কাকের বাসায়ও রড ব্যবহৃত হয়, বাঁশ নয়

ঢাকা শহরে মানুষের যেমন কমতি নেই, কমতি নেই কাকেরও। এত মানুষের জন্যই এত কাক। কারণ যত মানুষ তত ময়লা আবর্জনা। এসব আবর্জনা যত্রতত্র ফেলার অভ্যাস প্রায় সবারই। কাক যেহেতু সর্বভূক পাখি, সেহেতু তার খাবারের অভাব নেই; বংশ বিস্তারেরও শেষ নেই। তবে এদের বাসা তৈরির জন্য যত গাছ গাছড়ার প্রয়োজন, তা নেই ঢাকা শহরে। পাখি জগতে বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে সেরা পাখি, কাকও কম যায় না। কাক মানুষের সাথে খাপ খাইয়ে এখন সুন্দর সুন্দর দালানেও বাসা বাঁধা শুরু করেছে। শুধু তাই নয়, রেকর্ড ভেঙে এমনকি চৌদ্দতলায় মানুষের সচরাচর ব্যবহৃত বারান্দায়- অর্থাৎ ১৪০ ফুট উচ্চতায়ও বাসা বেঁধেছে, যদিও ৩০ থেকে ৩৫ ফুট উচ্চতার গাছেই এরা সচরাচর বাসা বেঁধে থাকে। তবে অনেক দিন অব্যবহৃত বিল্ডিংয়ে প্রায় ৭০ ফুট উঁচুতে বাসা বাঁধার একটি রেকর্ড আছে। ১৪০ ফুট উপরে ওই বাসাটি বাঁধা হয়েছিল তিন বছর আছে। এর অবস্থান নিউ ইস্কাটনে নাট্যশিল্পী আজাদ আবুল কালাম ও শিরিন সুলতানা দম্পতির সংসারে। পর পর দুই বছর কাক দম্পতি বাচ্চা ফুটাতে ব্যর্থ হয়েছে, কেননা ডিম পড়ে ভেঙে গেছে। তবে গত বছর কাক দম্পতি বাসাটিতে চারটি ডিম পাড়ে, চারটি বাচ্চাই ফোটে। শেষ পর্যন্ত তিনটি হৃষ্টপুষ্ট বাচ্চা উড়ে যেতে সক্ষম হয়।

প্রশ্ন হলো- কাকজোড়া কেন এত উঁচুতে মানুষের উপস্থিতিতে বাসা বাঁধল? ঢাকা শহরে কাকের অভাব নেই, অভাব আছে গাছপালার। মানুষের অভাব নেই, অভাব মায়া-মমতার। এ ক্ষেত্রে বারান্দায় কাক বাসা বেঁধে ডিম দিয়ে ছানা ফুটাল, এটা সম্ভব হয়েছে শুধু ওই বাসার মানুষদের পরম মমতার কারণে। কাকের ডাকাডাকি, বারান্দায় বাসা বাঁধার ছোট ডাল, বিষ্ঠায় নোংরা হওয়া ইত্যাদি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে কাক দম্পতিকে বাসা বাঁধার সুযোগ করে দিয়েছেন, ভালোবেসেছেন, কখনো খাবার, কখনো পিপাসার পানি দিয়েছেন। কাক বুদ্ধিমান পাখি। বুঝতে পেরেছে শিল্পী দম্পতির ভালোবাসা। তাই নিরাপদ মনে করেই সংসার সাজিয়েছে চৌদ্দ তলার বারান্দায়। কাক এতটাই বুদ্ধিমান যে, মানুষের পরে শিম্পাঞ্জি ও গরিলার বুদ্ধিমত্তার প্রায় সমান বুদ্ধি ওদের। শিম্পাঞ্জির মতো কাক আটকে থাকা কোনো খাবার বের করে আনার জন্য হুকঅলা কাঠি ব্যবহার করে। শিম্পাঞ্জি সাধারণত উইপোকার টিবিতে কাঠি ঢুকিয়ে দিয়ে উইপোকা বের করে খায়। সুতরাং কাকের মানুষের মমতা উপলব্ধি করার ক্ষমতা প্রায় শিম্পাঞ্জির মতোই বলা যায়।

