ক্রাইস্টচার্চ : নিজের জীবন তুচ্ছ করেও তারা অন্যদের রক্ষার চেষ্টা করছিলেন

নিউজিল্যাণ্ডের ক্রাইস্টচার্চে আল নুর মসজিদে গত শুক্রবারের সন্ত্রাসবাদী হামলার সময় কীভাবে সেখানে আক্রান্ত নারী-পুরুষরা একে অন্যের জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন তুচ্ছ করেছিলেন, সেসব কাহিনী এখন প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।

সেদিন আল নুর মসজিদে নিহতদের একজন ছিলেন বাংলাদেশী নারী হোসনে আরা। তার বেঁচে যাওয়া স্বামী ফরিদ উদ্দীন বিবিসিকে বলেছেন কীভাবে নিজের জীবন তুচ্ছ করে অন্যদের এবং স্বামীর জীবন বাঁচাতে গিয়ে সেদিন নিহত হন হোসেন আরা।

ক্রাইস্টচার্চ মসজিদ হামলায় বেঁচে যাওয়া ফরিদ উদ্দীন বলেছেন সেদিনের ঘটনায় কীভাবে স্ত্রীকে হারালেন তিনি।
ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া স্বামী ফরিদ উদ্দীন বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, কীভাবে তার এবং অন্যদের জীবন বাঁচাতে সেদিন হোসনে আরা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন।

প্রতি শুক্রবারের মতো সেদিনও জুমার নামাজ পড়তে স্ত্রী হোসনে আরাকে সাথে নিয়ে আল নুর মসজিদে গিয়েছিলেন ফরিদ উদ্দীন।

তাকে চলাচল করতে হয় হুইলচেয়ারে। কারণ বেশ কয়েক বছর আগে একটি দুর্ঘটনায় দুই পা হারিয়েছেন।

মসজিদের বাইরে গাড়ি রেখে তারা স্বামী স্ত্রী ভেতরে ঢুকেছিলেন। হুইলচেয়ার ঠেলে স্বামী ফরিদ উদ্দীনকে পুরুষদের মূল হলঘরের দিকে পৌঁছে দিয়ে হোসনে আরা চলে গেলেন মেয়েদের প্রার্থনা কক্ষে।

তারপরই ঘটলো সেই ভয়ংকর ঘটনা, মসজিদের ভেতরে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করলো হামলাকারী ব্রেন্টন ট্যারান্ট।

”শুটিং শুরু হয়েছে হলওয়ে থেকে। হলওয়ের এক সাইডে ছিল লেডিস রুম। আমার ওয়াইফ ওখানে বেশ কিছু লেডিস ও চিলড্রেনদের বাঁচানোর জন্য ওদের গেট দিয়ে বের করে মসজিদের বাম সাইডে একটা নিরাপদ জায়গায় এদেরকে রেখে ও ফিরে আসছিল আমাকে সাহায্য করার জন্য। ও যখন ফিরে আসতেছিল তখন গেটের কাছে ওকে গুলি করা হয়েছে।”

নিজের স্ত্রীকে হারানোর শোক এখনো সামলে উঠতে পারেননি মিস্টার ফরিদ উদ্দীন এবং তার পরিবার। কিন্তু তার মধ্যেও অন্যদের বাঁচাতে স্ত্রীর এই আত্মত্যাগ তাকে কিছুটা হলেও মানসিক প্রশান্তি দিয়েছে।

তিনি বলেছেন আমার স্ত্রী ”অত্যন্ত জনদরদী মহিলা।” মানুষকে বাঁচানোর জন্য তিনি যেভাবে প্রাণ দিয়েছেন এটা খুবই গর্বের বলে তিনি মনে করেন।

”ও যেরকম ভাল মানুষ ছিল – ও কিছু ভালো কাজ করে চলে গেছে। এখন ও হাসতেছে। কিন্তু মানুষ ওর জন্য কাঁদবে।”

বাংলাদেশের সিলেট থেকে এসে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদতম একটি দেশে এসে নতুন জীবন গড়ে তুলেছিলেন ফরিদ উদ্দীন এবং তার স্ত্রী হোসনে আরা।

কিন্তু সেখানে এসে তাদের যে নির্মম ট্রাজেডির মুখোমুখি হতে হলো, তারপর নিউজিল্যান্ডকে কি তিনি আর আদৌ নিরাপদ বলে মনে করেন?

ফরিদ উদ্দীন বলেছেন, গুটিকয় বিভ্রান্ত লোকের কাজ দিয়ে তিনি একটা পুরো দেশকে বিচার করতে রাজি নন।

ফরিদউদ্দীন মনে করেন, গত শুক্রবার ক্রাইস্টচার্চে যাই ঘটুক, নিউজিল্যান্ড যে একটি শান্তিপূর্ণ দেশ, নিউজিল্যান্ডের মানুষ যে শান্তিপ্রিয়, তার সেই বিশ্বাসে বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি।

হোসনে আরা ফরিদ
সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষিপাশা ইউনিয়নের, জাঙ্গাঁলহাটা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন হোসনে আরা ফরিদ।

বয়স ৪৫ বছরের মতো, বলেছেন তার ভাগ্নে দেলোয়ার হোসেন। তবে তারা একই সাথে বড় হয়েছেন কারণ বয়স তাদের কাছাকাছি।

১৯৯৪ সাল থেকে নিউজিল্যান্ডে থাকতেন হোসনে আরা ফরিদ।
দেলোয়ার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশে ছিলেন। সে বছর বিয়ের পরই তিনি স্বামীর সাথে নিউজিল্যান্ডে চলে যান। এরপর থেকে সেখানেই থাকতেন। নিউজিল্যান্ডেই তাদের একটি মেয়ে হয়েছে। যার বয়স এখন ১৪ বছর।

দেলোয়ার হোসেন বলছেন, “আমাদের এক মামী নিউজিল্যান্ডে থাকেন। তার কাছে খবরটি শোনার পর হাত পা অবশ হয়ে গিয়েছিলো। এটা কি শুনলাম? এই ধরনের কিছু শোনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।”

তিনি বলছেন, কিছু দিনের মধ্যেই তাদের দেশে বেড়াতে আসার কথা ছিল।

দেলোয়ার হোসেন বলছেন, “উনি আমার থেকে দুই বছর বড় ছিলেন। ওনার সাথে আমার চমৎকার একটা সম্পর্ক ছিল। খুবই হাস্যোজ্জ্বল আর দিলখোলা মানুষ ছিলেন।”
সূত্র : বিবিসি

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top