দুই দ্বীপ নিয়ে গঠিত দেশ নিউজিল্যান্ড। এর উত্তরের দ্বীপে নিউজিল্যান্ডের রাজধানী শহর ওয়েলিংটন আর দক্ষিণের দ্বীপের সবচেয়ে বড় শহর ক্রাইস্টচার্চ। এবার ১৫ মার্চ সেই ক্রাইস্টচার্চ উঠে আসে বিশ্বজুড়ে শিরোনামে- ‘মসজিদে বন্দুকধারীর হামলা’। শহরের মধ্যে দুটো মসজিদে জুমার নামাজের সময় এক সন্ত্রাসী হামলা চালায়। মিডিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, হামলাকারীর নাম ‘ব্রেন্টন ট্যারান্ট’। সে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। তবে প্রায়ই পাশের নিউজিল্যান্ডে আসে। খ্রিষ্টান এবং হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট বা সাদা চামড়ার লোকদের কথিত শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, এই হামলায় বেপরোয়া গুলিবর্ষণে ৪৯ জন ইতোমধ্যেই মৃত, আরো প্রায় ২০ জন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিডিয়ায় বলছেন, ‘এটা খুবই পরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলা’। অর্থাৎ তিনি ‘মুসলমানেরাই ভিকটিম’ বলে এটাকে ‘টেররিজম’ বলবেন কি না এমন দ্বিধা দেখাননি। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীও এটাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিবৃতিতে এটাকে ‘টেররিজম’ বলা হয়েছে। এমনকি ভারত বা কানাডার সরকারও। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এটাকে খুবই পরিকল্পিত বলছেন কেন? আর একটা বিশেষ দিক হলো, এই হামলার পুরো সময় ১৭ থেকে ২০ মিনিটের; যার ১৭ মিনিটেরই লাইভ শো ফেসবুকে দেখানো হয়েছে। আর তা এমন ভয়ডর-পরোয়াহীন তাণ্ডব যে, রাইফেলের মাথায় বসানো ক্যামেরা থেকে নেয়া অনলাইন লাইভ ছবিÑ নামাজ পড়তে আসা অসহায় মুসল্লিদের প্রতি গুলি ছোড়ার লাইভ ছবি সাথে সাথেই ফেসবুকে প্রচারিত হচ্ছিল। এ ছবিগুলো যে লাইভ সম্প্রচার হচ্ছিল তা এএফপি নিজেরা পরীক্ষা করে আমাদের নিশ্চিত করে এই রিপোর্ট ছেপেছে।
হামলাকারী কে বা কারা? তাদের রাজনৈতিক বা চিন্তাগত পরিচয় কী? পুলিশ বলছে, হামলাকারীরা মোট চারজন, যার তিনজনই সম্ভাব্য সহযোগী। আর চতুর্থজন যে দৃশ্যমান হামলাকারী ব্রেন্টন ট্যারান্টÑ তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে হামলার পরই এবং মানুষ হত্যার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। অন্যদের নিয়ে তদন্ত চলছে। ২০১১ সালে প্রায় একই ধরনের ঘটনায় নরওয়েতে ৭৭ জন মানুষ হত্যা করেছিল এন্ডার ব্রেভিক। হামলাকারী ব্রেন্টনের পছন্দের ব্যক্তিত্ব যারা তাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন বলে জানিয়েছে, এমন দুই ব্যক্তি সেই ব্রেভিক ও আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। অনুমান করা যায়, এর মূল কারণ এরা দু’জনই হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট চিন্তা ধারণ করেন। এ ছাড়া গরিব দেশ থেকে মানুষের যুদ্ধের শরণার্থী হওয়াসহ নানা কারণে পশ্চিমের দেশে বসবাস করতে আসাকে অনুমোদন দেয়ার সে তীব্র বিরোধী।
