নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ এর আল নুর মসজিদে যখন হামলা হয়, তখন বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের ছেলে ওমর জাহিদ মাসুম (৩৩) ওই মসজিদের ভেতরে ছিলেন। একটি গুলি তার বাম কাধের উপরের দিকে এসে লাগে। এর পর মারা যাওয়ার ভঙ্গিতে রক্তাক্ত মানুষের স্তুপে পড়ে থাকেন তিনি। এভাবে দীর্ঘক্ষণ পড়ে থাকার পর কোনরকমে মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেয়াল ডিঙিয়ে একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে প্রাণে বাঁচেন তিনি।
নিউজিল্যান্ড প্রবাসী ওমর জাহিদ মাসুমের বাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মুমুরদিয়া ইউনিয়নের ধনকীপাড়া গ্রামে। তিনি কটিয়াদীর সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম হাবিবুর রহমান দয়াল এর ছেলে। চার ভাই এবং তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট মাসুম।
ওমর জাহিদ মাসুম বাংলাদেশে থাকার সময়ে অরেঞ্জ বিডি আইটি ফার্মে কাজ করতেন। মিরপুর বাংলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে তথ্য প্রযুক্তিতে (আইটি) তিন বছরের একটি কোর্স করার জন্য ২০১৫ সালের ২৯শে অক্টোবর তিনি নিউজিল্যান্ডে যান। পড়াশোনা শেষ করে সেখানেই একটি সুপার শপ এবং একটি পেট্রল পাম্পে ব্যবস্থাপক হয়ে কাজ করছেন তিনি। ক্রাইস্টচার্চ মসজিদ আল নুর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে সস্ত্রীক বসবাস করেন মাসুম।
ক্রাইসচার্চ হামলা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া মাসুম শনিবার সন্ধ্যায় টেলিফোনে নয়া দিগন্তকে সেই ভয়াবহ হামলার বিবরণ দিয়েছেন।
মাসুম বলেন, ‘জুমার দিন হওয়ায় ওই দিন কাজ শেষ করেছি সাড়ে ১২টায়। কাজ শেষ করে বাসায় আসি। তারপর নামাজে যাই। আল নুর মসজিদ আমার বাসা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূর হলেও সেন্ট্রাল মসজিদ হওয়ায় জুমার নামাজ ওই মসজিদেই পড়ি। মসজিদে দেড়টায় খুতবা শুরু হয়। খুতবা শোনার জন্য প্রতি শুক্রবার একটু আগেই আমি মসজিদে যাই। ঘটনার দিন ১টার মধ্যে মসজিদে পৌছাই । দুইটায় আমাদের জামায়াত। এর মধ্যে ইমাম সাহেব এলেন। আমি দ্বিতীয় সাড়িতে ইমাম সাহেবের ঠিক সোজাসুজি ছিলাম। পাশে ছিলো বাংলাদেশি বন্ধু মুজাম্মেল। আমি বাংলাদেশে যাবো, ও-ও যাবে, এ নিয়ে নামাজের আগে দুজনে কথা বলছিলাম।
এর মধ্যেই ইমাম সাহেব আরবিতে খুতবা শুরু করলেন। কথা বন্ধ রেখে আমরা খুতবায় মনোনিবেশ করি। হঠাৎ পেছন দিক থেকে আতশবাজির মতো একের পর এক আওয়াজ কানে আসতে লাগলো। প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। মানুষ চিল্লাচ্ছে, এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছে। বুঝতে পারলাম খারাপ কিছু হচ্ছে। আমরা মসজিদের প্রধান কক্ষের সামনের দিকে ছিলাম। গুলি শুরু হয় বাইরে থেকে। এক পর্যায়ে এদিকেও গুলি শুরু হলো। প্রাণ ভয়ে আমি মসজিদের ডান দিকের কোণায় গিয়ে আশ্রয় নিলাম। অস্ত্রধারী একের পর এক গুলি করছে। একটা গুলি আমার বাম কাঁধের দিকে এসে লাগলো। গুলিটা চামড়া ভেদ করে বাইরে চলে যায়। ভেতরে ঢোকেনি। কাধে গুলি লাগার পর দম বন্ধ করে আমি মেঝেতে শুয়ে পড়ি। আমি মরার মতো মসজিদের মেঝের সাথে বুক মিশিয়ে একেবারে শুয়ে পড়েছিলাম। কাধ থেকে রক্ত ঝরছিল।
মাসুম বলেন, আমি বেঁচে গেলেও আমার ডান পাশে আমার পরিচিত একজন বয়স্ক লোকের পিঠে এসে একটি গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মারা যান। আমার পিছনে পায়ের দিকে ছিল একটি বাচ্চা সে-ও মারা যায়। বাম পাশে ছিলেন একজন তিনিও মারা গেছেন। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে মরার মতো শুয়ে আছি। কোনোরকম নড়াচড়া করিনি। গুলির শব্দ থামার ৪-৫ মিনিট পর্যন্ত আমি ওভাবেই শুয়েছিলাম। পরে চোখ মেলে দেখি আমার চারপাশে লাশ আর লাশ। এর মধ্যে বেঁচে যাওয়া দুই ভারতীয় বন্ধু আমাকে টেনে উঠালেন। বললাম, আমার খুব ব্যাথা করছে দেখো ভেতরে গুলি-টুলি আছে কি না। ওরা বললো, চামড়া ছিঁড়ে গেছে, ভিতরে গুলি ঢুকেনি। তখনও আতঙ্ক আমাদের কাটেনি। এরপর মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেয়াল ডিঙিয়ে একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিই আমি। আমার ভারতীয় বন্ধুরাও অন্য কোনোখানে আশ্রয় নেয়।’
হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরলেও হামলার ভয়াবহতা ও নৃশংসতায় বার বার আঁতকে ওঠছেন বলে জানান মাসুম। এখনও রীতিমত আতঙ্কে আছেন তিনি।
মাসুম শনিবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘নিউজিল্যান্ডের মতো একটি দেশে এ রকম হামলা হবে জীবনেও ভাবিনি। হামলার পর চিকিৎসা নিয়ে এখন আমি বাসায়। তবে ভুলতে পারিছি না এই ভয়বহ দৃশ্য। মূলত লাশের স্তুপ থেকে আমি বেঁচে এসেছি। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়েছেন। খুতবা শুরুর আগে যার সাথে আমি কথা বলছিলাম- আমার সেই বন্ধু মুজাম্মেলও মারা গেছে। ওর বাড়ি চাঁদপুর। আমরা একই বাসায় থাকতাম।’
মাসুম এই হামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও হামলাকারীর শাস্তি দাবি করেন। সেই সাথে নিউজিল্যান্ডে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন তিনি।