যেন আলাদিনের চেরাগ

টাকা দেখলে কাঠের পুতুলও নাকি নড়েচড়ে বসে। আর মানুষ! দেদার টাকাকড়ি কামানোই যেন তার সহজাত প্রবণতা। পরিশ্রমে হোক কিংবা সহজে, টাকা-পয়সা পেলে খুশিতে মন হয় আটখানা। হৃদয়ে বয়ে যায় মৃদুমন্দ হাওয়া। রাতারাতি ধনী হওয়ার বাসনা জাগে। বঙ্গীয় সমাজে আমরা মওকা মারতে ভালোবাসি। চার দিকে খুঁজে ফিরি অর্থ মিলবে কিভাবে? সেই ধান্ধা মাথায় কিলবিল করে। অবশ্য, তা না করে উপায় কী? বসে খেলে রাজার গোলাও ফুরিয়ে যায়। এই আপ্তবাক্য আত্মস্থ করে পরসম্পদ হাতিয়ে নিতে আমরা চালাক-চতুরেরা করি না কসুর। থাকে না লাজলজ্জাও। অনেকের চাই প্রচুর অর্থ। তা যে করেই হোক। ‘দোষের কিছু নেই!’ অঢেল সম্পদ থাকলে গা ভাসানো যায় ভোগের দরিয়ায়।

ব্রিটিশ আমলে আলিশান বাড়ি বানিয়ে লম্বা বাঁশের ডগায় নিশান উড়িয়ে লাখ টাকার জানান দিতেন লাখপতিরা। দশ গ্রামের মানুষ ঠুকত সালাম। টাকার মান পড়ে যাওয়ায় এখন লাখপতির জায়গায় কোটিপতি। তাদের জিম্মায় শত শত কোটি টাকা। ‘জিম্মা’ বলায় কেউ কেউ গোস্সা করতে পারেন। তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি- সম্পদ ক্ষণে ক্ষণে হাত বদলায়। জনপ্রিয় গানের কলি আছে- ‘সকাল বেলা আমির রে ভাই/ ফকির সন্ধ্যা বেলা’। তাই বলছিলাম, মানুষ সম্পদের জিম্মাদার। যে অর্থের পেছনে ছোটে, সে হয় সম্পদের বা ধনের পাহারাদার। জ্ঞান অন্বেষণ করলে তিনি হন জ্ঞানের রক্ষক। তবে এ কথাও খেয়াল রাখা দরকার, জ্ঞানীর জীবন সাধারণত দারিদ্র্যের। অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী। তাই অর্থের পেছনে সাধারণের বিরামহীন ছুটে ছলা। কে চায় স্বেচ্ছায় অভাবে ডুবে থাকতে? এ তো এক রকম আত্মহত্যা। বঙ্গদেশে কোনোকালেই সম্পদহীনের ছিল না কানাকড়ি দাম। নিজেকে ‘মূল্যবান’ করতেই অর্থ উপার্জনে প্রাণপাত। এ জন্য এত কসরত আর পেরেশান।

চেনাজানা পরিসরে সবাই এখন টাকাকড়ি পেতে মরিয়া। হন্যে হয়ে ছোটে দশ দিগন্তে, কেবল টাকার সন্ধানে। টাকার খনি না পেলে ভগ্নহৃদয়ে জীবন কাটে। বিনা পরিশ্রমে বিপুল সম্পদের মালিক কেউ যে হননি তা নয়; বড় উদাহরণ- হাজি মুহসীন। এ কথাও ঠিক, নিঃসন্তান বোন মন্নুজানের অঢেল সম্পদে রাতারাতি ধনী হয়ে আত্মহারা হননি মহৎপ্রাণ মানুষটি। অকৃতদার, তিনি যেমন ছিলেন দিলখোলা, তেমনি ছিলেন উদারহস্ত। তার অর্থে প্রবর্তিত শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে উপমহাদেশের অনেক গরিব মুসলিম শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে জীবনে পেয়েছেন প্রতিষ্ঠা। সেই তালিকা বেশ দীর্ঘ।

এবার সত্যি সত্যিই মিলেছে জবর একটি খবর। জানা গেছে মাস ছয়েক আগে, যা সবার নজর কেড়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’ গত বছর ৫ সেপ্টেম্বর অতি ধনীদের ওপর সর্বশেষ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়- বিশ্বে ‘অতি ধনী’ মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত হারে বাড়ছে বাংলাদেশে। এ দেশে অর্থনীতি বাড়ছে দ্রুত, কিন্তু তার চেয়েও দ্রুত বাড়ছে ধনীর সংখ্যা। ‘অতি ধনী’ তারাই, যাদের সম্পদ আড়াই শ’ কোটি টাকার বেশি। এ তথ্যে পরশ্রীকাতর অনেকে হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরতে পারেন। কিন্তু এটিও ঠিক, স্বাধীনতাপূর্ব আমলে জাতীয় অর্থনীতি ২২ পরিবারে ছিল বন্দী, সেই বন্দিত্ব থেকে মুক্তি মিলেছে। এ-ও কম কী!
শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, তামাম দুনিয়ায় অতি ধনী হওয়ার কাতারে সবার আগে বাংলাদেশ। ওয়েলথ এক্সের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে তাদের সংখ্যা বাড়ছে। অতি ধনী বৃদ্ধির প্রবণতায় দ্বিতীয় স্থানে চীন। এরপর যথাক্রমে ভিয়েতনাম, কেনিয়া, ভারত, হংকং ও আয়ারল্যান্ড। বিশ্বে অতি ধনী মানুষের সংখ্যা এখনো সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রে, ৮০ হাজার। ১৮ হাজার নিয়ে দ্বিতীয় জাপান। ১৭ হাজার নিয়ে চীন তৃতীয়। প্রথম ১০টি দেশের তালিকায় আরো আছে জার্মানি, কানাডা, ফ্রান্স, হংকং, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড ও ইতালি। ওয়েলথ এক্সের বয়ান, ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৭ শতাংশ হারে অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম, কেনিয়া এবং ভারতও খুব পিছিয়ে নেই।