কোনো প্রমাণ না থাকলেও এরা প্রচার-প্রপাগান্ডা করতে ভালোবাসেন যে, মাইগ্রেন্টরা শহর নোংরা করে থাকে আর শহরে সব অপরাধের জন্য দায়ী হলো এরা। শুধু তাই নয় তারা বিশ্বাস করে, সাদা চামড়ার জনগোষ্ঠী ছাড়া বাকিরা বেশি বেশি সন্তান পয়দা করে। ফলে কোনো সাদা চামড়ার দেশে এরা সহজেই তাদের ছাড়িয়ে জনসংখ্যায় বেশি হয়ে যায়। তাই সাদা চামড়ার জনগোষ্ঠী ছাড়া এমন ‘অপর’দের বোঝাতে তারা একটা শব্দ ব্যবহার করে থাকে- ‘ইনভেডর’, আগ্রাসী মানে হামলাকারী। হামলাকারী ব্রেন্টন ও তার বন্ধুরা কথিত হামলাকারীদের হত্যা করা তাদের টার্গেট ও বৈধ মনে করে থাকে। বাস্তবে তারা ইনভেডর বলতে মুসলমান জনগোষ্ঠীকেই বুঝিয়েছে। অনেকটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির মতো। তিনিও বাংলাদেশ থেকে ভারতে কথিত মাইগ্রেন্টদের ব্যাপারে ‘মুসলমান’ এবং ‘অনুপ্রবেশকারী’ বা কখনো ‘তেলাপোকা’ ইত্যাদি অমর্যাদাকর শব্দ ব্যবহার করেন।
রয়টার্স এবং এএফপি আমাদের জানাচ্ছে যে, এক মাস ধরে ফেসবুক ও টুইটারে ব্রেন্টন একটা গ্রুপ হিসেবে প্রকাশ্যেই সক্রিয় ছিল। ‘যে কেউ’ বা এনোনিমাস হিসেবে তারা একটা গ্রুপ চালিয়ে গেছে, যে গ্রুপের নাম ‘8chan’ ফোরাম। এই গ্রুপ যে খুলেছে, তার নাম হিসেবে দেখা যাচ্ছে, হামলাকারী ব্রেন্টন ট্যারান্টের নাম। একই ‘মালিক’ হিসেবে একই নামে এক টুইটার অ্যাকাউন্টও আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই হামলার পুরো বর্ণনা এখান থেকেই দেয়া হয়েছে। কেন এই হামলা তা বিস্তারে বর্ণনা করতে তাদের ‘ম্যানিফেস্টো’ বলে ৭৪ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট এই সাইট থেকে নামিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর শিরোনাম হলো- ‘The Great Replacement’। বলা হয়েছে, এই ম্যানিফেস্টো লিখতে প্রণোদনাদাতাদের নাম হলো ‘হোয়াইট জেনোসাইড’। মানে এরা নিজেদের ‘সাদা গণহত্যাকারী’ বলে ডাকছে। সাধারণত ‘হোয়াইট সুপ্রিমিস্টরা’ নিজেদের ‘সাদা গণহত্যাকারী’ বলে থাকে। এ ছাড়া, নিজেদের বিদেশী বা মাইগ্রেশনবিরোধী এবং সংশ্লিষ্ট কিছু ধারণা যেমন ডাইভারসিটি (বহুমুখিতা) বা মাল্টিকালচারিজমের ঘোরতর বিরোধী বলে থাকে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্রিটেন রাষ্ট্রনীতি হিসেবে ‘মাল্টিকালচারিজম’ মেনে চলা তাদের জন্য সঠিক নীতি বলে মনে করে থাকে। কিন্তু ফ্রান্স ঘোষিতভাবেই মাল্টিকালচারিজম অপছন্দ করে থাকে। এর বদলে তাদের পছন্দ হলো ‘আত্মীকরণ’ নীতি। মূল বিষয় হলো, ইউরোপের ব্রিটিশ-ফরাসিসহ সবাই আমাদের মতো দেশকে এককালে কলোনি বানিয়ে, দখল করে লুটতে গিয়েছিল। সেই সূত্রে সস্তা শ্রম পাওয়ার লোভে তারা কালো চামড়ার নেটিভদের কালক্রমে নিজ নিজ দেশেও নিয়ে গিয়েছিল।
