ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক যেন এক টুকরো হাতিরঝিল

দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে, মাত্র কয়েক মাস আগেও এটি পচা ডোবা আর জঙ্গলে ভর্তি বন ছিল। যেখানে দিনের বেলায়ও আসতে ভয় পেতেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু কয়েক মাসের ব্যবধানে সেটিই হয়ে উঠছে ক্যাম্পাসের সবচেয়ে জনাকীর্ণ স্থান। চড়ুইভাতি, জন্মদিনের উৎসব কিংবা আড্ডা সব কিছুরই যেন ‘পারফেক্ট প্লেস’। বলছি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকের কথা।
আগাছা আর কচুরিপানা উচ্ছেদ করে চুন ছিটিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে পানি। পারাপারের জন্য মাঝ বরাবর একটি ঝুলন্ত সেতু, তার একটু পরে বাঁশ দিয়ে তৈরী আড়পাস। মর্নিংওয়ার্ক কিংবা ঘুরে দেখার জন্য দুই তীরজুড়ে প্রশস্ত ওয়াকওয়ে। পূর্ব দিকের ওয়াকওয়ে ঘেঁষে বিশাল জায়গাজুড়ে গড়ে উঠছে বোটানিক্যাল গার্ডেন। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী, কাজ এখনো বেশির ভাগ বাকিই রয়েছে। কিন্তু তাতে কী! এখনই রূপ যেন ঝলসে পড়ছে লেকটির গতর থেকে। দর্শনার্থীদের কেউ কেউ এরই মধ্যে খুঁজে ফিরছেন হাতিরঝিলের ছবি। কৌতুকপ্রিয় রসিকদের অনেকে আবার ভালোবাসা আর মৃদু ঠাট্টায় ডাকছেন ‘গরিবের হাতিরঝিল’ বলে।
বিকেলে বন্ধুদের নিয়ে লেকের পাড়ে ঘুরতে এসেছেন আইন বিভাগের নাদিম। মফস্বলে ক্যাম্পাস হওয়ায় রাজধানী কিংবা বিভাগীয় শহরের মজা মিস করে জানিয়ে তিনি বলেন, লেকের পাড়ে এলে বুঝতেই পারি না আমরা এখন কোনো মফস্বলের ক্যাম্পাসে আছি। মনে হয় ফরেন কোনো রিসোর্ট। এ যেন সত্যিই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকে ‘এক টুকরো হাতিরঝিল’। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পশ্চিম কিনার ঘেঁষে বয়ে চলা দৃষ্টিনন্দন লেকটি যেন দর্শনার্থীদের সে কথাই মনে করিয়ে দেয় বারবার।
বাস্তবের ‘হাতিরঝিল’কে বলা হয় ‘ঢাকার বুকে এক খণ্ড ইউরোপ’। ইটপাথরের ব্যস্ত শহরে বিরতিহীন নাগরিক জীবনের ক্লান্তি দূর করতে রাজধানীর হাতিরঝিলকে করা হয়েছে মনোরম এক বিনোদন কেন্দ্র। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, জলাবদ্ধতা ও বন্যা প্রতিরোধ, ময়লাপানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, রাজধানীর যানজট নিরসন এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ডিজাইন করা হয় হাতিরঝিলের। ঠিক তেমনি ক্যাম্পাসের পানি নিষ্কাশন ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে খনন করা হয়ছিল লেকটি। দীর্ঘকাল অযতেœ থাকার পর সম্প্রতি সংস্কারকাজ শুরু হয়েছে। ফলে লেকের চেহারা যেমন পাল্টে গেছে, তেমনি বাড়তি সৌন্দর্য যোগ হয়েছে পুরো ক্যাম্পাসে। ফলে শিক্ষার্থীদের আড্ডা-বিনোদনের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে লেকের পাড়। প্রতিদিনই শত শত শিক্ষার্থী কিংবা বহিরাগত দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠছে স্থানটি। একটানা ক্লাস-পরীক্ষা আর ল্যাবের নিষ্ঠুরতা থেকে স্বস্তি পেতে শিক্ষার্থীদের কাছে প্রথম পছন্দই এখন লেকের পাড়।
ঘুরতে আসা হিসাববিজ্ঞান বিভাগের মুনতাসীর রহমান জানান, স্বচ্ছ পানি, ঝুলন্ত সেতু আর অতিথি পাখির কলকাকলি আমাকে বারবার টেনে আনে লেকের পাড়ে।
লোক প্রশাসন বিভাগের সৃষ্টি সরদার বলেন, কয়েক মাস আগেও লেকটি ছিল পচা পানির আধার। কিন্তু এখন সেটি চেনার উপায় নেই। সময় পেলেই বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে আসি। মজার ব্যাপার হলো বিকেলে সূর্যাস্ত দেখতে অনেক ভালো লাগে এখান থেকে।
সবুজে ঘেরা অপরূপ দৃশ্যের জন্য বহু আগে থেকেই পরিচিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। লেকের এই সৌন্দর্য আর বিকেলে সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য তার মুকুটে যেন নতুন পালক যোগ করেছে।
কবিদের কবি নির্মলেন্দু গুণ যখন প্রথমবার হাতিরঝিলকে দেখেন তিনি লিখেছিলেন, ‘তিন-চার শ’ বছর ধরে হাতিরঝিলের বর্জ্যস্তূপের আড়ালে ঢাকা পড়েছিল যে ঢাকা, সেই ঢাকা আজ কী অপরূপ রূপের আলোতেই না উদ্ভাসিত হলো, উন্মোচিত হলো, আবিষ্কৃত হলো। আমি মুগ্ধ। আমি গর্বিত। আমি আনন্দিত। অবশেষে সিঙ্গাপুর, সিডনি, লন্ডন বা প্যারিসের পাশে দাঁড়ানোর মতো একটা ল্যান্ডমার্ক তৈরি হলো আমাদের প্রিয় নগরী ঢাকার ভেতরে।’ তাই আমরাও বলতে পারি, রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ যদি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকে কখনো বেড়াতে আসতেন; তিনি নিশ্চয়ই ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায় আরো কয়েকটি লাইন বাড়তি লিখতেন।
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top