বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে আগামী মাস থেকেই শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়ের সাধারণ নির্বাচন। ছয় সপ্তাহব্যাপী এই ভোট ঘুরবে উত্তরের হিমালয় পাদদেশ থেকে দক্ষিণের ভারত মহাসাগর; পশ্চিমের থর মরুভূতি থেকে পূর্বের ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন পর্যন্ত। ৫৪৩ আসনের লোকসভার প্রতিনিধি বাছাইয়ে এবার এপ্রিলের ১১ তারিখ থেকে দক্ষিণ এশীয় এ দেশটিতে ভোট শুরু হতে যাচ্ছে। ভোট শেষ হবে ১৯ মে। ৭ দফার এ ভোটে সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার কোটি রুপি (৭০০ কোটি ডলার) খরচ হবে বলে অনুমান করছে নয়া দিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজ (সিএমএস)। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের তুলনায়ও এ খরচ অনেক বেশি।
২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও কংগ্রেসের নির্বাচনে সাড়ে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার খরচ হয়েছিল বলে জানিয়েছে দেশটির রাজনীতিতে অর্থের লেনদেন নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট ওপেনসিক্রেটস ডট ওআরজি। ভারতের ২০১৪ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ৫০০ কোটি ডলার খরচ হয়েছিল, এবার তার তুলনায় খরচ আরো ৪০ শতাংশ বাড়বে বলেই ধারণা করছে সিএমএস। এর ফলে ভোটারপ্রতি খরচ হবে প্রায় ৮ ডলার, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির ৬০ শতাংশ লোকই দিনে ৩ ডলারের কাছাকাছি খরচে জীবন ধারণ করে। সিএমএসের চেয়ারম্যান এন ভাস্কর রাও বলেছেন, ‘বাড়তি খরচের বেশির ভাগই হবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ভ্রমণ ও বিজ্ঞাপনে।’ আগের বেশ কয়েকটি সরকারের উপদেষ্টা রাও একটি বাজার গবেষণা গ্রুপও পরিচালনা করেছেন।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয়ের পরিমাণে নাটকীয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১৪ সালে এ খাতে আড়াই শ’ কোটি রুপি খরচ হলেও এবার সেখানে ৫ হাজার কোটি রুপি খরচের সম্ভাবনা রয়েছে। মাঠপর্যায়ের সাক্ষাৎকার, সরকারি তথ্য, বিভিন্ন চুক্তি ও অন্যান্য গবেষণা থেকে এবার হেলিকপ্টার, বাস ও অন্যান্য যানবাহনে প্রার্থী ও দলীয় কর্মীদের ভ্রমণ ব্যয় বাড়ার ধারণাও পাওয়া গেছে বলে রাও জানিয়েছেন। নির্বাচনে সব মিলিয়ে কত খরচ হবে সে তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে জানা কষ্টকর হবে বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের নির্বাচন অনুসরণ করা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইমন চৌচার্ড। পার্লামেন্টারি আসনের আকার ও প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ায় খরচ আগের তুলনায় বাড়বে বলেই মনে করেন তিনি।
চৌচার্ড বলেছেন, ‘ভারতীয় রাজনীতিকরা মনে করে, (নির্বাচনে জিততে হলে) জোরালো কিছু, বড় কিছু, পাগলামি ও নতুন কিছু করা লাগবে। একদল আতঙ্কিত প্রার্থী ভোটারদের চারপাশে টাকা ঢালা শুরু করে; বিক্রেতারাও রাজনৈতিক প্রচারণার প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয় এমন সব কিছু বিক্রি করতে থাকে।’
বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক জেনিফার বাসেলের করা একটি গবেষণায় ভারতের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের ৯০ শতাংশ রাজনীতিক বলেছেন, তাদের সহযোগীরা ভোটারদের টাকা, মদ ও অন্যান্য জিনিসপত্র ঘুষ হিসেবে দেয়ার প্রবল চাপ অনুভব করেন। ভোটে জিততে কোনো কোনো এলাকার প্রার্থীরা ভোটারদের টাকার পাশাপাশি ব্লেন্ডার, টেলিভিশন এমনকি কখনো কখনো ছাগলও ঘুষ দেয়। গত বছর কর্নাটকে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের সময় ভারতের নির্বাচন কমিশন বিপুল পরিমাণ রুপি, মদ ও মাদক উদ্ধার করেছিল।
খরচের এ হিসাব কখনোই প্রকাশ্যে আসে না। দেশটির আইনে প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়সীমা থাকলেও দলগুলোর প্রচার ব্যয়ে লাগাম টানার উপায় নেই। নির্বাচনের সময় প্রচারণা সমাবেশ করায়ও ব্যাপক আগ্রহ থাকে প্রার্থীদের। এসব সমাবেশে অংশ নিলে বিরিয়ানি কিংবা চিকেনকারিসহ যে দামি খাবার দেয়া হয় তা উপেক্ষা করার সুযোগ থাকে না অনেকেরই। সমাবেশে লোকজনকে আনানেয়া, নিরাপত্তা, মাইক্রোফোন, চেয়ার ও আতশবাজির জন্য যে বিপুল পরিমাণ খরচ করতে হয় তাও বলার অপেক্ষা রাখে না।
ভারতের নির্বাচনে ভোটারদের বিভ্রান্ত করতে অনেক সময়ই বিরোধী প্রার্থীরা জনপ্রিয় প্রার্থীদের বিপক্ষে একই নামধারী ‘ডামি প্রার্থী’ দাঁড় করিয়ে দেয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও উত্তর প্রদেশে জনপ্রিয় অভিনেত্রী হেমা মালিনির বিরুদ্ধে আরো দুই হেমা মালিনিকে দাঁড় করানো হয়েছিল। এ ধরনের ‘ডামি প্রার্থী’ দেয়ার ক্ষেত্রের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ব্যয় ১২ কোটি রুপি পর্যন্ত হয় বলেও ২০১৬ সালে ইন্ডিয়া টুডে ম্যাগাজিনের এক অনুসন্ধানী খবরে জানানো হয়েছিল।
এপ্রিল থেকে মে পর্যন্ত হতে যাওয়া এবারের নির্বাচনে কেবল গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন বাবদই দুই হাজার ছয় শ’ কোটি রুপি খরচ হবে বলে অনুমান করছে টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনের স্লট বরাদ্দ দেয়া প্রতিষ্ঠান জেনিথ ইন্ডিয়া। আগের নির্বাচনে এ ব্যয় ছিল অর্ধেকেরও কম, মাত্র এক হাজার দুই শ’ কোটি রুপি। ফেব্রুয়ারিতে কেবল ফেসবুকেই রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন বাবদ ভারতীয় দল ও প্রার্থীদের ৪ কোটি রুপির বেশি খরচ হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানটির এক খবরে জানানো হয়েছে।
এ নির্বাচনে কেবল প্রার্থী বা দলগুলোরই খরচ হচ্ছে না, দেশটির নির্বাচন কমিশনকেও ভোট আয়োজনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে। চলতি অর্থ বছরে দেশটির নির্বাচন কমিশনের জন্য ২৬২ কোটি রুপি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যার কিছু ব্যয় করতে হবে দুর্গম এলাকাগুলোতে হাতির পিঠে চাপিয়ে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন আনানেয়ায় কিংবা উত্তর পূর্বের প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্রের ওপর দিয়ে নৌকায় করে কর্মকর্তা ও নির্বাচনী সরঞ্জাম পারাপারে। এবারের নির্বাচনে হিমালয়ের ১৫ হাজার ফিট ওপরেও ভোটকেন্দ্র আছে, কেন্দ্র থাকছে এমনকি পশ্চিম ভারতের গহিন জঙ্গলের ভেতরেও।
সূত্র : এনডি টিভি