‘নেটিভরা’ এক সময় কলোনি মালিকের দেশেই স্থায়ীভাবে পরিবারসহ নাগরিক হিসেবে বসবাস শুরু করেছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের ভাটায় এই নেটিভরাই এখন চক্ষুশূল হয়ে গেছে। কলোনি মালিকের দেশের নিম্ন-মধ্যবিত্তরা নেটিভদেরকেই প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী বলে গণ্য করছে। তাই ফরাসি নীতি হলো, সবাইকে ফরাসি হতে হবে, নেটিভরা নিজ দেশ থেকে আনা সংস্কৃতিই ফেলে দিতে হবে বা ফরাসি কালচারের অধস্তন হতে হবে। তদুপরি, নিজ (বিশেষত ইসলাম) ধর্ম পালনও যেন বা ফরাসি কালচারের অধস্তন হয়ে পালন করতে হবে; এমন করতে বাধ্য করা। ফরাসি দেশে বোরকা আইনত নিষিদ্ধ এ ‘যুক্তি’তেই।
হোয়াইট সুপ্রিমিস্টরা হিটলারেরও ভক্ত। যেমন এরা হিটলার বা তার সংগঠন নাৎসি পার্টির নানান চিহ্ন বা প্রতীক ব্যবহার করে থাকে। হিটলারের বাণী নিজেরা পুনর্ব্যবহার করে। হামলাকারী ব্রেন্টন ট্যারান্টের রাইফেলের গায়ে এর ওপরে কমপক্ষে ছয়টা নাম ও সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আঁকা আছে। এর একটি হলো ‘ফরটিন ওয়ার্ডস’ (Fourteen Words) চৌদ্দ শব্দের এক বাণী ‘We must secure the existence of our people and a future for white children.’ এটাকে অনেকে হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের একটা ‘মন্ত্র’ বলে থাকে। এখানে ‘our people’ বা ‘white children’ বলে এরা বর্ণবিদ্বেষ জাগানোর চেষ্টা করে থাকে।
ব্রেন্টনের মতো হোয়াইট সুপ্রিমিস্টরা বলতে চায় তারা মাইগ্রেশনবিরোধী। কিন্তু আসলেই কি তাই?
আমেরিকা, কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ড এসব রাষ্ট্রের আদি বাসিন্দা কারা আর কারা এর অবৈধ দখলদার? অথবা তাদের ভাষায় অনুপ্রবেশ করে মামলাকারী? নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী হলো ‘মাউরি’রা। ইউরোপ থেকে বিশেষত ডাচ বণিক ‘আবেল তাসমান’ প্রথম ইউরোপীয়, যিনি মাউরি সভ্যতা ও এর ভূমির সন্ধান পাওয়ায় পরবর্তী সময়ে ‘নিউজিল্যান্ড’ নাম দিয়ে দখল করে কালক্রমে নিউজিল্যান্ডে ইংল্যান্ডের কলোনি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ইউরোপীয় সাদা চামড়ার লোকজনই কি অনুপ্রবেশকারী নয়? হামলাকারী ব্রেন্টন নিজেই (বা তার পূর্বপ্রজন্ম) অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডে আসল অনুপ্রবেশকারী। হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের নিজেকে না বলে (মুসলমানসহ) অন্য কাউকে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলা প্রহসন মাত্র।
সারকথা : আমাদের যথেষ্ট মাথা তুলে যেটা দেখতে হবে যে, হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের উত্থান কেন এখন দেখা যাচ্ছে? তারা অটোমানদের সাম্রাজ্যের প্রতি ঘৃণা অথবা ইউরোপিয়ান খ্রিশ্চানিটির জেরুসালেম দখল চেষ্টার অতীত লড়াইগুলোকে এখন কেন রেফারেন্সে আনছে?
