সঙ্কটে ব্যাংকিং খাত : নেপথ্যে যা হচ্ছে

নানামুখী সঙ্কটের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে চলছে দেশের ব্যাংক খাত। নয়া সরকারের নয়া অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যাংক খাতের নিয়মশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নানা কঠোর বার্তা ও পদক্ষেপের কথা আমাদের শোনাচ্ছেন। আবার নতুন ব্যাংক কোম্পানি খোলার অযৌক্তিক অনুমোদনের কথা আমরা জানছি। এমনি অতি মাত্রায় ব্যাংক সংখ্যার সম্পৃক্ততা দেশে বিরাজ করছিল, তার ওপর সম্প্রতি আরো তিনটি ব্যাংকের অনুমোদনে এই খাতসংশ্লিষ্টরা ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নয়া অর্থমন্ত্রী ও তার পূর্ববর্তী অর্থমন্ত্রীর মতো ব্যাংক খাতের সঙ্কট উত্তরণে ব্যর্থ হবেন বলেই আশঙ্কা করছেন।

সে যা-ই হোক, এই সময়ে প্রবল মূলধন ঘাটতিতে ভুগছে সরকারি ব্যাংকগুলো। আর এ মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক সরকারের কাছে ১৯ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে। ঘাটতি পূরণের জন্য সবচেয়ে বেশি টাকা চেয়েছে কৃষি ব্যাংক। মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যাংকটির প্রয়োজন সাত হাজার ৯৩৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এর পরের অবস্থানে রয়েছে জনতা ব্যাংক। সরকারি ব্যাংকের মধ্যে খেলাপি ঋণের শীর্ষে থাকা এই ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির জন্য প্রয়োজন ছয় হাজার কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকের জন্য প্রয়োজন চার হাজার কোটি টাকা। আর রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক মূলধন ঘাটতি পূরণে চেয়েছে ৭৭৫ কোটি টাকা। অপর দিকে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের সরকারি অংশের পূরণেও প্রয়োজন আরো এক কোটি ১২ লাখ টাকা। গত মাসে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে মূলধন ঘাটতি পূরণে এই অর্থ চাওয়া হয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসীমা কমিয়ে আনার ১৫ মাসের সময়সীমা শেষ হওয়ার কথা ছিল চলতি মাসেই। বলা হয়েছিল, আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে ব্যাংকগুলোর ঋণ আমানতের অনুপাত ৮৫ শতাংশ থেকে ৮৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু অনেক ব্যাংকে এ নিয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। এসব ব্যাংকে বিনিয়োগসীমা এই নির্ধারিত সীমার অনেক উপরে রয়েছে। বিশেষ করে কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকের এ সীমা ৯৫ শতাংশের উপরে রয়েছে। বিনিয়োগসীমা সমন্বয়ের সময় ফুরিয়ে আসায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন ব্যাংকারেরা। তারা জানিয়েছেন, যারা ঋণ নিয়েছেন তাদের অনেকেই ঋণ পরিশোধ করছেন না। বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণ। ফলে নির্ধারিত সময়ে বিনিয়োগসীমা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বরং এর সাথে সুদ যুক্ত হওয়ায় তা আরো বেড়ে গেছে। বাড়তি ঋণপ্রবাহ কমিয়ে সমন্বয় করার একমাত্র উপায় ছিল আমানতের প্রবাহ বাড়ানো। কিন্তু গত এক বছরে ব্যাংক খাতে আমানতপ্রবাহ বাড়েনি বরং কমেছে। এর ফলে অনেকের পক্ষেই বাড়তি বিনিয়োগ সমন্বয় করা সম্ভব হয়নি। আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে তা কী করে সমন্বয় করা সম্ভব, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন ব্যাংকারেরা। এমনি প্রেক্ষাপটে এ বিনিয়োগ সময়সীমা আরো ছয় মাস বাড়ানো হয়েছে।

বাজেটের টাকায় বছর বছর সরকার ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মোটানোর একটি অপসংস্কৃতি চালু করেছে। এই প্রক্রিয়া অনৈতিক বলে অনেকেই মনে করেন। তা ছাড়া এ প্রক্রিয়া বছরের পর বছর ধরে চলতে পারে না। এবার সরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির ব্যাপারে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবারের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকগুলো এ জন্য সরকারের কাছে চেয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা। এ বিভাগের এক কর্মকর্তার মতে, এ পরিমাণ টাকা দেয়া কখনোই সম্ভব নয়। এ দিকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতারণা রোধে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এ ধরনের ব্যাংকিংয়ের আওতায় টাকা স্থানান্তর দ্রুত হলেও এ মাধ্যমে দুষ্টচক্রের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। প্রতিদিন সারা দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে গিয়ে শত শত মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন। প্রতারকচক্র হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার টাকা থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতারক চক্রের জাল বিস্তার শনাক্ত করলেও তা প্রতিরোধে এখনো কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাথে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির প্রধান সূচকগুলোর বেশির ভাগেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি রাষ্ট্রায়ত্ত ১৭টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এ লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়। গত ডিসেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এর অর্ধবার্ষিক একটি মূল্যায়ন করে। গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে এ মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রথম অর্ধবার্ষিক কার্যক্রমের মূল্যায়নে প্রতিষ্ঠানগুলোর অগ্রগতি সন্তোষজনক নয় বলে মন্তব্য করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টার্গেট অনুযায়ী খেলাপি ঋণ ও অপলোপন করা ঋণ আদায় করতে পারেনি। এ পরিস্থিতিতে যেসব প্রতিষ্ঠানের যেসব সূচকে অর্থবছরের অবশিষ্ট সময়ে যেসব সূচক অর্জন সন্তোষজনক নয় সেসব সূচকে অর্থবছরের অবশিষ্ট সময়ে তা অর্জনের নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

সরকার নিজেই ব্যাংক খাতে এমন কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যা কার্যত অযৌক্তিক ও ব্যাংক খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে অন্যতম ভুল সিদ্ধান্তটি হচ্ছে দেশে ব্যাংক সংখ্যা সম্পৃক্তাবস্থা থাকলেও দেশে আরো নতুন নতুন ব্যাংক কোম্পানি চালুর অনুমোদন। নতুন অর্থমন্ত্রী তার মেয়াদেই এমনি একটি ভুল পদক্ষেপ নিয়ে বসেছেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশে আরো তিনটি নতুন ব্যাংক অনুমোদন পেল। বাংলাদেশ ব্যাংক গত ফেব্রুয়ারিতে পিপলস ব্যাংক, সিটিজেন ব্যাংক এবং বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের লাইসেন্স অনুমোদন দেয়। এই তিন নয়া ব্যাংক নিয়ে দেশের ব্যাংকের সংখ্যা ৬২টিতে পৌঁছেছে। এর পাশাপাশি রয়েছে শতাধিক ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বেশ কয়েকটি বিদেশী ব্যাংকের শাখা। নতুন এই তিন ব্যাংকের মাধ্যমে দেশবাসী তথা আর্থিক খাত কতটুকু উপকার পাবে, তা ভবিষ্যতে দেখার বিষয়। তবে, নতুন এসব ব্যাংকের অনুমোদনের বিষয়টি থিংকট্যাংক, বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ী মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ এসব নতুন ব্যাংক অনুমোদনের বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের অভিমত, এসব ব্যাংক দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। অপর দিকে, অন্যদের অভিমত হচ্ছে, ব্যাংক খাত সঠিক পথে না এলে এসব নতুন ব্যাংক চালু করা দেশের জন্য কোনো উপকার বয়ে আনবে না।

অর্থনীতির কথা হচ্ছে- নতুন ব্যাংক সমস্যা হয়ে দেখা দিত না, যদি দেশে যথাযথ বিধি নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করে ব্যাংক খাত থেকে সব ধরনের অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলা দূর করা যেত এবং এর মাধ্যমে ব্যবসায়ী ও আমানতকারীদের স্বার্থ যথাযথভাবে রক্ষা করা নিশ্চিত করা যেত। তখন নতুন ব্যাংক আনত নতুন বিনিয়োগ, অধিকতর সঞ্চালিত হতো আমানত। তখন সৃষ্টি হতো ব্যবসায়ের নতুন নতুন সুযোগ। সর্বোপরি নতুন ব্যাংক সৃষ্টি করে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। নতুন ব্যাংক সৃষ্টি করে সঞ্চয়-জিডিপির অনুপাতও। অপর দিকে, যথাযথ বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে ব্যাংকের সংখ্যা বাড়ানো সৃষ্টি করে নানা সমস্যা। আর্থিক বাজারে ও অর্থনীতিতে পড়ে এর নেতিবাচক প্রভাব। অধিকন্তু, ব্যাংকগুলোকে মেনে চলতে হয় নানা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিধিবিধান। ব্যাংকগুলো শুধু আমানতদের জামিনদার বা রক্ষক নয়। বরং ব্যাংকগুলো দেশের অর্থনীতিতে অর্থও সরবরাহ করার গুরু দায়িত্বও পালন করে। সরকারের আর্থিক নীতিও বাস্তবায়িত হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলোর মাধ্যমেই। একটি ব্যাংকের প্রতিটি কর্মকাণ্ড অর্থনীতিতে হয় ভালো, নয় খারাপ প্রভাব ফেলে। অতএব যথাযথ বিধিবিধান ও নিয়ন্ত্রণ ব্যাংকগুলোর ওপর প্রতিষ্ঠা না করে এভাবে নতুন নতুন ব্যাংক খুললে, তা গোটা আর্থিক খাতের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের বিধি নিয়ন্ত্রকেরা, বিশেষত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক খাতকে সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রমাণ রাখতে পারেনি। ব্যাংকিং খাতের অসংখ্য ঘটনা-বিঘটনা এর সাক্ষ্য বহন করে। সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ হচ্ছে, নয়া অনুমোদিত তিন ব্যাংকের এক ব্যাংক হচ্ছে পিপলস ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ব্যাংকটি অনুমোদন দিতে না দিতেই এর লাইসেন্স প্রক্রিয়া আটকে দিয়েছে।

কারণ, এর চেয়ারম্যান আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচারের অভিযোগ উঠেছে। তবে আবুল কাশেম বলেছেন, তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পিপলস ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে সক্ষম হবেন। গত ১৭ ফেব্রুয়ারির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ৫ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্য দু’টি ব্যাংক বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক ও সিটিজেন ব্যাংকের অনুমোদন দেয় এবং তাদের বলে বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যাংকসেবা চালুর জন্য প্রস্তুতি নিতে। অপর দিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি আমরা প্রস্তাবিত পিপলস ব্যাংকের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ পেয়েছি। আমরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব অভিযোগ খতিয়ে দেখার পর।

বাংলাদেশ ব্যাংক এই অভিযোগ পাঠিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের কাছে, অভিযোগটি বিস্তারিত খতিয়ে দেখার জন্য। আবুল কাশেম যুক্তরাষ্ট্রে আওয়ামী লীগের একজন নেতা। একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিককে তিনি জানিয়েছেন, অর্থ পাচারের এই অভিযোগ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না।
উল্লেখ্য, নতুন এই তিন ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের শেয়ার কিনতে হবে তাদের দেখানো আয় রিটার্নের ভিত্তিতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর আগে প্রশ্ন তুলেছিল, কী করে আবুল কাশেম ৪০ কোটি টাকার ব্যাংক শেয়ার কেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার সম্পদ স্থানান্তর করবেন বাংলাদেশে। আবুল কাশেমের ৪৩.৯৪ কোটি টাকা সম্পদ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে এবং ৫৬.৯২ লাখ টাকা বাংলাদেশে। তার দেয়া দলিলপত্রে এমনটিই উল্লেখ রয়েছে।

সে মতে, তাকে শেয়ার কেনার জন্য তার ৯০ শতাংশ সম্পদ বিক্রি করতে হবে। গত বছর অক্টোবরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে যুক্তরাষ্ট্রে আবুল কাশেমের সম্পদের বিস্তারিত বিবরণ জানাতে। তা ছাড়া আরো জানতে চায়, তার এই সম্পদ বাংলাদেশে স্থানান্তর করায় কোনো ধরনের বাধা আছে কি না? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে ইতিবাচক রিপোর্ট দিলে আবুল কাশেম পিপলস ব্যাংকের ব্যাপারে প্রাথমিক অনুমোদনের সুযোগ পান কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। অপর দিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লেটার অব ইনটেন্ট মতে, বেঙ্গল ও সিটিজেন ব্যাংককে একগুচ্ছ শর্ত পূরণ করতে হবে আগামী ছয় মাসের মধ্যে।

