১৯৯৩ সালের গ্রীষ্মকালে বিখ্যাত সাময়িকী ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’-এ শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি হান্টিংটনের একটি গবেষণা নিবন্ধ ছাপা হয়। নিবন্ধটির শিরোনাম ছিল- ‘দ্য ক্লাশ অব সিভিলাইজেশনস?’ এটি সমসাময়িক চিন্তার জগতে তুমুল বিতর্ক ও আলোড়ন সৃষ্টি করে। ওই নিবন্ধে হান্টিংটন প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, আগামী পৃথিবীর সঙ্ঘাত রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যকেন্দ্রিক হবে না, বরং সেটি হবে সভ্যতার দ্বন্দ্ব। সভ্যতা বলতে তিনি ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্র, রাষ্ট্রজোট ও সংস্কৃতিকে বুঝিয়েছেন। সমালোচনার ব্যাপকতা লক্ষ করে তিনি ১৯৯৬ সালে নিবন্ধটি সম্প্রসারিত করে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের রূপ দান করেন। সেখানে তিনি উত্থিত বিতর্কগুলোর জবাব দেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি এটিকে আরো রূপ-রস-গন্ধ দিয়ে রীতিমতো একটি দর্শন বা মতবাদে রূপান্তর করেন। তার দর্শন বা মতবাদ অনুযায়ী ইসলামই হচ্ছে একমাত্র ধর্ম, সভ্যতা বা জাতি যারা পাশ্চাত্যের উন্নত সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম। তিনি উপসংহারে বলেন, ইসলাম বিজয়ী হলে পাশ্চাত্য সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। পৃথিবীখ্যাত ধর্মে ইহুদি এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এখানেই তার কর্তব্য শেষ করেননি, মৃত্যুর আগে ২০০৫ সালে আরেকটি গ্রন্থ সমাপ্ত করেন।
সেই গ্রন্থটির নাম- ‘হু আর উই’। তিনি এই গ্রন্থে অবাঞ্ছিত অভিবাসীদের চাপে মার্কিন জাতির অস্তিত্ব বিলোপের আশঙ্কা করেন। মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এবং সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিগিনিউ বেজনস্কি (উভয়ই ইহুদি সম্প্রদায়ভুক্ত) হান্টিংটনের এই তত্ত্বকে সমর্থন করেন। মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বার্নার লুইসও লেখনীর মাধ্যমে হান্টিংটনকে সমর্থন জানান। ওই সময়ই বিপুলসংখ্যক পাশ্চাত্য পণ্ডিত সভ্যতার দ্বন্দ্বতত্ত্বের তীব্র সমালোচনা ও বিরোধিতা করেন। এভাবেই রচিত হয়েছে আজকের বিশ^ব্যাপী মুসলিমবিদ্বেষ ও দুর্বৃত্তায়নের সাম্প্রতিক পটভূমি। সে সময় এরা যে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিলেন, তা এখন ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামী দেশগুলোকে ক্ষতবিক্ষত করছে। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে জুমার নামাজরত মুসলমানদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা এর সর্বশেষ উদাহরণ।
দর্শনে বলা হয়, একটি তত্ত্ব যখন জন্ম নেয় তার বিপরীতে আরেকটি তত্ত্বের অস্তিত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথম ও দ্বিতীয় তত্ত্ব মিলে তৃতীয় তত্ত্বের বিকাশ ঘটে। এভাবে থিসিস, অ্যান্টিথিসিস ও সিনথিসিস ঘটে চলছে আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত। ধর্মের গ্রহণযোগ্যতার কথাই ধরা যাক। প্রাচীনে ও মধ্যযুগে ধর্মই ছিল সব কিছুর উৎসমূল। পবিত্র রোম সাম্রাজ্য শাসিত হয়েছে বাইবেল দিয়ে। ইসলামের ইতিহাসে ‘খোলাফায়ে রাশেদা’ আজ পর্যন্ত শাসনের আদর্শ। এক সময় ধর্মের আবেদন কমে যায়। এখন আবার পুরোমাত্রায় ধর্মের আবেদন অনুভূত হচ্ছে সর্বত্র। একজন ব্রেন্টন ট্যারান্ট অথবা ব্রেইরিং ব্রেইভিক প্রমাণ করেছেন ধর্মের আবেদন তাদের হৃদয়ের কতটা কাছে। ধর্মের অনুশাসন অন্যায় নয়। অন্যায় হলো ধর্মের অপপ্রয়োগ। ন্যায়-অন্যায়ের সে দ্বন্দ্ব চিরপ্রবহমান।