প্রাণিবিজ্ঞানীরা কাককে feathered apes বলে থাকেন। Mc Goan নামের একজন বিজ্ঞানী বলেছেন, কাক undergraduate দের চেয়ে smart। কাক মানুষের ভালোবাসা যেমন বুঝতে পারে, তেমনি বুঝতে পারে মানুষের দুষ্টামিও। কেউ যদি এদের একবার আক্রমণ বা বিরক্ত করে, এরা কিন্তু আগ্রাসী হয়ে তাকে আক্রমণ করতে দ্বিধা করে না। এমনকি অন্যান্য কাক এক হয়ে আক্রমণকারীকে আঘাত করে থাকে। কাকের স্মৃতিশক্তি খুবই ভালো। নিজের লুকানো খাবার এরা নয় মাস পরেও খুঁজে বের করতে পারে। অন্য পাখি খাবার লুকিয়ে রাখার সময় তা কাক দেখলে প্রয়োজনে সেই লুকানো খাবার আনতে কখনো ভুল করে না। কাক কোনো কারণে মারা গেলে দলে দলে কাক সেখানে ছুটে যায় এবং মরা কাককে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়ায়। কোনো মানুষ বা অন্য প্রাণী দেখলে তাকে ক্ষুব্ধ হয়ে আক্রমণ করে। মৃত কাকটিকে কোনো কাক খায় না। বরং জানতে চায় কে তাকে মেরেছে? সেই মৃতদেহ ঘিরে জোরে জোরে কা . . . . কা . . . করে অনেক সময় ধরে ডাকে। সব শেষে, কাকগুলো চলে গেলেও জায়গাটার কথা মনে রাখে। ওই জায়গাতে অনেক খাবার থাকলেও আর কখনো কাকেরা ফিরে আসে না।

যা হোক, চৌদ্দতলায় কাকের সংসার দেখে মনে হলো, ঢাকা শহরে গাছের অভাবে মানুষের বাসায় কাক বাসা বাঁধতে বাধ্য হয়েছে। একসময়ের সবুজ শহরটাকে আমরাই ‘কংক্রিটের জঙ্গল’ করে তুলছি। পাখির আশ্রয় ধ্বংস করে আমাদের বিলাসী জীবনে সুখ কিনতে চাইছি। প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে সুখ কেনা যায় না।

আমার আজকের এ লেখার উদ্দেশ্য অন্য। এ বছর উক্ত কাক দম্পতি বাসাটি থেকে সব ডাল পালা, আঁশ প্রভৃতি নিয়ে গেছে অন্যত্র কোথাও বাসা বাঁধার জন্য, যদিও কাক দম্পতিকে কেউই কোনো প্রকার বিরক্ত করেনি। বাসা তৈরির সব সরঞ্জাম  কাক দম্পতি নিতে পারল, শুধু নিতে পারেনি তাদের বাসায় ব্যবহৃত ভিত নির্মাণে ব্যবহৃত তারগুলো। এই তারের ওজন করে দেখা গেল, প্রায় দেড় কেজি। কাক দম্পতি যখন বাসাটি বানিয়েছে তখন এসব তার পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে জড়িয়ে ফেলেছিল ভিত শক্ত করার জন্য। তাই তারা এগুলোকে খুলে নেয়ার তেমন চেষ্টাও করল না।

অন্য দিকে, আমরা দেখছি প্রাণিজগতে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ দালান, রাস্তা প্রভৃতি নির্মাণে ব্যবহার করছেন বাঁশ। প্রাণিজগতে মানুষ স্তন্যপায়ী প্রাণী। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে মানুষের পরে যাদের স্থান তারা হলো, শিম্পাঞ্জি। তবে তাদের বুদ্ধি ৪-৫ বছর বয়সী মনুষ্য শিশুর বুদ্ধিমত্তার চেয়ে একটুও বেশি নয়। অবশ্য ইদানীং ডলফিনকে মানুষের পরে স্থান দেয়া হয়েছে, তাও প্রায় ওই পরিমাণ বুদ্ধি। পাখি জগতের স্থান অবশ্যই স্তন্যপায়ী প্রাণীর পরে। ভিত তৈরিতে রডের বদলে বাঁশ দেয়া মানুষদের কি কাকের কাছে লজ্জার কিছু নেই? মানব জাতি এ লজ্জা রাখবে কোথায়? বাঁশধারী ব্যক্তিদের পরিণতি কি দাঁড়িয়েছে, জাতি কি তা জানতে পেরেছে? হ
লেখক : বন্যপ্রাণী ও পরিবেশবিশেষজ্ঞ; প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top