অপচয় করা হারাম

ইসলামের মূল সৌন্দর্যই হলো মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা। ইসলাম যেভাবে অপচয়কে নিষেধ করেছে তেমনি কৃপণতাকেও নিষেধ করে। এ জন্য কুরআন সুন্নাহ মুসলিমদের পানাহার, পরিচ্ছদ, বাসস্থান, সৌর্ন্দয, যোগাযোগের মাধ্যম, বিবাহ-শাদীতে সব কিছুতেই চিহ্নিত করে দিয়েছে। এ জন্যই একজন মুসলিম খরচ করার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিধানাবলী পালন করা আবশ্যক : অর্থনৈতিক দিক যেন মুমিনদের গ্রাস করে না ফেলে, বরং মুমিন ব্যক্তি তার আকিদা ও মুমিনের চরিত্র অনুযায়ী তার অর্থনীতি পরিচালনা করবে। মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে সম্পদ ব্যয় করা; অহঙ্কার বর্জন করা; হারাম থেকে দূরে থাকা; নিয়মতান্ত্রিকতা মেনে সম্পদ ব্যয় করা; সচ্ছলতার সময় অসচ্ছল সময়ের জন্য সম্পদ জমা করে রাখা। একজন মুসলমান শরিয়াহ্ প্রণীত সীমারেখার মধ্যেই তার সম্পদ ব্যয় করবে।

আর এটি ওঠা-নামা করবে বৈধ ও হারামের মধ্যে। এটি হলো বৈধতার পর্যায়ে। যা অপচয় ও কৃপণতার মাঝামাঝি অবস্থান করা। সৌর্ন্দয ও একেবারেই পরহেজগারিতার মধ্যবর্তী অবস্থান কিন্তু বেশির ভাগ লোক এই নীতি গ্রহণ করে না। তারা সৌর্ন্দযের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। এ ক্ষেত্রে অনেকে অপচয়ও করে ফেলে। অথচ মধ্যমপন্থা অবলম্বন করাও আল্লাহর বান্দাদের একটি গুণ। আল্লাহ বলেন, এবং তারা যখন ব্যয় করে তখন অযথা ব্যয় করে না, কৃপণতাও করে না এবং তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী। নবী সা: বলেন, তোমরা খাও, পান করো, দান-সদকা করো, তবে অহঙ্কার ও অপচয় ব্যতীত।

সৌর্ন্দয অবলম্বন করা অবশ্যই বৈধ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, এবং আপনার পালনকর্তার নিয়ামতের কথা প্রকাশ করুন। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, হে বনি আদম, তোমরা সাজসজ্জা করে নাও প্রত্যেক নামাজের সময়, আর খাও পান করো অপব্যয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপব্যয়ীদের পছন্দ করেন না। নবী সা: বলেন, আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের মধ্যে তাঁর দেয়া নিয়ামতের প্রভাব দেখতে ভালোবাসেন। হাদিসটির সনদ হাসান সহিহ্। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষণীয় যে, সৌর্ন্দয যেন সীমা ছাড়িয়ে না যায়। যেন অপচয়ের পর্যায়ে না পড়ে। দুনিয়া বিমুখতা : এটি একটি প্রশংসনীয় গুণ। খুব কম মানুষই এ গুণে গুণাম্বিত। এই গুণে গুণাম্বিত ছিলেন নবী রাসূলগণ আ:, অতঃপর পূর্বেকার অনেক আলেম আর পরবর্তী যুগের খুব কমসংখ্যক লোক।

এই কাজে অবশ্যই নিজের চাহিদা ত্যাগ করতে হয়, নিজের উপরে অন্যকে প্রাধান্য দিতে হয়। আর অর্থনীতির ক্ষেত্রে তা অনেক কল্যাণকর। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যারা মুহাজিরদের আগমনের আগে মদিনায় বসবাস করেছিল এবং ঈমান এনেছিল তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে, মুহাজিরদের যা দেয়া হয়েছে তজ্জন্য তারা অন্তরে ঈর্ষা পোষণ করে না এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তাদের অগ্রাধিকার দান করে। যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত তারাই সফলকাম। কৃপণতা করা হারাম। কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহর শত্রু এমনকি তার নিজেরও শত্রু এবং প্রত্যেক ওই জিনিসের শত্রু যা মানুষের উপকার করে। এভাবে যে সে নিজের প্রয়োজনও পূরণ করে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যারা কৃপণতা করছে তারা নিজেদেরই প্রতি কৃপণতা করছে। নবী সা: বলেন, তোমরা কৃপণতা থেকে দূরে থাকো, কারণ তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনেকেই কৃপণতার জন্য ধ্বংস হয়েছে। (শয়তান) তাদের কৃপণতার আদেশ দিত আর তারা কৃপণতা করত, সে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার আদেশ দিলে তারা তা ছিন্ন করত এবং সে তাদের পাপাচারে লিপ্ত হতে নির্দেশ দিলে তারা তাতে লিপ্ত হতো।