হান্টিংটন যে সভ্যতার দ্বন্দ্বের কথা বলেছেন, তা-ও অসত্য নয়। অবশ্য উপসংহারটি বিদ্বেষপ্রসূত। সভ্যতার দ্বন্দ্ব যদি হয় ধর্মনির্ভর তাহলে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, পৃথিবীর ইতিহাসের অনেকাংশজুড়ে আছে ধর্মযুদ্ধ। আমি শুধু ‘ক্রুসেড’-এর কথা বলছি না। ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই জানেন ইউরোপে ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্টের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধবিগ্রহের কথা। আরো আগে যাজকতন্ত্র বনাম রাজতন্ত্রের লড়াইয়ে অতিবাহিত হয়েছে কয়েক শতাব্দী। খ্রিষ্টজগৎ যখন প্রথমবারের মতো মুসলিম অগ্রাভিযানের সম্মুখীন হয় তখন তাদের বন্দুকের নল ঘুরে যায় মধ্যপ্রাচ্য মুখে। ১০৯৬ সাল থেকে ১২৯১ সাল পর্যন্ত বড় ধরনের আটটি অভিযান পরিচালনা করে খ্রিষ্ট ইউরোপ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে। ইতিহাসে এই যুদ্ধকে মুসলমানেরা বলে ‘জিহাদ’। আর খ্রিষ্টানেরা বলে ‘ক্রুসেড’। ইতিহাসের ঘনঘটার সুযোগ এখানে নেই। ১২৯১ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত বিভক্ত মুসলিমবিশ্ব বিবিধ উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছিল। অবশেষে মুসলিম শক্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় উসমানীয় সালতানাত। ইউরোপের ভাষায় ‘অটোমান এম্পায়ার’।
এদের এতটাই সম্প্রসারণ ঘটে যে, তারা সমগ্র পূর্ব ইউরোপ দখল করে এবং মধ্য ইউরোপের ভিয়েনা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। প্রথম মহাযুদ্ধে সম্মিলিত ইউরোপীয় শক্তির কাছে উসমানীয় সাম্রাজ্য বিপর্যস্ত ও একরকম ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এ সময় ইহুদিদের সাহায্য সহযোগিতার বিনিময়ে ১৯১৭ সালে কুখ্যাত বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয় সে সময়ের পরাশক্তি গ্রেট ব্রিটেন। মরক্কো থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল উসমানীয় সাম্রাজ্য পাশ্চাত্য শক্তি ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। এখনকার ওআইসি’র অনেক রাষ্ট্র ওই ধ্বংসপ্রাপ্ত সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশ এবং বিশেষ শাসিত অঞ্চল ছিল। মুসলমানদের কেন্দ্রীয় শক্তি অটোমান এম্পায়ারের পতনের মধ্য দিয়ে মুসলিম বিশ্বের বিভেদ-বিপর্যয় ও ঔপনিবেশিক অধীনতা শুরু হয়। এই সাম্রাজ্যিক পতনের মধ্য দিয়ে মানসিক বিপর্যয়ও শুরু হয়। তুরস্কের মোস্তফা কামাল পাশার মতো পাশ্চাত্যমুখী নেতৃত্ব মনে করতে থাকে, ইসলামই তাদের বিপর্যয়ের মূল কারণ। তারা যদি আলখেল্লা ছেড়ে হাফপ্যান্ট পরে তাহলেই তাদের উন্নতি ঘটবে। এভাবে ওই নেতা ইসলামী বিশ্বের নামমাত্র ‘খেলাফতের’ অবলুপ্তি ঘটান।
ইসলামের যাবতীয় কিছু- শাসনব্যবস্থা, শিক্ষানীতি, সংস্কৃতি ও সামরিক ঐতিহ্য পরিত্যাগ করেন। এমনকি আরবি ভাষায় কুরআন পড়া ও আজান দেয়া নিষিদ্ধ করেন। অপর দিকে পৃথিবীর আর সব মুসলমান খেলাফত রক্ষায় তৎপর হন। আমাদের ইতিহাসে ১৯২০-২২ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলী তথা ‘আলী ভাতৃদ্বয়’ পরিচালিত খেলাফত আন্দোলনের কথা বিস্মৃত হওয়ার মতো নয়। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কামাল আতাতুর্ক খেলাফতের অবসান ঘোষণা করলে মুসলমানদের মোহমুক্তি ঘটে। কামাল পাশা ও পাশ্চাত্য শক্তির যৌথ আক্রমণের মুখে পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন ঘটে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নানাভাবে নানা আদলে এসব আন্দোলনের তীব্রতা বেড়ে যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে স্তিমিত ও পরাজিত ওহাবি মতবাদ পুনরায় ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। এই নতুন জাগরণে ইসলাম স্বাধীনতা ও মুক্তির মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। জামাল উদ্দিন আফগানী প্যান ইসলামিজম বা অখণ্ড মুসলিম জাহানের স্বপ্ন দেখান।
