পুলিশের সড়ক শৃঙ্খলা সপ্তাহ পালনকালেই সুপ্রভাত বাস কেড়ে নিয়েছে শিক্ষার্থী আবরারের জীবন। এ ছাড়াও পুলিশের এই কর্মসূচির মধ্যেও প্রতিদিন অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণ হারাচ্ছে অনেক মানুষ। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পুলিশের এই কর্মসূচি কেবল আইওয়াশ। এতে সড়কে কোনো শৃঙ্খলা ফেরে না। বরং কিছু অসৎ পুলিশ সদস্যের বাড়তি উপার্জনের ব্যবস্থা হয় এই কর্মসূচিতে।
গত ১৭ মার্চ রাজধানীতে ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহ শুরু হয়। ২৩ মার্চ পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলবে। ১৭ মার্চ রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেল ক্রসিংয়ে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো: আছাদুজ্জামান মিয়া। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মহানগরীর জনসাধারণকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে উদ্বুদ্ধকরণ এবং ট্রাফিক শৃঙ্খলা উন্নতিকল্পে এই কর্মসূচি নেয়া হয়। কর্মসূচি উদ্বোধনের পর পুলিশ কমিশনার নিজেই কয়েকটি গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করেন। এ সময় তার সাথে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সড়কে শৃঙ্খলা ফিরেয়ে আনার লক্ষ্যে এর আগেও এভাবে কর্মসূচি পালন করা হয়। কিন্তু ভুক্তভোগীরা বলেছেন, এই কর্মসূচি দিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরেছে বলে তাদের জানা নেই। তবে এবারে শৃঙ্খলা সপ্তাহেই ঘটে গেল মর্মান্তিক ঘটনা। রাজধানীর প্রগতি সরণিতে কুড়িল বিশ্বরোডে গত মঙ্গলবার সুপ্রভাত নামের একটি বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারালেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী।
নিয়ম মেনে জেব্রা ক্রসিং দিয়েই তিনি রাস্তা পার হচ্ছিলেন। এ সময় অন্য একটি বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে চালক সুপ্রভাত পরিবহনের ওই বাসটি আবরারের গায়ের উপর উঠিয়ে দেয়। এর খানিক আগে ওই বাসটিই এক তরুণীকে চাপা দিয়ে আসে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত দু’দিন রাজধানীতে ব্যাপক বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। গতকাল দুপুর পর্যন্ত রাজধানী অনেকটা উত্তাল ছিল। রাজধানীর মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে সড়কে অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের সাথে কোথাও কোথাও অভিভাবকরাও অংশ নেন।
সূত্র জানায়, আবরারের নিহত হওয়ার ঘটনা থেকেই বোঝা যায় সড়কে কতটা শৃঙ্খলা ফিরেছে। রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকার সবুজ নামের এক চাকরিজীবী বলেন, এটা হচ্ছে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরার নমুনা! তিনি বলেন, শৃঙ্খলা ফিরবে কিভাবে? যারা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাবেন তারাতো থাকেন অন্য ধান্ধায়। বেশির ভাগ এলাকায়ই দেখা যায় গাড়িগুলো বিশেষ করে বাসগুলো বেপরোয়া গতিতে চালাচ্ছেন চালকেরা।
যত্রতত্র থামিয়ে যাত্রী উঠাচ্ছেন ও নামাচ্ছেন। অনেক সময় দেখা যায় বাসের মধ্যে থাকা যাত্রীরা এর প্রতিবাদ করলে উল্টো পরিবহন শ্রমিকদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। সবুজ বলেন, পুলিশ তাকিয়ে থাকে মোটরসাইকেলের দিকে। মোটরসাইকেল ধরে পুলিশ মামলার পাল্লা ভারী করে। কিন্তু বেপরোয়া বাসের দিকে পুলিশের নজর নেই।
আমিনুল ইসলাম নামের এক বাইকার বলেন, পুলিশ চেকপোস্টে মোটরসাইকেলের লাইন দিয়েছে কাগজপত্র তল্লাশির জন্য; আর চোখের সামনে দিয়ে একের পর লক্কড়ঝক্কর গাড়িগুলো পার হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো গাড়ির পেছন খুলে পড়ে গেছে। দেখলেই বোঝা যায় ওই গাড়ির কাগজপত্র থাকার কথা নয়। কিন্তু সেগুলোর দিকে কোনো নজর নেই পুলিশের।
বাংলাদেশ বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা বলেছেন, এই ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহ অনেকটা আইওয়াশ। এ সপ্তাহে কিছু পুলিশ সদস্যের চাহিদা বেড়ে যায়। ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহ উপলক্ষে মামলার সংখ্যা বাড়ে, উপার্জন বাড়ে; এই আর কি।
বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে নয়া দিগন্তকে বলেন, এই ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহ দিয়ে কোনো উপকার হয় না। কোনো উপকার হলে তো এত লোক সড়কে মারা যেত না।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ট্রাফিক মীর রেজাউল আলম বলেন, এই কর্মসূচির মাধ্যমে সবাইকে সজাগ করা হয়। তিনি বলেন, ট্রাফিক আইন মান্য করার সংস্কৃতি তৈরি করার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এতে কিছুটা হলেও মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আসছে। আগে মানুষ হেলমেট পরত না, এখন হেলমেট মাথায় দিয়ে মোটরসাইকেল চালান। শতভাগ না হলেও অনেক অর্জনই বলা যায়। তিনি বলেন, গণপরিবহন নিয়ে আরো কাজ করতে হবে। এখানে এখনো সুফলতা পাইনি। তবে সুফলতা আসবে বলে বিশ্বাস করি।