৭ মার্চ আল হায়আতুল উলয়া’র কমিটির বৈঠকে সা’দপন্থী হওয়ার অভিযোগে হেফাজতে ইসলামের শীর্ষনেতা নেজামে ইসলাম পার্টির চেয়ারম্যান মুফতি ইজহার পরিচালিত চট্টগ্রামের লালখান বাজার মাদরাসা ও রাজধানীর ভাটারায় মাওলানা আতাউর রহমান পরিচালিত আল মাদরাসাতুল মুঈনুল ইসলামের দাওয়ারায়ে হাদিসের পরীক্ষাকেন্দ্র বাতিল এবং বেফাকুল মাদারিসিদ্দীনিয়্যা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদের বিরুদ্ধেও মাওলানা সা’দপন্থী হওয়ার অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়।
‘আল-হায়আতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মুফতি ইজহারুল ইসলাম তাবলিগের মাওলানা সা’দের পক্ষে নিজের অবস্থানই পরিষ্কার করেননি, বাংলাদেশের আলেমদের পক্ষ থেকে মাওলানা সা’দের কাছে ক্ষমা চেয়ে একটি চিঠি লিখেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তার পরিচালিত মাদরাসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
তবে মুফতি ইজহারুল ইসলামের ছেলে ও মাদরাসার শিক্ষক মুফতি হারুন ইজহার পরদিন ১৮ মার্চ ফেসবুক লাইভে বলেন, বর্তমানে আমাদের মাদরাসাকে নিয়ে একটি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আমরা বিভিন্ন নিউজ পোর্টালের মাধ্যমে জানতে পারি আমাদের মাদরাসায় হায়আতুল উলইয়ার কেন্দ্রীয় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। যেহেতু কোনো আইনানুগ ধারাকে সামনে রেখে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি এবং তা সাংগঠনিক নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোনো নোটিশের মাধ্যমে আমাদেরকে জানানো হয়নি, সে জন্য আমরা এ সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক মনে করি। অসাংবিধানিক মনে করি। এমন অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসার জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
তিনি আরো বলেন, যে অভিযোগের ভিত্তিতে আমাদের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেয়া হলো এ ব্যাপারে আমাদের সম্মিলিত বক্তব্য হলোÑ মাওলানা সা’দ ও তার অনুসারীদের সাথে জামিয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়া লালখান বাজারের কোনো ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবক ও শুভানুধ্যায়ীর কোনো সম্পর্ক নেই। মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী যে বক্তব্য দিয়েছেন এটি একান্ত তার ব্যক্তিগত বক্তব্য। পুরো মাদরাসা একটি কার্যনির্বাহী কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী এসব কাজে জড়িত থাকেন না। মাদরাসার আর্থিক, প্রশাসনিক ও শিক্ষাগত সব সিদ্ধান্ত কার্যনির্বাহী কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। তাই মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীর ব্যক্তিগত কোনো মতামত রাজনৈতিক বা সামাজিক কোনো কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে এই মাদরাসাকে মূল্যায়ন করা জঘন্যতম ভুল।
‘আল-হায়আতুল উলয়ার অফিস সম্পাদক মাওলানা মু: অসিউর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, এখনো সিদ্ধান্তটি লিখিতভাবে জানানো হয়নি, মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার জন্যও কোনো অনুরোধপত্র আসেনি। তিনি জানান, লালখান বাজার মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসের ২৬ জন এবং ভাটারার মুঈনুল উলুমের ২১ জন পরীক্ষার্থী রয়েছেন। কেন্দ্র বাতিল হলেও তাদেরকে অন্য কেন্দ্র থেকে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। লিখিত কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেফাকের মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে মুরব্বিরা কেন্দ্র বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বেফাকুল মাদারিসুল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) মহাপরিচালক মাওলানা যোবায়ের আহমদ চৌধুরী এ ব্যাপারে বলেন, বেফাকের অভিযোগ ছিল, এটাও ঠিক আছে; কিন্তু লালখান বাজার মাদরাসার ব্যাপারে সব বোর্ডের প্রতিনিধিদের অভিযোগের ভিত্তিতে মুরব্বিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আত্মপক্ষ সমর্থন বা শোকজ নোটিশ না দিয়ে এভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে মুফতি হারুন ইজহারের আপত্তির ব্যাপারে তিনি বলেন, মুরব্বিরা মনে করেছেন মুফতি ইজহারুল ইসলাম ওপেনলি অবস্থান নিয়েছেন। শোকজ করা হয় যখন বিষয়টি ক্লিয়ার থাকে না। যেহেতু এখানে বিষয়টি ক্লিয়ার- এ জন্য শোকজে যাননি। ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এখনো লিখিতভাবে না জানানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, আল হায়আতুল উলায়ার পক্ষ থেকে লিখিতভাবে জানানো হবে। তবে তিনি বলেন, উনারা যদি অফিসিয়ালি ডিক্লারেশন দেন যে, আমরা সাদ সাহেবের সাথে নেই, আমাদের সাথে আছেন- এটা লিখিতভাবে দিলে বিবেচনা করা হবে। তিনি বলেন, হারুন ইজহার হয়তো ফেসবুকে তার বক্তব্য দিয়েছেন। অফিসিয়ালি এখনো দেননি। দিলে বিবেচনা করা হবে।
দেওবন্দের নীতি-আদর্শের কারণে মুফতি ইজহারের মাদরাসার কেন্দ্র বাতিল করার কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু দেওবন্দ মাদরাসায় তো তাবলিগের উভয় গ্রুপের কাজ নিষিদ্ধ এবং তারা প্রকাশ্যে কারো পক্ষ নেননিÑ এমন প্রশ্নের জবাবে মাওলানা যোবায়ের বলেন, মাওলানা সা’দের ব্যাপারে দেওবন্দ শঙ্কিত, উনি সঠিক লাইনে আছেন কি না। বারবার বলেছেন, রুজুও করবেন, কিন্তু করেননি। উনারা ভারতে অবস্থান নেননি। সেখানে মাইনরি হিসেবে মাঝামাঝি চলেন। বাংলাদেশের অবস্থা ওই রকম না। তবে তারা তাদের অবস্থান অনেকটা ক্লিয়ার করে ফেলেছেন। তারাও কিতাব দেখে বলবেন। আমরা কিতাব দেখেই বলছি।
তাবলিগের বিরোধ শিক্ষা বোর্ডেও প্রভাব ফেলার বিষয়ে তিনি বলেন, এখন সরকার যদি ইসলামবিরোধী কাজ করে আমরা কি শিক্ষা বোর্ড হিসেবে চুপ থাকব? শিক্ষা বোর্ডের পরও আমাদের একটা পরিচয় আছে, উলামায়ে হক্কানি এবং মুসলমান। শুধু শিক্ষা বোর্ড বলে বিষয়টি ধামাচাপা দিলে চলবে না। শিক্ষা বোর্ডের বাইরে আমাদের ঈমানিয়ত ও মুসলমানিত্ব রয়েছে। সরকার দুই গ্রুপকে নিয়ে ইজতেমা আয়োজনের পরও এখন সা’দপন্থী বলে সরকারি সনদের পরীক্ষার কেন্দ্র বাতিলের বিষয়টি সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে যায় কি নাÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার শেষ পর্যন্ত দুই গ্রুপের ইজতেমা একসাথে করেনি। আলাদা আলাদ করেছে। এ ব্যাপারে সরকারের সাথে আমাদের কিছু বোঝাপড়া বাকি রয়েছে। উনারা সাময়িকভাবে করলেন না স্থায়ীভাবে করলেন এটা বোঝার ব্যাপার রয়েছে। তিনি বলেন, দেওবন্দ ক্লিয়ার মতামত দেয়নি সা’দপন্থীদের ব্যাপারে। কিন্তু আমরা এবারত যতটুকু বুঝি অন্যরা বুঝবে না। আমাদের তাদের সাথে যোগাযোগ আছে। উনারা আলেম, আমরা তো আওয়াম না, আমরা এটা বুঝি।
উল্লেখ্য, আগামী ৮ এপ্রিল থেকে অনুষ্ঠেয় দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষায় সারা দেশের এক হাজার ২৪৪টি মাদরাসার ২৬ হাজার ৭২১ জন পরীক্ষা দেবেন। এর মধ্যে বেফাকের অধীন মাদরাসাগুলোর ছাত্রসংখ্যা সর্বোচ্চ ২১ হাজার ৫৫৩ জন।