একটি শব্দের অপমৃত্যু

হত্যা, আত্মহত্যা কিংবা দুর্ঘটনাজনিত কারণে মারা গেলে তা ‘অপমৃত্যু’ । দেশে এর জ্বলন্ত উদাহরণ সড়ক দুর্ঘটনা, যা প্রতিনিয়ত ঘটছে। প্রাণ হারাচ্ছে হাজারো মানুষ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অপমৃত্যুর হার বেড়ে গেলে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বাম নেতা নির্মল সেন সেই সময় দৈনিক বাংলায় লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ শিরোনামে একটি কলাম। তা এখনো জনসভায় বহুল উচ্চারিত। তাই বলে শব্দের অপমৃত্যু- এ আবার কেমন কথা? আমাদের জানা মতে, বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। প্রচুর ধ্বনি আছে, যাতে মন জুড়িয়ে যায়; ভরে ওঠে প্রাণ। অনেকে প্রিয় শব্দ বলে পান প্রশান্তি। তেমনি একটি শব্দ ‘লজ্জা’। এর অর্থ লাজ বা শরম। লজ্জা বোধ করলে লাজুক, শরমিন্দা। সবগুলোই শ্রুতিমধুর। এসব শব্দের ব্যবহার হয় হরহামেশা। এতে বাক্যের গাঁথুনি হয় মজবুত।

কথায় আছে- লজ্জা নারীর ভূষণ। ইদানীং জেন্ডার বায়াস আখ্যায় পরিত্যাজ্য। সমাজে যখন নারী ছিল উপেক্ষিত, শুধুই অবলা, তখন এটি না হয় মেনে নেয়া হতো। কিন্তু দিন বদলেছে। চলমান বাস্তবতায় ‘নারীর ক্ষমতায়নে’র এই যুগে এসব সেকেলে কথা; পুরুষালি মানসিকতার দোষে দুষ্ট। এমন কথা মানলে, চম্বলের রানীখ্যাত ভারতের ফুলন দেবী দস্যুরানী হতে পারতেন না। ভারতে উচ্চবর্ণের দাপটে মিডিয়ায় তার দস্যু হয়ে ওঠার পেছনের কাহিনী খুব একটা আলোচনায় আসেনি। ভারতীয় জাতপাতের সমাজে বর্ণ হিন্দুদের হাতে নিষ্ঠুরভাবে নিগৃহীত হয়ে তীব্র প্রতিশোধস্পৃহায় ফুলন নারী হয়েও বেছে নেন দস্যুতার জীবন। হয়ে ওঠেন উত্তর প্রদেশের চম্বলের সাধারণের ‘নয়নের মণি’। দস্যুতা ছেড়ে ভোটে লড়ে হন লোকসভার সদস্য। কিন্তু ঘাতকের বুলেট তার বুক ঝাঁজরা করে দেয়। ফুলনের জীবনী অবলম্বনে নির্মিত হয় জনপ্রিয় মুভি। এবার ডাকসুর ভোট গ্রহণের দিন রোকেয়া হলের কিছু ছাত্রী ডাকসুর ভিপি প্রার্থী- পরে নির্বাচিত নুরুল হক নূরকে যেভাবে ধোলাই দিলেন!

