পাহাড়ে রক্তপাত : নেপথ্যে ভয়ঙ্কর খেলা!

নিজেদের শক্তি প্রদর্শন ও বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বানচাল করতেই জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সন্তু গ্রুপ হামলা করেছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর। এতে সহায়তা করেছে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপ। বাঘাইছড়িতে ব্রাশফায়ারে সাতজনকে হত্যা ও ১৭ জনকে আহত করার ঘটনায় প্রাথমিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এমনই তথ্য পেয়েছে। তাদের মতে, এ ঘটনায় সরাসরি জড়িত রয়েছে বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের জেএসএস সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী বড় ঋষি চাকমা। হত্যাকাণ্ডের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি এমন কিছু ইঙ্গি করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। স্থানীয় সূত্র জানায়, শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য অঞ্চলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর এটি বড় ধরনের হামলার ঘটনা। আর নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে গত ৪৮ বছরে কমিশনের ওপর এটি সবচেয়ে বড় আঘাত।

গত সোমবার সন্ধ্যার দিকে ভোট গণনা শেষে উপজেলার সাজেক বাঘাইহাট থেকে দীঘিনালা ফেরার পথে ৯ কিলোমিটার নামক স্থানে সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছেন একজন প্রিজাইডিং অফিসারসহ মোট সাতজন। স্থানীয় সূত্র জানায়, বাঘাইছড়ি সাজেকের কংলাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ভোট গণনা শেষে ওই কেন্দ্রে দায়িত্বরতরা ভোট বাক্স নিয়ে উপজেলা পরিষদে ফিরছিলেন। এ সময় নির্বাচনী কাজে দায়িত্বরতদের বহনকারী চারটি গাড়ি ছিল। প্রথম গাড়িতে বিজিবি সদস্যরা ছিলেন ওই গাড়িগুলোকে নিরাপদে নেয়ার জন্য। দুর্বৃত্তরা পেছনের গাড়িটিতে হামলা চালায়। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় আহতদের ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিএমএইচ এ চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ঘটনার ১২ ঘণ্টার মধ্যে গতকাল সকালে রাঙ্গামাটির বিলাই ছড়িতে নিহত হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরেশ কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা। গতকাল সকালে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, এ ঘটনার সাথে জেএসএস সন্তু গ্রুপের সদস্যরা জড়িত। বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সন্তু গ্রুপের বড় ঋষি চাকমা চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি এর আগে চেয়ারম্যান ছিলেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জেএসএস সংস্কার গ্রুপের সদস্য (এমএন লারমা) সুদর্শন চাকমা। তিনি এমএন লারমা গ্রুপের কেন্দ্রীয় ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সুদর্শনকে সমর্থন দিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। সুদর্শন ঘোড়া প্রতীক নিয়ে ২৪ হাজার ৮৭৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। আর বড় ঋষি চাকমা ভোট পেয়েছেন ১ হাজার ৩৭২। এর আগে দুপুরের দিকেই বড় ঋষি চাকমা ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। তার সাথে ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সমিরন চাকমা এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সুমিতা চাকমাও ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। তারাও জেএসএস সন্তু গ্রুপের প্রার্থী ছিলেন। এদিকে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বড় ঋষি চাকমা ভোট বর্জনের পর দেয়া বিবৃতিতে বলেছেন, এ পরিস্থিতিতে যদি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে তবে তার দায়দায়িত্ব সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে নিতে হবে। তার এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় প্রশাসন বলেছে, তিনি ঘোষণা দিয়ে এ খুনের ঘটনা ঘটিয়েছেন।

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, পার্বত্য অঞ্চলে আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে খুনোখুনি লেগেই আছে। সম্প্রতি জেএসএস সন্তু গ্রুপের সাথে গোপনে আঁতাত করেছে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপ। নিজের স্বার্থে তারা এক হয়েছে। নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ওপর আক্রমণের ঘটনায় সন্তু গ্রুপকে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপ সহায়তা করেছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, বড় ঋষি চাকমার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এর আগে তিনি সার্জেন্ট মুকুল চাকমা অপহরণের ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিলেন। মুকুল চাকমা সাবেক সেনা সদস্য। ২০১৬ সালের ৩০ মে বাঘাইছড়ি উপজেলার লাইল্যাঘোনা বক্ষাচাকমার বাড়ি হতে তাকে অপহরণ করা হয়। ওই ঘটনায় বড় ঋষি চাকমা ছাড়াও জেএসএস সন্তু গ্রুপের প্রভাত চাকমা, ত্রীদিব চাকমা ও অজয় চাকমাকে আসামি করা হয়েছিল। সার্জেন্ট মুকুলের খোঁজ মেলেনি এখনো।
স্থানীয় সূত্র জানায়, জেএসএস সন্তু গ্রুপ ও ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপসহ পাহাড়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা এখন বেপরোয়া। পাহাড়ে খুন, জখম, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ সব অপরাধের সাথে এই সশস্ত্র গ্রুপগুলোর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

এদিকে, বাঘাইছড়ি থানার ওসি এম এম মঞ্জুর গতকাল সন্ধ্যায় নয়া দিগন্তকে বলেন, সাত খুনের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। লাশগুলোর ময়নাতদন্ত করে সেগুলো পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিতেই একদিন চলে গেছে। একটি লাশ এখনো পরিবারের কাছে দেয়া সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, মামলার প্রস্তুতি চলছে। হয়তো রাতেই মামলা দায়ের হবে। এ ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি।

এদিকে, বড় ঋষি চাকমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, চলমান শান্তি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার মাধ্যমে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাকে বাধাগ্রস্ত ও সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বিশেষ কোন গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top