জীবনযাপনের সব ক্ষেত্রেই অপচয় ও অপব্যয় করা হারাম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, এবং অপব্যয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপব্যয়ীদের পছন্দ করেন না। অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ। নবী সা: বলেন, আমার উন্মাতের মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট ব্যক্তি, যারা বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার খায় এবং বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরিধান করে আর লম্বা লম্বা কথা বলে বেড়ায়। এ জন্য সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে ইসলাম সুনির্দিষ্ট নিয়ম বেঁধে দিয়েছে। যেমন : বিলাসবহুল জীবনযাপন না করা। অর্থাৎ দুনিয়ার চাকচিক্য ও বিলাসিতাতে গা ভাসিয়ে না দেয়া। এ ধরনের বিলাসিতাকে ইসলাম সমর্থন করে না বরং নিন্দা করে। আর বিলাসিতার কারণেই আল্লাহর আজাব-গজব নেমে আসে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, যখন আমি কোনো জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি তখন অবস্থাপন্ন লোকের উদ্বুদ্ধ করি অতঃপর তারা পাপাচারে মেতে ওঠে। তখন সে জনগোষ্ঠীর ওপর আদেশ অবধারিত হয়ে যায়। পরিশেষে আমি তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেই। অপচয় না করা আবার সম্পদ ব্যয় করার ক্ষেত্রে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় না দেয়া; সম্পদ ব্যয় করার ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা; হারাম ও ক্ষতিকর পণ্যদ্রব্যাদি বর্জন করা। আল্লাহ তায়ালা ভালো জিনিসকে বৈধ করেছেন আর ক্ষতিকর ও নোংরা জিনিসকে হারাম করেছেন। আর ইসলামী আইনের একটি মৌলনীতি হলো ক্ষতি করবে না ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এ মূলনীতিটি রাসূলুল্লাহ সা:- এর হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত।

অহঙ্কার করো না। যেহেতু ইসলাম ততটুকুই বৈধতা দিয়েছে যতটুকুর মধ্যে ব্যক্তি সমাজ সঠিকভাবে পরিচালিত হয়। অহঙ্কার প্রদর্শনের জন্য সম্পদ ব্যয়কে ইসলাম অনুমোদন করে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে ঈমানদাররা, তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান-খয়রাত বরবাদ করো না সে ব্যক্তির মতো, যে নিজের ধন সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং আল্লাহ পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। অতএব এ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত একটি মৃসণ পাথরের মতো, যার ওপর কিছু মাঠি পড়েছিল। অতঃপর এর ওপর প্রবল বৃষ্টি বর্ষিত হলো, অন্তর তাকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিলো। তারা ওই বস্তুর কোনো সওয়াব পায় না, যা তারা উপার্জন করেছে। আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে পথপ্রদর্শন করেন না। নবী সা: বলেন, যে ব্যক্তি অহঙ্কারবশত তার কাপড়কে ঝুলিয়ে টেনে টেনে পরে, (কিয়ামতের দিন) আল্লাহ তায়ালা ওই ব্যক্তির প্রতি (রহমতের দৃষ্টিতে) তাকাবেন না। ক্ষুধার মাধ্যমে মানবীয় চাহিদাকে বহির্ভূত করা।

মানুষ যখন পানাহারে পরিতৃপ্ত হয় তার মধ্যে কুপ্রবৃদ্ধি জেগে ওঠে। আর ক্ষুধার্ত থাকলে শান্ত থাকে। আলেম ও ফকিহদের কাছ থেকে ক্ষুধার বিভিন্ন উপকার বর্ণিত হয়েছে। যেমন : অন্তর পরিষ্কার থাকে ও অন্তর্দৃষ্টি খুলে যায়; অহমিকা খারাবি দূরীভূত হয়; আল্লাহর পক্ষ থেকে বিপদ আপদের কথা স্মরণ হয়; কুপ্রবৃত্তিকে দমিয়ে রাখা যায়; ইবাদতে অধ্যবসায় বাড়ে; দান সদকা করতে মন চায়। ভালোভাবে অর্থনীতি বোঝা যায়। অর্থাৎ আয়ের উৎস ও ব্যয়ের ক্ষেত্র সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা রাখা। এ ক্ষেত্রে আমরা নবীজীবনের কিছু দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে পারি। যা নবী সা: তাঁর সাহাবিদের জন্য পেশ করেছিলেন।