উল্লিখিত সিনেমাটি দেখে থাকলে তারা অনুপ্রাণিত হতেও পারেন। মেয়েদের হাতের চড়-থাপ্পড় খেয়ে বেচারা নূর কেন যে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, তার মাজেজা অজানা। তার মার খাওয়ার খবর গণমাধ্যমে পড়ার সময় কিরণ চন্দ্র রায়ের গাওয়া জনপ্রিয় বাংলা গান- ‘চিনি মিঠা, মিষ্টি মিঠা, মিঠা দুধের সর/ তার চেয়ে অধিক মিঠা মেয়েদের নরম হাতের চড় রে, নরম হাতের চড়’ এই কলি মনে পড়ে যায়। আড়াই দশক আগে ঢাবিরই এক অনুষ্ঠানে গানটি যখন কিরণ গাইছিলেন, অনেক তরুণী তাদের প্রিয়তমের গালে মারছিলেন আলতো চড়। প্রিয়তম তরুণ বত্রিশ দাঁত বের করে হাসছিলেন। কারণ, এর আনন্দ ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। নূরের বেলায় কেন যে এমন হলো না! এ কথাও ঠিক, দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা যেভাবে বেড়েছে, তা থেকে আত্মরক্ষায় রোকেয়া হলের ওই সব তরুণী কুংফু-কারাতে শিখলে হাত একটু শক্তপোক্ত হতে পারে, ফলে নূরের একটু ব্যথা পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সেই ধকল সামলাতে না পেরে হাসপাতালে যাওয়া। হাজার হোক, মানুষের শরীর। এ দিকে রোকেয়া হলের প্রভোস্টও ভোট গ্রহণের দিন ছিলেন বড়ই দায়িত্ববান! ছাত্রী হলে নূর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে অযাচিতভাবে ঢুকে পড়লে এক শিক্ষার্থী ঠুকে দেন মামলা। অন্য দিকে কুয়েত মৈত্রী হলের প্রভোস্টের মদদে রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে তা দিয়ে বাক্স ভরায় ‘এমন কী হয়েছে’? তাই বলে বহিষ্কার করতে হবে?

পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করে আনা অনেকের একধরনের নৈতিক দায়িত্ব! এসব কাজে নারীর ‘অবলা’ অপবাদ ঘুচেছে, এটি কি কম পাওয়া? এসব দেখে স্বল্পশিক্ষিতরা বলছেন- ‘লজ্জা’ শব্দটির অর্থ জনমানসে কিছুটা ম্নান হয়ে পড়েছে। এমন কথায় সায় দেয়া যায় না। ইতিহাসে নির্বাসনেরও ইতিবাচক দিক খুঁজে পাওয়া যায়। এর বড় উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্র। ১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করার পর গ্রেট ব্রিটেন থেকে দাগী আসামি আখ্যা দিয়ে লোকজনকে নির্বাসনে পাঠানো হতো আমেরিকায়। ওদের আন্দোলনেই ব্রিটিশ রাজ থেকে ১৭৭৬ সালে জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে স্বাধীনতা লাভ করে আজকের আমেরিকা।

লজ্জা শব্দটি সমকালে আর প্রাসঙ্গিক কি না, সন্দেহ-সংশয় দেখা দেয়া স্বাভাবিক। শব্দটি মর্মার্থ হারাতে বসেছে বলেই মনে হয়। এর ব্যবহার নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। শব্দটির গতি-প্রকৃতি নিয়ে চিন্তিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বাস্তবে সমাজজীবনে শব্দটির থাকার প্রয়োজনীয়তা হয়তো ফুরিয়ে এসেছে। মাঝে মধ্যে মনে হয়, কেবল অভিধানের পাতায় শব্দটি সুন্দর করে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার সব আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছি আমরাই। অদূর ভবিষ্যতে প্রতিভাধর কোনো কবি কখনো পুরনো, অপরিচিত বা অব্যবহৃত শব্দ হিসেবে কবিতায় প্রয়োগ করে সৃষ্টি করবেন ভিন্ন ব্যঞ্জনা। ছন্দে আনবেন দ্যোতনা। কথাসাহিত্যিকেরা পরখ করে দেখবেন। মনে ধরলে ভাষায় গতি আনতে ব্যবহার করবেন। এর বেশি কিছু নয়। কয়েক দশক আগে ‘লজ্জা’ উপন্যাস লিখে তসলিমা নাসরিন হন দেশান্তরী। এখন অবস্থা যা দাঁড়িয়ে তাতে লজ্জা শব্দটি নিজেই নির্বাসনে যাওয়ার উপক্রম। এমন ভাবনা আসে, যখন দেখি- রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে অনেকে অবলীলায় প্রকৃত ঘটনার উল্টোটি বলেন, তখন। তারা বলেন এমন সব বেফাঁস কথা, যা শুনলে যে কেউ বলে উঠবেন, লোকটার শরম-লজ্জা বলে কিছু নেই।

দেশের হর্তাকর্তাদের মন্তব্য পরখ করলে ভাবনার ডালপালা ডানা মেলে। আপন মনে উচ্চারিত হয়, বাংলা ভাষায় ‘লজ্জা’ বলে আদৌ কোনো শব্দের প্রয়োজন রয়েছে কি না। প্রাসঙ্গিকতা হারালে তা ওই শব্দের অপমৃত্যুই বলা চলে।

