প্রথম অধিবেশনেই সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠনের চমকের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করল একাদশ জাতীয় সংসদ। ২৬ কর্মদিবসে সোমবার রাতে শেষ হয় অধিবেশনটি। সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক জাতীয় পার্টিসহ অন্যরা বিরোধী দলের আসনে বসলেও হাউজে বিরোধী দলীয় উত্তাপ ছিল না। বিলের ওপর সংশোধনী আনা ছাড়া সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের বক্তব্যের সুর ছিল প্রায় অভিন্ন।
সমাপনী দিনে বিরোধী দলের উপনেতা জাতীয় পাটির জি এম কাদেরকে তাদের বিরোধী দলের আসনে বসার কারণ ব্যাখ্যা করতে দেখা যায়। সত্যিকার বিরোধী দল না থাকায় বক্তব্য আসে না- মন্তব্য করতে দেখা যায় খোদ সরকারদলীয় সিনিয়র সদস্যকে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধিবেশনের প্রথম বৈঠকের দিন সংসদের বিরোধী দলকে পর্যাপ্ত সময় দেয়ার কথা বললেও সমাপনী বক্তব্যে বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সংসদে এলে কথা বলার সুযোগ দেয়ার কথা জানান।
৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত একাদশ জাতীয় সংসদে এবার সরকারি দলে এককভাবে রয়েছে আওয়ামী লীগ। সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৫৮টি আসন আওয়ামী লীগের। অন্য দিকে জাতীয় পার্টি ২২টি আসন নিয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দল। ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি, জাসদ ২টি, বিকল্পধারা ২টি, জাতীয় পার্টি-জেপি ও তরিকত ফেডারেশনও ১টি আসন নিয়ে বিরোধী দলের সারিতে। রয়েছেন ৩ জন স্বতন্ত্র সদস্য।
ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচিত ৮ জন সদস্যের মধ্যে ৭ জন শপথ নেননি। তবে একজন জোটের সিদ্ধান্ত অমান্য করে শপথ নিয়ে সংসদের যোগ দেন। সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব পালনকারী সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। অসুস্থতার কারণে তিনি একদিন কিছুক্ষণের জন্য বৈঠকে যোগ দেয়া ছাড়া আর অংশ নিতে পারেননি। যদিও দশম সংসদেরও বিরোধী দল ছিল জাতীয় পার্টি এবং বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন এরশাদ পতœী বেগম রওশন এরশাদ।
দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। ফলে ওই সংসদও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে থেকে নির্বাচনে অংশ নেয়া জাতীয় পার্টি যুগপৎভাবে সংসদে বিরোধী দল এবং মন্ত্রিসভার সদস্য হয়ে সরকারেও ছিল। এবার ঐক্যফ্রন্টের জোটে বিএনপি, গণফোরামসহ সমমনা বিরোধী দলগুলো অংশ নিলেও নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন ও ফল বর্জন করে ওই জোট। তারা সংসদে যোগ দেয়া থেকেও বিরত থাকে।
দশম সংসদের আদলে একাদশ সংসদেও জাতীয় পার্টিকে প্রধান বিরোধী দল করা হলেও এবার সরকারে স্থান দেয়া হয়নি জাতীয় পার্টিসহ শরিকদের কাউকে। সংসদের সত্যিকার বিরোধী দলের আবহ তৈরি করার জন্য শরিকদের সরকারে নেয়া হয়নি বলে মনে করা হলেও সেভাবে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই বিরোধীদলীয় উত্তাপ উত্তেজনা সংসদে লক্ষ করা যায়নি।
প্রথম অধিবেশন শুরু হয় গত ৩০ জানুয়ারি। ওই দিন বছরের প্রথম অধিবেশন হওয়ায় নিয়মানুযায়ী রাষ্ট্রপতি সংসদে ভাষণ দেন। রেওয়াজ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব এনে দীর্ঘ আলোচনা হয়। এই আলোচনায় সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা অংশ নেয়ার সুযোগ পান। এ ছাড়া পয়েন্ট অব অর্ডারসহ বিভিন্ন বিধিতে নোটিশ দিয়ে সংসদে বিরোধী দলের কথা বলার সুযোগ রয়েছে। একাদশ সংসদের শুরুর দিনের বক্তব্যেই ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সংসদে নিজের অবস্থান নিয়ে বিব্রত বলে জানিয়েছিলেন।
সর্বশেষ সোমবার রাতে সমাপনী বক্তব্য দিতে গিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা এরশাদের অনুপস্থিতিতে তার ভাই জি এম কাদের বক্তব্য দিতে গিয়ে সরকারি জোটে থেকেও বিরোধী দলের আসনে বসার কারণ ব্যাখ্যা করে ভূমিকা পালন করতে সরকারি দলের সহযোগিতা কামনা করে বলেন, আমরা বিরোধিতা করে কোন কথা বললেই আমাদেরকে শত্রু মনে করবেন না।