আমরা গ্লোবাল অর্থনীতির ইতিহাস মোটা দাগে তিনটি পর্বে ভাগ করে বুঝতে পারি। প্রথম পর্বÑ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত; যেটাকে কলোনি অর্থনীতির যুগ বলা যেতে পারে। দ্বিতীয় পর্ব হলো- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ থেকে গত শতাব্দী (বিশ শতক) পর্যন্ত আমেরিকার নেতৃত্বে গ্লোবাল অর্থনীতির যুগ। আর তৃতীয় পর্বকে বলা যায়, চলতি শতকে আমেরিকান নেতাগিরির পতন আর ক্রমেই সেই জায়গা নিতে চীনের উত্থিত নেতৃত্ব।
পশ্চিমের, বিশেষত ইউরোপের অর্থনীতি ভালো চলছে কি না বোঝার সহজ নির্ণায়ক হলো মাইগ্রান্ট ইস্যু। অর্থনীতি ভালো চললে দেখা যাবে, সবাই ভুলে যায় মাইগ্রান্ট একটি সমস্যা। কারণ, তখন পশ্চিমের বাড়তি শ্রম দরকার। আর অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিলেই মাইগ্রান্ট বিষয়টিকে মানে, ওই বাড়তি শ্রমের বিষয়টিকে পাশ্চাত্য এক বিরাট সমস্যা মনে করে থাকে। তাদের মধ্যবিত্তরা মাইগ্রান্টদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে বা ফরাসি নেতা মেরিন লি পেনের উগ্র ন্যাশনালিস্টরা (হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের) মধ্যবিত্তকে ক্ষেপিয়ে তোলে।
গ্লোবাল অর্থনীতির ইতিহাসের দ্বিতীয় পর্বে এসে আমেরিকার নেতৃত্বের হাতে ইউরোপ এর আগে নিজেদের কলোনি শাসনের অর্থনীতির সমাপ্তি ও সমর্পণের ঘোষণা দিতে হয়েছিল।
এখন চীনা উত্থানের পর্বে এসে ইউরোপ বিশেষ করে ফ্রান্স আরেক দফা (তবে এবার আমেরিকাসহ) চীনেরও পেছনে থাকতে শুরু করতে যাচ্ছে। এরই প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপে এক ধরনের রাজনীতি দেখা যাচ্ছে। দাবি উঠছে আগের কলোনি যুগ সবচেয়ে ভালো ছিল। কারণ, সেটা ছিল শান-শওকতের যুগ। তাই কলোনি লুণ্ঠনের সেকালে ফিরে যেতে হবে।’ ইউরোপের প্রবীণ প্রজন্ম এখন তরুণদের কাছে সাদা চামড়ার সুপ্রিমেসির গল্প শুনিয়ে উসকানি দিচ্ছে।
সময় কখনো পেছনে ফেরে না। কলোনি লুণ্ঠন একালে আবার বৈধ বলে দাবি করা, সাদা চামড়ার বর্ণবাদের শ্রেষ্ঠত্ব একালে আবার ন্যায্য বলে সাফাই গাওয়া- এসব অসম্ভব। দুনিয়ার অভিমুখ সেটা নয়। এগারো-বারো শতকের জেরুসালেম দখলের জোশ- ক্রুসেডের সেই উসকানি একালে আবার তৈরি করা, সেটাও অসম্ভব। মডার্ন রাষ্ট্র ও শাসন দুনিয়ায় এসে যাওয়ার পরে পুরনো ‘ক্রুসেড’ আর হবে না। যদি তাই হতো তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরে ব্রিটেন জেরুসালেম দখলের চেষ্টায় বারবার হেরে যাওয়ার শোধ তুলতে আবার ক্রুসেড লড়ে জেরুসালেম পেতে চেষ্টা করত। কামালের তুরস্ক গড়ার পথে হাঁটত না; বরং আমরা দেখেছি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্যের পতন সত্ত্বেও ‘মডার্ন রিপাবলিক’ ব্রিটিশ সরকার ‘ক্রুসেড’ শব্দটি মুখেও আনেনি।
আমরা এখন যেমন চাকরি, পড়াশোনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সুবিধা পেতে পশ্চিমমুখী হই, সামনের দিনে ইউরোপীয়দের অন্তত চাকরি বা অধিকতর সুযোগ-সুবিধার জন্য এশিয়ামুখী হয়ে ধাবমান হতে দেখা অসম্ভব নয়।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক