ডাকসু নির্বাচন : নারী ভোটারে পাল্টে যেতে পারে হিসাব

গণমাধ্যমগুলোর জন্য বেশ কড়াকড়ি নিয়ম করাসহ নানান অভিযোগের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন। দীর্ঘ ২৮ বছরের অচলাবস্থা ভেঙে সচল হতে যাচ্ছে দেশের দ্বিতীয় সংসদ খ্যাত ডাকসু। শুরু থেকেই নির্বাচন পরিচালনার সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগদান, প্রার্থী যাচাই-বাছাই এবং সর্বোপরি নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ উঠলেও শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের স্বাধিকারের এ প্রতিষ্ঠানটি। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত একযোগে অনুষ্ঠিত হবে ডাকসু ও ১৮ হলে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি নির্বাচন।

রোববার সকাল ৮টা থেকে শেষ হবে ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণা। ইতোমধ্যে নির্বাচনকে সামনে রেখে চলছে বুথ নির্মাণের কাজ। আদা জল খেয়ে প্রার্থীরা চালাচ্ছেন শেষ দিকের প্রচারণা। গতকালও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন এবং স্বতন্ত্র পরিষদের শিক্ষার্থীদেরকে দেখা গেছে প্রচারণায়। সব মিলিয়ে ডাকসু নির্বাচন উপলক্ষে সরগরম হয়ে উঠেছে গোটা দেশ। ডাকসুর আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠেছে সার্বক্ষণিক প্রচার মাধ্যম।

তবে এসব দিক ছাপিয়ে বর্তমান আলোচনায় রয়েছে ভোটের বিষয়টি। প্রার্থীরা যেমন ভোটার টানতে দিচ্ছেন নানা রকম প্রতিশ্রুতি। তেমনি ভোটার তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খুঁজছেন তাদের পছন্দের এবং একই সাথে যোগ্য প্রার্থী। সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী কে? কোন প্রার্থীকে ভোট দেয়া দরকার? কেন তাকে ভোট দেয়া উচিত ইত্যাদি প্রশ্ন চাউর হয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। পাশাপাশি কোন ধরনের ভোটাররা কী ধরনের ভূমিকা রাখবেন সে আলোচনায় মুখর গোটা ক্যাম্পাস। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বিশ^বিদ্যালয়ের নারী ভোটাররা। বিভিন্ন মহলের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, এবারের ডাকসু নির্বাচনের মূল ব্যবধান সৃষ্টি করবেন বিশাল সংখ্যক নারী ভোটার। তারা মনে করছেন নির্বাচনের যেকোনো হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারেন তারা। নারী ভোটাররা যে দিকে যাবে সে দিকেই হয়তো ঝুঁকবে জয়ের পাল্লা। বিপরীত দিকে আসবে হার।

বিশ^বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ছেলেদের ১৩ ও মেয়েদের ৫ হলে মোট ভোটার রয়েছে ৪৩ হাজার ২৫৬ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ২৬ হাজার ৯৪৪ যা মোট ভোটারের ৬২ দশমিক ২৯ শতাংশ এবং নারী ১৬ হাজার ৩১২ জন; যা মোট ভোটারের ৩৭ দশমিক ৭১ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি (৪ হাজার ৬০৮ জন) ভোটার রয়েছে রোকেয়া হলে এবং সবচেয়ে কম (১ হাজার ৩৪৬ জন) ভোটার রয়েছে অমর একুশে হলে। এর মধ্যে ছেলেদের বিজয় একাত্তর হলে ৩ হাজার ১৫৫, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে ২ হাজার ৫২, ফজলুল হক মুসলিম হলে ২ হাজার ১৭৫, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ১ হাজার ৯৮১, জগন্নাথ হলে ২ হাজার ৪৯৬, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলে ১ হাজার ৭৯৯, কবি জসীমউদ্দীন হলে ১ হাজার ৬৫৮, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের ২ হাজার ৫৭, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ১ হাজার ৮১৪, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ২ হাজার ৩০১, স্যার এ এফ রহমান হলে ১ হাজার ৮৪০, মাস্টারদা সূর্যসেন হলের ২ হাজার ১৭০ জন। এ ছাড়া মেয়েদের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে ২ হাজার ২৮৮, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে ১ হাজার ৯২৮, কবি সুফিয়া কামাল হলে ৩ হাজার ৭২৪, শামসুন্নাহার হলে ৩ হাজার ৭৬৪ জন ভোটার রয়েছেন।

পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, ছেলেদের হলগুলোর গণরুমের শিক্ষার্থীদের ওপর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের প্রভাবের কারণে ছাত্রদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোট পেতে পারে ছাত্রলীগ। তবে মেয়েদের হলগুলোতে ছাত্রলীগের একপেশে প্রভাব না থাকায় যেকোনো দিকে যেতে পারে তাদের সমর্থন।

যারা প্রতিশ্রুতিশীল তাদের থেকেই তারা নির্বাচন করবেন আগামীর নেতৃত্ব। শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহলের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সাত কলেজ বাতিলের আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের শ্লীলতাহানি, সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের প্রকাশ্য বিরোধিতা এবং সাধারণ শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীদেরও ওপর আক্রমণ, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেয়া স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের তাণ্ডব ইত্যাদি কারণে মেয়েদের হলগুলোতে আধিপত্য হারাবে ছাত্রলীগ। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশ নিয়ে নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের প্যানেল বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের দিকে ঝুঁকতে পারে নারী ভোটাররা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের তৃতীয় বর্ষের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্রী নয়া দিগন্তকে বলেন, ছেলেদের হলগুলোর মতো মেয়েদের হলে ছাত্রলীগ তথা কোনো বিশেষ ছাত্রসংগঠনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে নেতিবাচক ইমেজ রয়েছে সরকার সমর্থক এ ছাত্রসংগঠনের। তাই মেয়েদের হলগুলোতে জয়-পরাজয়ের বিষয়টি মোটামুটি নিশ্চিত। রোকেয়া হলের মাস্টার্সের এক ছাত্রী বলেন, কোনো প্রার্থী প্রতিশ্রতিশীল, শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কারা সচেতন, মেধাবী, সৎ ও সাহসী ইত্যাদি গুণসম্পন্ন প্রার্থীদেরকে পছন্দের তালিকায় রাখব আমরা। সে ক্ষেত্রে দল বা সংগঠন মুখ্য নয়।

এবারের ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের শুরুতে আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রে থাকলেও প্রচার-প্রচারণায় তুলনামূলক অনেকটা পিছিয়ে বিএনপির সংযোগী সংগঠন ছাত্রদল। আন্তঃকোন্দলে সংগঠনটির বেহাল দশা বলে ছাত্রদলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। কেবল সঠিক এবং পর্যাপ্ত প্রচারণার অভাবে অনেক হলের ভিপি-জিএস প্রার্থীকেই চিনছে না সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আবার যতটুকুও প্রচারণা ছিল তার বেশ কয়েক জায়গায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকার সমর্থক সংগঠন ছাত্রলীগ। এসব কারণেও পিছিয়ে থাকতে পারে ছাত্রদল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, কেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বন্দ্বে প্রচার-প্রচারণায় ভাটা পড়ছে। যতক্ষণ ভাই (নেতা) আছে ততক্ষণ প্রচারণায় সক্রিয় থাকছে তারা।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top