যেন আলাদিনের চেরাগ! সেই চেরাগের কেরামতিতে বহুজন হয়েছেন শত শত কোটি টাকার মালিক। চেরাগ ঘষলেই বুড়ো জিন এসে উপস্থিত। বলে, ‘বান্দা হাজির’। বলে- কী চাই মনিব? অর্থের কাঙাল, চাই মুঠি মুঠি টাকাকড়ি, সোনাদানা। সাথে সাথে আঙুল ফুলে কলাগাছ। এখন বুড়ো জিনের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। সেখানে জায়গা করে নিয়েছে রাষ্ট্রীয় বড় বড় প্রকল্প। এসব কাজ যারাই বাগাতে পারবেন, তাদের কপালেই জোটে আলাদিনের চেরাগের আধুনিক সংস্করণ। কলির যুগে এগুলোই যেন আলাদিনের চেরাগ হয়ে ধরা দিয়েছে আমাদের। তবে এ কথা ভুললে চলবে না- এ চেরাগ পেতে রাষ্ট্রের কোনো-না-কোনো অঙ্গের আশীর্বাদ আর আনুকূল্য লাগে। তবেই শিকে ছিঁড়ে। লুটোপুটি খায় সাফল্য। না হলে টাকার খনি থেকে যায় অধরা।

এ দিকে আমাদের অনেক বাম রাজনীতিক তাদের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় বুক ফুলিয়ে, গলা সপ্ত আসমানে চড়িয়ে বলেন, দেশে লুণ্ঠনজীবীদের পোয়াবারো। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে তারা বিনা বাধায় জনগণের সম্পদ লুটপাটে ব্যস্ত। তাদের হচ্ছে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি। আর গরিবেরা হচ্ছেন আরো গরিব। বামরা ধনীর গায়ে সাঁটতে চান ‘লুণ্ঠনজীবী’র তকমা। অন্যের প্রভূত উন্নতি দেখে হিংসুটের চোখ টাটায়। বামপন্থীরা আমলে নিতে চান না, দেশে এত এত ধনী বাড়লে আখেরে লাভ গরিবেরই! কারণ, শত কোটিপতির মধ্য থেকে আমরা পেয়েও যেতে পারি মুহসীনের মতো দানবীর; যারা অকাতরে বিলাবেন নিজেদের অর্জিত অর্থসম্পদ। ভোগে নয়, ত্যাগেই খুঁজে পাবেন শান্তি। তবে এটাও খানিকটা ঠিক, দেশে যেনতেনভাবে কোটি টাকা কামিয়ে কেউ বিলালেই ‘ধন্যি ধন্যি’ রব ওঠে। নিন্দুকেরা বলেন, গত এক দশকে ধনী বনে গিয়ে বেশির ভাগ এখন কানাডায় বেগমপল্লীতে বউ-বাচ্চা পাঠিয়ে দেশে সংসারবিরাগী। মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোমে’ পরবাসী। স্বজন বিনে তাদের দুর্বিষহ জীবনের সমব্যথী কেউ না। আর টিপ্পনী কাটার বেলায় ষোলআনা।

তবে বাতির নিচে থাকে অন্ধকার। অতি ধনী হওয়ার খবরে উৎফুল্ল হতে গিয়েও যেতে পারে বেলুন চুপসে। আরেকটি খবর দেখে সবার চোখ ছানাবড়া। দ্রুত সম্পদ বৃদ্ধি বা ধনী হওয়ার যাত্রায় বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও অতি গরিব মানুষের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়, দুই কোটি ৪১ লাখ।। হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশিÑ এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম। বিশ্বব্যাংক ‘পোভার্টি অ্যান্ড শেয়ার প্রসপারিটি’ বা দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধির অংশীদার ২০১৮ শীর্ষক প্রতিবেদনে সবচেয়ে বেশি হতদরিদ্র মানুষ আছে, এমন ১০টি দেশের তালিকা তৈরি করেছে। ক্রয়ক্ষমতার সমতা অনুসারে (পিপিপি) যাদের দৈনিক আয় এক ডলার ৯০ সেন্টেরও কম, তাদের ‘হতদরিদ্র’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা হিসেবে বিবেচিত হয়। সেই হিসাবে বাংলাদেশের দুই কোটি ৪১ লাখ লোক দিনে ৬১ টাকা ৬০ পয়সাও আয় করতে পারেন না।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতে সবচেয়ে বেশি ১৭ কোটি ৫৭ লাখ হতদরিদ্র আছে। ভারত ছাড়া বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হতদরিদ্র মানুষ বাস করে নাইজেরিয়া, কঙ্গো ও ইথিওপিয়ায়। তালিকায় থাকা শীর্ষ ১০-এর অন্য পাঁচটি দেশ হলো তানজানিয়া, মাদাগাস্কার, কেনিয়া, মোজাম্বিক ও ইন্দোনেশিয়া।

দেশের সাম্প্রতিক উন্নয়নে কেউ ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে এমন তথ্য দিলো কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। চাঁদে যেমন কলঙ্ক থাকে, দেশের উন্নয়নে তেমন কলঙ্ক লেপন করতে কেউ উঠেপড়ে লেগেছে কি না, তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। তাই অতি ধনীর খবরে আহ্লাদিত হতে গিয়েও চুপসে যায় মন।

camirhamza@yahoo.com

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top