ক. এই শিক্ষা গ্রহণ করো যে, অন্তরের অমুখাপেক্ষিতাই প্রকৃত অমুখাপেক্ষিতা। আবু যার রা: বলেন, নবী সা: আমাকে বললেন, তুমি কি মনে করো যে, সম্পদ বেশি থাকাই ধনী হওয়া? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি সা: বললেন, তুমি কি মনে করো যে, সম্পদ কম থাকাই দরিদ্রতা? আমি বললাম, হ্যাঁ। তখন নবী সা: বললেন, প্রকৃত ধনাঢ্যতা হচ্ছে অন্তরের ধনাঢ্যতা, প্রকৃত দরিদ্রতা হচ্ছে অন্তরের দরিদ্রতা। এর অর্থ হলো আয়ের সময় সাবধানতা অবলম্বন করা, ব্যয়ের সময় হিসাব করে ব্যয় করা।

খ. জীবিকা উপার্জনের ক্ষেত্রে ভালোভাবে বুঝেশুনে করা। আবু সাইদ খুদরি রা. হতে বর্ণিত, কিছু আনসারি সাহাবি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে কিছু চাইলেন। তিনি তাদের দিলেন, পুনরায় তারা চাইলেন তিনি তাদের দিলেন। এমনকি তার কাছে যা ছিল সব শেষ হয়ে গেল। এরপর তিনি বললেন, আমার নিকট যে মাল থাকে তা তোমাদের না দিয়ে আমার নিকট জমা রাখি না। তবে যে যাচনা থেকে বিরত থাকে, আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রাখেন আর যে পরমুখাপেক্ষী না হয়, আল্লাহ তাকে সবর দান করেন। সবরের চেয়ে উত্তম ও ব্যাপক কোনো নিয়ামত কাউকে দেয়া হয়নি। সুতরাং মনের দিক থেকে অল্পে তুষ্ট থাকা, হাত না পাতা, ধৈর্য ধারণ করা কাম্য। আর শারীরিক দিক থেকে কাম্য হলো কাজ করে জীবিকা উপার্জন করা। নবী সা: বলেন, তোমাদের কেউ তার রশি নিয়ে জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে পিঠে বহন করে বাজারে যায়, তারপরে সেখানে বিক্রি করে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাকে অমুখাপেক্ষী করবেন, এটা মানুষের কাছে তার হাতপাতার চেয়ে উত্তম; কারণ মানুষ তাকে কিছু দিতে পারে। এ জন্য মক্কার লোকেরা ব্যবসায় করত, আর মদিনার লোকেরা চাষাবাদ করত।

গ. নিজস্ব আয়ের মাধ্যমে ব্যয় সীমাবদ্ধ করার শিক্ষা গ্রহণ করা। নবী সা: বলেন, একটি বিছানা স্বামীর জন্য. আরেকটি স্ত্রীর জন্য, তৃতীয়টি মেহমানের জন্য আর চতুর্থটি শয়তানের জন্য। এর উদ্দেশ্য হলো খরচ কম করা, যাতে করে ঋণ করতে অন্যের দ্বারস্থ হতে না হয় নিজের সম্পদ দ্বারাই যেন যথেষ্ট হয়।

ঘ. দানের অভ্যাস করা। নবী সা: বলেন, নিচের হাত থেকে উপরের হাত উত্তম। উপরের হাত হচ্ছে দাতা আর নিচের হাত হচ্ছে গ্রহীতা। হাদিসের উদ্দেশ্য হলো, সামাজিক বৈষ্যম দূর করা, যাতে দানকারীর সংখ্যা বেশি হয় এবং গ্রহণকারীর সংখ্যা কম হয়। এভাবেই নবী সা: তাঁর প্রিয় সাহাবিদের শিক্ষা দিয়েছেন। তারাও সেই শিক্ষা গ্রহণ করে জীবনে বাস্তবায়ন করেছিলেন। দাওয়াতের ময়দানে এর বিশাল প্রভাব লক্ষ করা গিয়েছিল। সুতরাং আমাদের উচিত হলো, উক্ত চরিত্রগুলো নিজেদের মধ্যে সন্নিবেশ ঘটানো, মুসলিমদের ওই চরিত্র থেকে দূরে থাকা উচিত, যা ওই সুন্দর সুন্দর বিষয়গুলোকে ধ্বংস করে। আর এটা জানা উচিত যে, যে ব্যয় অহঙ্কার প্রদর্শনের জন্য হয়ে থাকে তার মাধ্যমে শুধু সমাজে দরিদ্রতাই বৃদ্ধি পায়।

এ জন্য মুসলিমদের উচিত সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা। এর অর্থ এই নয় যে, নিজের আয় থেকে উপকৃত হওয়া যাবে না বা আল্লাহর নিয়ামতের সদ্ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু ইসলাম চায় মানুষ তার ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করুক, ইসলাম ধোঁকাবাজিকে অপছন্দ করে আর অন্যের অনুসরণ করতে গিয়ে অপচয় করাকেও নিষেধ করে। অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর পানাহারের আয়োজন করা, বিশেষ করে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানাদিতে এগুলোর মাধ্যমে সম্পদ নষ্ট ও ভবিষ্যতের বিপদ ডেকে আনা হয়। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের ক্ষেত্রেই মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা উচিত।

লেখক : প্রবন্ধকার

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top