কয়েকটি ঘটনায় অগণন মানুষের মন বিষিয়ে ওঠে। গত ‘৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ নিয়ে সিইসি বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন রেকর্ডে রাখার মতো সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে জাতীয় তথা সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত অভাবনীয় রকম, একপেশে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে পরপর তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। নানা অনিয়মে ভরা ওই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়নি।’ ‘কান্ট্রি রিপোর্ট অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন মন্তব্য করা হলো।

এ দিকে দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমের বয়ানও ছিল সিইসির সে দাবির বিপরীত। এ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। মানুষ তাই ভোট দেয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আগের রাতেই যেখানে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলা হয়, কেন্দ্রে গিয়ে ভোটারকে শুনতে হয়, ‘ভোট দেয়া হয়ে গেছে, বাড়ি চলে যান’; সেখানে কে কষ্ট করে ভোট দিতে যাবেন?

কিন্তু ডাকসুর ব্যাপারটা ভিন্ন হতে পারে বলেই অনেকের ধারণা ছিল। সবার আশা ছিল, নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু হতে পারে। ভরা পেটে বাঘ-সিংহও তো শিকার ধরে না। কিন্তু তা হয়নি, বরং ঢাবি প্রশাসন বিশেষ ছাত্রসংগঠনের প্রার্থীদের বিজয়ী করে আনার সব রকম উদ্যোগ-আয়োজন সম্পন্ন করে রেখেছিল। বাস্তবে তাই করে দেখাল। বাংলাদেশের রাজনীতির যে লেজেগোবরে অবস্থা, তার কোনো অবয়ব এমনকি রাজনীতিকেরাই বোধহয় ঠাওর করতে পারছেন না।

এমন বাস্তবতায় ঢাবি ভিসি বলেছেন, দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া খুবই উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণভাবে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ‘গণতন্ত্রের রীতিনীতি অনুসরণ করেই সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে’ দেখে খুশি হয়েছেন তিনি। ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিল, কর্তৃপক্ষের একগুঁয়েমির কারণে তা অপূর্ণ থেকে গেল। দেশবাসী আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ, পক্ষপাতমূলক ও অনিয়মে দীর্ণ নির্বাচন প্রত্যক্ষ করলেন।

এ দিকে এক বক্তব্যে সিইসি বলেছেন, ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হলে আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ভরে রাখার কোনো সুযোগ থাকবে না।’ সত্যিই সেলুকাস বিচিত্র এই দেশ! এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, সিইসি তার বক্তব্যের মাধ্যমে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিলেন যে, আগের রাতে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার ঘটনা ঘটেছে।

সকারের উচ্চপর্যায়ের দাবি, ‘গায়েবি’ মামলা বলে কিছু নেই। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই অপরাধী। প্রতিটি মামলা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে করা হয়েছে। কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে সে নিরপরাধ, কিন্তু তার নামে মামলা হয়েছে, তাহলে নিশ্চয়ই সেই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ প্রশ্ন জাগে, তাহলে পঙ্গু তারা মিয়ারা সত্যিই পুলিশের ওপর হামলা করেছেন?

গায়েবি মামলা সম্পর্কে ঠিক এর বিপরীত বক্তব্য মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়েছে, বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের অব্যাহত ছিল গত বছর। নির্বাচনের সময় বিএনপির চার লাখ ৩৫ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী সংগঠনগুলোর বরাতে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

আরেক ঘটনায় সবার চোখ ছানাবড়া। ঘটনাটি সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেয়া। জাতীয় নির্বাচনের আগে তিনি যেসব জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়েছেন তার সাথে এই শপথ নেয়া কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ তা জনমনে বড় জিজ্ঞাসা। লেখার শুরুতে একটি শব্দের অপমৃত্যুর কথা বলায় মনে হয়েছিল- এর সপক্ষে কোনো দলিল পেশ করা যাবে না। উপরের ঘটনাগুলোর সূত্রে শেষমেশ কিছু হলেও তথ্য-উপাত্ত মিলেছে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top