বিরোধী দল যাতে সংসদে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে তার জন্য সুবিধা দিতে কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন তিনি। তার আগের দিন সাবেক মন্ত্রী আওয়ামী লীগের সিনিয়র সদস্য মো: নাসিম ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের সংসদে আসার আহবান জানিয়ে বলেন, আসলে সংসদে বক্তব্য আসে না। ফাঁকা মাঠে খেলা যায় না, খেলতে ভালো লাগে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদের বর্তমান বিরোধী দলকে যথেষ্ট সুযোগ দেয়ার কথা বললেও তার বক্তব্যের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সংসদের বাইরে থাকা বিরোধীদলীয় জোট ঐক্যফ্রন্ট। তিনি বলেন, আজকে সংসদে বিরোধী দল যথেষ্ট সময় পান। প্রতিটি বিলের ওপর সংশোধনী আনেন, বক্তব্য রাখেন। আমরা এগুলোর ওপর গুরুত্ব দেই। ঐক্যফ্রন্টকে উদ্দেশ করে বলেন, ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে এসেছিল।
কিন্তু নির্বাচনে তাদের পছন্দমতো সংখ্যায় সিট পায়নি। তারপরও একজন সদস্য তাদের বাধা অমান্য করে সংসদে এসে বসেছেন। আমি আশা করি যারা অন্তত জনগণের ভোট পেয়েছেন তারা সংসদে এসে জনগণের কথা বলুক। তাদের যা যা বলার বলুক। কথা বলতে আমরা বাধা দেবো না।
পয়েন্ট অব অর্ডারে সাধারণত বিরোধী দল নানা প্রসঙ্গ এনে সংসদে বিতর্ক ও উত্তাপ তৈরির নজির রয়েছে। কিন্তু এই অধিবেশনের শুরুর দিকে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন ও জাসদের হাসানুল হক ইনুকে দুয়েকটি প্রসঙ্গ আনতে দেখা যায়। তবে এগুলো নিয়ে সেভাবে উত্তেজনা বা উত্তাপ ছড়ায়নি। সরকারি দলের সিনিয়র সদস্য মো: নাসিমও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি নিয়ে একদিন আলোচনার অবতারণা করেছিলেন এবং জাতীয় পার্টিসহ বিরোধী দলের আসনের সদস্যদের কয়েকজন তাকে সমর্থন করে বক্তব্য রেখেছিলেন।
এ ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যু, সৌদি আরবের সাথে সরকারের সমঝোতা স্মারক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির টাকা উদ্ধারে মামলা এবং বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টার প্রসঙ্গ নিয়ে পয়েন্ট অব অর্ডারে আলোচনা হয়েছে এবং কয়েকটি বিষয়ে মন্ত্রীর বিবৃতি চাওয়া হয়। বিমান ছিনতাই চেষ্টা ও রিজার্ভ চুরির বিষয়ে ৩০০বিধিতে মন্ত্রী বিবৃতি দেন। বিষয়গুলো বিতর্ক পর্যায়ে গড়ায়নি।
রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় বিরোধী দলের সদস্যরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমালোচনা করে বক্তব্য রাখার অতীতে রেকর্ড লক্ষ করা যায়। এ নিয়ে সংসদে ব্যাপক সমালোচনা পল্টা সমালোচনা উত্তাপ উত্তেজনা সৃষ্টির নজির রয়েছে। কিন্তু এই অধিবেশনে বিরোধী দল ও সরকারি দলের সদস্যদের আলোচনার সুর ছিল অনেকটাই অভিন্ন।
ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন কওমি মাদরাসায় ও হেফাজতে ইসলামকে জড়িয়ে বক্তব্য রাখলে তার জবাব দেন জাতীয় পার্টির সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি মেননের বক্তব্য এক্সপাঞ্জের দাবি জানান। কাজী ফিরোজ রশীদের সুরে সুর মিলিয়ে বক্তব্য রাখেন সরকারি দলের ড. আবু রেজা নেজামুদ্দিন নদবী। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শেষদিন বলেন, কওমি সনদের স্বীকৃতি দিয়ে তিনি কোনো অন্যায় করেননি। তিনি সৌদি আরবের সাথে সমঝোতা স্মারকের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন।
বিরোধীদলীয় উত্তাপ না থাকলেও এই সংসদের যাত্রা শুরু হয় ৫০টি সংসদীয় কমিটি গঠনের চমকের মধ্য দিয়ে। প্রথম ৭ কর্মদিবসের মধ্যেই ৫০টি সংসদীয় কমিটি গঠন এবং সর্বশেষ ৪৯টি সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচনের পর কমিটিগুলো পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে পুরোপুরি কমিটিগুলো গঠিত হয়। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী কমিটি গঠনকে সংসদের ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
অধিবেশনে মোট বিল উত্থাপিত হয় ১০টি। এর মধ্যে ৫টি পাস হয়। বাকি ৫টি পরীক্ষাধীন আছে। চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীর আনা রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হয় ৫৪ ঘণ্টা ২৭ মিনিট। আলোচনায় অংশ নেন ১৯৩ জন। ৭১ বিধিতে ৩২১টি নোটিশ পড়ে। এর মধ্যে ৩০টি গৃহীত হয় এবং ১৮টি আলোচিত হয়।
৭১(ক) বিধিতে দুই মিনিট করে আলোচিত নোটিশের সংখ্যা ছিল ১৫৫টি। এ অধিবেশন প্রধানমন্ত্রীর উত্তরদানের জন্য মোট ১১৪টি প্রশ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে তিনি ৪৬টি প্রশ্নের উত্তর দেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের উত্তরদানের জন্য মোট দুই হাজার ৩২৫টি প্রশ্ন পাওয়া যায়। এর মধ্যে এক হাজার ৭৩০টি প্রশ্ন সম্পর্কে মন্ত্রীরা সংসদে উত্তর দেন।