সে যা-ই হোক, সবসময় বলা হয় অধিক সংখ্যক ব্যাংক থাকলে ব্যাংক খাতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয়। এতে দেশের ব্যাংক খাতে প্রতিযোগিতা বাড়ে। যার ফলে ব্যাংক সেবার মান উন্নত হয়। এ কথা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্যি হতে পারে। কিন্তু সবসময় তা প্রত্যাশিত মতো ঘটে না। প্রতিযোগিতা ভালো, তবে অতিমাত্রিক প্রতিযোগিতা ভালো নাও হতে পারে। বরং তা খারাপ ফল বয়ে আনতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে অতিমাত্রিক প্রতিযোগিতায় অসৎ পথ অবলম্বনের ঘটনা ঘটে। যেমন চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অতিমাত্রিক প্রতিযোগিতা ডেকে আনে অসদুপায়ের নানা ঘটনা। ব্যাংকের ক্ষেত্রে অতিমাত্রিক প্রতিযোগিতা ব্যবসায়ের ক্ষতি ডেকে আনে।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে দুর্বল ব্যাংকগুলো আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্য এক ধরনের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনি প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেষ পর্যন্ত উদ্যোগ নিয়েছে দুর্বল ব্যাংকগুলো ধারাবাহিক আঘাতগুলো মোকাবেলায় একটি মার্জার পলিসি সূত্রায়ন করার জন্য। যেসব ব্যাংক খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে, সেসব ব্যাংককে এই মার্জার পলিসির আওতায় আনা হবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে এই মার্জার পলিসি গঠনের জন্য। সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে এই নীতিমালা সূত্রায়িত হবে। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার এটি একটি ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে কাজ করবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইন সংস্কার করতে হবে। এ সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্ষমতা দিতে হবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের অপসারণের। এমনটি অভিমত রেখেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। গত ৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, এ ধরনের সংস্কারের মাধ্যমে সরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের খেলাপি ঋণ আদায়ে অধিকতর জবাবদিহির আওতায় আনা যাবে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ডিরেক্টরদের ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলেও এ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বেলায়।

কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের ব্যাংকই তফসিলি ব্যাংক। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তবে এ দুই ধরনের ব্যাংক একই নিয়ম বা বিধিবিধানের আওতায় চলবে না? দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদেরা প্রায়ই উল্লেখ করেন বিপুল সংখ্যক বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণে এখনো মোটামুটি একটা সীমিত থাকার সত্ত্বেও সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সে তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার একটি অন্যতম কারণ এটি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরো কঠোর নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে ব্যাংক খাতের প্রথমসারির বিশেষজ্ঞরা বেসিক ব্যাংকের উদাহরণ উপস্থাপন করেন। একসময় বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ছিল ২ শতাংশেরও কম। কিন্তু একজন নতুন চেয়ারম্যান আসার পর তার পছন্দের একজন নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়ে এলেন। দেখা গেল দুই বছরের মধ্যে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮০ শতাংশের ওপর চলে গেল। তৎকালীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এই ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে অপসারণে অনুরোধ জানিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিতের কাজে চিঠি লিখলেও তা আমলে নেয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত ওই চেয়ারম্যান তার মেয়াদ শেষের মাত্র এক দিন আগে পদত্যাগ করলেন।

ব্যাংক খাতে চলমান দুরবস্থার মাত্রার আরেকটি বড় কারণ, পদে পদে অপদস্ত হচ্ছেন ভালো গ্রাহকেরা। এমনকি ভালো গ্রাহকেরা এলসিও খুলতে পারছেন না। এমন অভিযোগও শোনা যায়। নেতিবাচক ইমেজ রয়েছে এমন গ্রাহকেরা ব্যাংকে অনায়াসে অগ্রাধিকারভাবে নানা সুবিধা পেয়ে যান। ইচ্ছাকৃতভাবে বড় বড় খেলাপি ঋণগ্রহীতা আইনের মারপ্যাঁচে কখনোই শীর্ষ ঋণ খেলাপির তালিকায় স্থান পায় না। আছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও। আর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অতিমাত্রিক হওয়ায় অনেক ব্যাংকের কপাল পুড়েছে। মোট কথা, ব্যাংক খাতে বিরাজ করছে হাজারো বিশৃঙ্খলা। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এসব বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটানো যাচ্ছে না। আর সে কারণে ব্যাংক খাতের পিছু ছাড়ছে না নানা সঙ্কট। দেশবাসী চায় নয়া অর্থমন্ত্রী যাবতীয় জঞ্জালের অবসান ঘটিয়ে ব্যাংক খাতকে সুষ্ঠু ধারায় ফিরিয়ে আনবেন। এ ব্যাপারে তিনি আন্তরিক পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যাবেন- এমনটিই দেশবাসী প্রত্যাশা করে। ভুললে চলবে না, ব্যাংক খাত হচ্ছে একটি দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও কিছু ব্যক্তির অপকর্মে এ খাত ধ্বংস হতে দেয়া যায় না।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top