মোহাম্মদ আবদুহু এবং রশিদ রিদা ইসলামী সমাজ গঠনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলেন। তারা ইউরোপীয় শাসন, শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ১৯২৮ সালে ইসলামে পুনঃপ্রত্যাবর্তনের আহ্বান নিয়ে মিসরে হাসানুল বান্না ‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’ বা ইসলামী ব্রাদারহুড পার্টি গঠন করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হয়। এ সময় মুসলমানদের মধ্যে দু’টি ধারা পরিলক্ষিত হয়। একটি ধারা মূল ইসলামে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে মুক্তির বার্তা দেয়। অপর অংশ পাশ্চাত্যের সাহায্য-সহযোগিতায় নিয়মতান্ত্রিক পথে স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যায়। অবশ্য উভয় ধারায় চূড়ান্তভাবে ঔপনিবেশিক শক্তিকে শত্রু বলে গণ্য করা হয়। পাকিস্তানের জাতির পিতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্বের মাধ্যমে মুসলিম জাতির স্বাতন্ত্র্যের কথা বলেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তীকালে সমগ্র মুসলিমবিশ^ ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যবাদের কবলমুক্ত হয়। নতুন শাসক যারা এসব জাতির নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হন, সেখানেও উপরোল্লিখিত দুই ধারার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। মাঝপথে উত্থিত জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা নেতৃত্বকে প্রভাবিত করলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৬৭ সালের জুন যুদ্ধের বিপর্যয়ের পর মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাতীয়তাবাদ তার আবেদন হারিয়ে ফেলেন। আবারো ইসলাম পুনর্জাগরণের মূলমন্ত্র হিসেবে ফিরে আসে। পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে বিভিন্ন ঘটনাপরম্পরার মধ্য দিয়ে পরিবর্তন, পরিমার্জন এমনকি ভাঙন পরিলক্ষিত হলেও ইসলামের আবেদন কখনো ম্লান হয়ে যায়নি। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ভেঙে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও ইসলাম জনগণের হৃদয়ে জাগরূক থেকেছে। দীর্ঘ বিতর্ক ও বিশ্লেষণে না গিয়ে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের অক্ষুণœ উল্লেখ ও প্রধানমন্ত্রীর মদিনা সনদ দিয়ে দেশ শাসনের অঙ্গীকার- বাংলাদেশে ইসলামের প্রভাব ও আবেদন বোঝার জন্য যথেষ্ট।
এই দীর্ঘ ইতিহাস প্রমাণ করে, ইসলাম একটি নিরবচ্ছিন্ন আদর্শ হিসেবে মুসলিম বিশ্বের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বহমান রয়েছে। আর পাশ্চাত্য ইতিহাসের পাতায় চিরকালই তাদের বৈরিতা ও শত্রুতার প্রমাণ রেখেছে। এখন ক্রুসেডের মতো ঢাল-তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ না হলেও রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিরোধ প্রবহমান রয়েছে। এই সে দিন ২০০১ সালে নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ মুখ ফসকে ‘ক্রুসেডের’ কথা বলেছিলেন। বর্তমান পৃথিবীর প্রচলিত কূটনীতি, জাতিসঙ্ঘ এবং আন্তর্জাতিক লৌকিকতায় ধর্মের বিভেদের কথা স্বীকার না করলে এটাই নির্মম সত্য যে, গোটা পাশ্চাত্যের অবস্থান ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে রয়েছে।
ক্রুসেড থেকে পাশ্চাত্য কর্তৃক অটোমান সাম্রাজ্যের দখল, মুসলমানদের ফিলিস্তিনি পিতৃভূমি থেকে বিতাড়নপূর্বক ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা নিকট অতীতের উদাহরণ। ১৯৭৯ সালে সাম্রাজ্যবাদের শিখণ্ডী ইরানের শাহানশাহ রেজা শাহ পাহলভীর বিরুদ্ধে মুসলমানেরা যখন মেশিনগানের সামনে পেতে দেয় বুক, তখন বিস্মিত হয় পাশ্চাত্য। ভোগবাদী, বস্তুবাদী, পুঁজিবাদী পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে এটি ছিল এক আদর্শিক বিপ্লব। সমসাময়িক পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো আলোড়ন সৃষ্টি করে ইরানি জনগণের এই অভ্যুত্থান। পাশ্চাত্যের কায়েমি স্বার্থবাদ ভীত হয়ে ওঠে। ইউরোপ-আমেরিকার সাধারণ মানুষ ইসলামের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠে। শঙ্কিত হয় ইসলামের ঐতিহাসিক শত্রু ইহুদি শক্তি।
সংঘটিত হয় ৯/১১-এর মর্মান্তিক ঘটনা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা তথ্যপ্রমাণ দিয়ে প্রমাণ করার প্রয়াস পান, এটি ইহুদিদের ষড়যন্ত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তার নামে আফগানিস্তান দখল, ইরাক অধিকার, সাদ্দাম হোসেন ও গাদ্দাফির হত্যা, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রকাশ এবং মুসলিম স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপ- সবই এক একটি ক্ষোভের উদাহরণ। মুসলমানদের বিরুদ্ধে অব্যাহত সন্ত্রাসের অভিযোগ এবং এর অজুহাতে বিভিন্ন মুসলিম দেশে অন্যায়-অত্যাচার ও নিপীড়ন-নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা। মুসলিম জনগোষ্ঠী মনে করে ইরান বা তুরস্কের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রর বিরূপ মনোভাবের কারণ শুধু স্বার্থভিত্তিক নয়, আদর্শিক। বিশেষ করে মুসলমানদের জীবন যাপন পদ্ধতি পাশ্চাত্য থেকে আলাদা।
যেমন- পাশ্চাত্যের মহিলারা প্রায় নগ্ন থাকেন। মুসলিম মহিলারা কাপড়ের আধিক্যে ঢাকা থাকেন। তারা শূকর খায়, মুসলমানেরা একে হারাম বা নিষিদ্ধ বলে বিশ্বাস করেন। পাশ্চাত্যের লোকেরা মদ খায়। ইসলাম মদকে হারাম করেছে। মুসলমানেরা যখন তাদের বিশ^াস ও জীবনধারা অনুসরণ করে চলতে চেয়েছেন- তখনই পাশ্চাত্য একে পশ্চাৎপদতা বা সেকেলে অপসংস্কৃতি বলে তিরস্কার করেছে। অথচ এরাই জোরেশোরে সর্বোচ্চ ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা, মানবাধিকারের কথা সুউচ্চ কণ্ঠে বলে বেড়াচ্ছে। বিভিন্ন দেশে ইসলাম, মুসলমান ও এর নবী হজরত মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে এরা অশ্লীল ও অপমানজনক মন্তব্য করেছে। একজন সালমান রুশদী যখন মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থকে ‘শয়তানের পদাবলি’ বলেছে তখন পাশ্চাত্য তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও আশকারা দিয়েছে। ডেনমার্কে ইসলামের নবীর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশিত হয়েছে। ফ্রান্সেও একই ঘটনা ঘটেছে।
পৃথিবীর অন্য ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্ম সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। ইসলামে ধর্ম ও রাজনীতি তথা জাগতিক বিষয়গুলো এক ও অভিন্ন। এটি একই সাথে ‘দ্বীন ও দুনিয়ার’ কথা বলে। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো স্থান নেই। ইসলাম দুনিয়ার তাবৎ মুসলমানকে একটি ভিন্নতর পরিচয় দেয়। ইসলামের প্রবক্তারা বলেন, ‘ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা।’ কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দী থেকে যখন মুসলিম বিশ্ব ক্রমেই ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে চলে যায় তখন পাশ্চাত্য তাদের শাসনব্যবস্থা, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও যাপিত জীবনাচার দ্বারা প্রমাণ করে, ধর্ম ও রাজনীতি সম্পূর্ণ পৃথক বিষয়। এভাবে মুসলমান শাসনের সময়ের শরিয়াহ আইন বাতিল হয়ে পাশ্চাত্যের আইন প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘকালীন চর্চা ও অনুশীলনের ফলে মুসলমানেরা অভ্যস্ত হয়ে যান পাশ্চাত্যের অনুকরণে। আবার যখন তারা স্বাধীন হন তখন শাসক তথা শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ধর্ম ও রাজনীতির দ্বৈধতায় নিপতিত হন।
এ দিকে সীমিত কায়দায় বহাল থাকে মাদরাসা শিক্ষা। এভাবে শুরু হয় মাস্টার ও মোল্লার দ্বন্দ্ব। পাশ্চাত্যের একজন গবেষক একে ‘ওয়েস্টো মেনিয়া’ বলে অভিহিত করেন। বর্তমান বিশ্বে সম্ভবত এই ওয়েস্টো মেনিয়া মুসলমানদের সবচেয়ে মারাত্মক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধি। যারা সিরাজউদ্দৌলা নাটকটি দেখেছেন তারা ‘গোলাম হোসেন’ চরিত্রটির কথা মনে করুন। তার গায়ে এক দিকে পশ্চিমা কোট, অপর অংশে দেশী কোর্তা। নিচের অংশে এক দিকে পাজামা, অপর পায়ে ধুতি।
এই হলো মুসলমানদের বিচিত্র পোশাকের নমুনা। ভারতে একটি জনপ্রিয় গান আছে ‘মেরা জুতা জাপানি, পাতলুন হিন্দুস্তানি, ছের মে রোমি টুপি, ফেরভে হাম হায় হিন্দুস্তানি…।’ এ ধরনের ভাড়াটে হাস্যকর এবং আরোপিত মানসিক মনোভাব নিয়েই বসবাস করছেন এই পৃথিবীর কোটি কোটি মুসলমান। আর একটি সহজ উদাহরণ দেয়া যাক। বাংলাদেশের গরিষ্ঠ মানুষ যেহেতু মুসলমান, সেহেতু একে অপরকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে। অথচ গরিষ্ঠ মানুষের এই সম্বোধনকে সহজভাবে গ্রহণ না করে তথাকথিত প্রগতিশীলরা ‘শুভ সকাল’ ও ‘শুভ সন্ধ্যা’ বলে। খ্রিষ্টধর্মের সম্বোধনকে অনুবাদ করে বলবেন অথচ গরিষ্ঠ মানুষের ভাষাকে গ্রহণ করতে তাদের লজ্জা হয়। এটাই হলো ওয়েস্টো মেনিয়া।
এটাই প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্বের প্রমাণ। এভাবে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সর্বত্র এই দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটছে। মুসলমানেরা পাশ্চাত্যের হাতে আগে যেমন শাসিত-শোষিত হয়েছে, এখনো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেই ধারাবাহিকতা চলছে। এই শাসন-শোষণ যখন তাদের স্বাধীনতা, সম্পদ ও সম্মান কেড়ে নিচ্ছে- এখানে সেখানে সর্বত্র তখন একজন লায়লা খালেদ বিমান হাইজ্যাক করছে, একজন জামিলা বোপাশা রক্ত দিচ্ছে তখন তারা অভিহিত হচ্ছে ‘দুষ্কৃতকারী’ বলে। পাশ্চাত্যের দমনপীড়ন ও লুণ্ঠন যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে প্রতিরোধ। প্রতিরোধের নাম হয়েছে আলকায়েদা, আইএস, আস-সাবাহ এবং বোকো হারাম। আজকের এই গণতান্ত্রিক বিশে^ এ ধরনের সন্ত্রাসী ও নির্মম মৃত্যু বা নাশকতা মেনে নেয়া যায় না।
নিউটনের তৃতীয় সূত্র বলে- ‘এভরি অ্যাকশন হ্যাজ ইটস ইকুয়াল অ্যান্ড অপোজিট রিঅ্যাকশন।’ বিজ্ঞানের এই চিরায়ত সত্যকে অস্বীকার করা কি সম্ভব? সন্দেহ নেই যে, মুসলমানদের এই রিঅ্যাকশন অনুভূত হচ্ছে পৃথিবীব্যাপী- নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস সর্বত্র। কারণ ক্রমাগতভাবে এখনো কোথাও কোথাও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারটুকুও অর্জন করেনি। তাই আজ রক্তাক্ত বসনিয়া, চেচনিয়া, কাশ্মির, আরাকান ও মিন্দানাও। মানবাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীদের প্রশ্ন করা যায়- খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব তিমুর অথবা দক্ষিণ সুদান যদি স্বাধীনতার ম্যান্ডেড পেতে পারে, তাহলে ওরা পাবে না কেন? মুসলমান হওয়াই কি তাদের অপরাধ?
সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামী জনগোষ্ঠীর সাথে পাশ্চাত্যের বৈরিতার বড় একটা কারণ, অভিবাসী এবং আশ্রয় প্রার্থী সঙ্কট। সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান থেকে তাদেরই সৃষ্ট যুদ্ধ থেকে নিরাপদ জীবনের জন্য যখন এসব দেশের অধিবাসী ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে, তখন ওইসব রাষ্ট্র তাদের প্রবেশাধিকার দিতে অস্বীকার করেছে। যারা ধর্মনিরপেক্ষাতার নীতি আউরিয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, তারা এখন বলছে মুসলমান হলে জায়গা দেয়া যাবে না। তবে খ্রিষ্টান হলে আশ্রয় পেতে পারে। তাহলে কি পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধসে পরার উপক্রম হয়েছে? ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে খ্রিষ্টবাদী মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে। তাহলে কি দর্শনের চিরায়ত ব্যাকরণ মোতাবেক সভ্যতার প্রত্যাবর্তন ঘটছে মধ্যযুগে? খ্রিষ্ট সভ্যতা বনাম ইসলামী সভ্যতার আর একটি বড় বিষয় হলো গণতন্ত্র। পাশ্চাত্য মনে করে ইসলাম ও মুসলমানেরা গণতন্ত্রের মন ও মগজ ধারণ করে না।
সাম্প্রতিক বিশ্বে ইসলামী দেশগুলোতে গণতন্ত্রের বিকাশ ও লালন তাদের এ প্রপঞ্চকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে। অপর দিকে পাশ্চাত্য তথা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ মুসলিম দুনিয়ায় গণতন্ত্রের বিকাশকে তাদের স্বার্থের পরিপন্থী মনে করছে- এ রকম মনে করার প্রমাণ আছে। আলজেরিয়ায় যখন তারা ইসলামী জোটকে ক্ষমতায় যেতে দেখেছে, তখনই সেখানে সামরিক বাহিনী নির্বাচন বাতিল করেছে। নাইজেরিয়ায় ইসলামপন্থী হওয়ার কারণে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে কারাগারেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। আল ইখওয়ানুল মুসলিমিন মিসরের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জয় লাভ করলেও অল্প সময়ের ব্যবধানে সেখানে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। গণতন্ত্রকে স্বাধীন, সাবলীল ও স্বাভাবিক করতে না দেয়ার কারণে রক্ত ঝরছে অনেক মুসলিম জনপদে।
ক্রুসেড থেকে এ পর্যন্ত আমরা দেখলাম ইতিহাসের পাতায় খ্রিষ্টধর্মী ইউরোপ-আমেরিকা ইসলাম তথা মুসলমানদের মধ্যে তাদের হিংসাবিদ্বেষ ও ঘৃণার লালন-পালন ঘটিয়েছে। এদের একটি বিশেষ অংশ সব সময়ই তৎপর থেকেছে ইসলাম ও মুসলিম-বিরোধিতায়। ইতিহাসের এই নির্মমতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুসলমানেরা সঙ্গতভাবেই প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবাদ পরিণত হয়েছে প্রতিরোধে। প্রতিরোধ ডেকে এনেছে যুদ্ধ। এভাবে ১৮৫৭ সালে এই উপমহাদেশে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঘটেছে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। আলজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে রক্ত ঝরেছে। বাংলার নিসার আলী তিতুমীর, হাজী শরীয়তউল্লাহ এবং অসংখ্য শহীদের রক্তে স্নাত হয়েছে এই দেশ। বিদেশী করতলগত মুসলিম জনপদেও অবতারণা হয়েছে একই দৃশ্যের। পৃথিবীর যেখানেই রক্তপাত ঘটুক না কেন তা অন্যায়। আমরা বিশ্বাস করি না- ‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়’। তাই সন্ত্রাসবাদ বা বিরোধের উৎসমূল সন্ধান মানবতার স্বার্থে একান্তই জরুরি।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com