মাত্র দুই তিন সেকেন্ডের জন্য …

এক সেকেন্ড বা কয়েক সেকেন্ডে কী ঘটতে পারে? আগে বলা হতো- না, এতো অল্প সময়ে বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। কিন্তু পরমাণু অস্ত্র আসার পর থেকেই বলা হতে থাকে, পরমাণু বোমার সুইচ টিপতে এক সেকেন্ড লাগে। তারপর আর সময় লাগবে না, এমনিতেই বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে।

কিন্তু কয়েকটি সেকেন্ড যে মানুষের জীবনের কতটুকু মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, কতটুকু পাল্টে দিতে পারে, তা টের পাচ্ছেন ভারতের বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান।

২৭ ফেব্রুয়ারি মিগ-২১ নিয়ে পাকিস্তানের ভিতরে ঢুকে পড়েছিলেন অভিনন্দন। এরপর পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর হামলায় দুটি মিগ-২১ বিধ্বস্ত এবং পাইলট অভিনন্দনের ধরা পড়া। এরপর তাকে নিয়ে অনেক রাজনীতি, কূটনীতি চলেছে দুই দেশের মধ্যে।

পাকিস্তানের দেয়া নিঃশর্ত মুক্তি পেয়ে অভিনন্দন এখন ভারতের হিরো। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন, অভিধানে এখন থেকে অভিনন্দন শব্দের মানেই পাল্টে যাবে। কয়েকটি পুরস্কারের জন্যও তার নাম ঘোষণা হয়েছে।

কিন্তু তারপরও খচখচানিটা রয়েই গেছে। শত্রু দেশে ধরা পড়া। তারপর কিছু না বলেই মুক্তি দেয়া। সবকিছুর মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বস্তি রয়েই গেছে। যে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের প্রতিমূর্তি বলা হচ্ছিল, এ মুক্তির কারণে স্বাভাবিকভাবেই স্বরটা নিচু করতে হয়েছে ভারতের।

অভিনন্দনের ধরা পড়ার মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, মাত্র দুই তিন সেকেন্ড সময় পেলেই হয়তোবা এতকিছুর আর কিছুই হতো না।

মিগ-২১ যুদ্ধবিমান ধ্বংস হওয়ার পর পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মিরের হোরান গ্রামে নেমেছিলেন অভিনন্দন বর্তমান। এ হোরান গ্রামের অবস্থান নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে।

২৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের আকাশে অনুষ্ঠিত ‘ডগফাইট’ থেকে শুরু করে অভিনন্দনের প্যারাসুটে নেমে আসা এবং পাক সেনার হাতে ধরা পড়া পর্যন্ত পুরো ঘটনা দেখেছেন মোহাম্মদ কামরান নামের স্থানীয় এক যুবক।

কামরান জানান, ঘটনার দিন ২৭ ফেব্রুয়ারি নিয়ন্ত্রণরেখার আকাশে অন্তত ছ’টি যুদ্ধবিমান দেখেছিলেন তিনি। কামরান বলেন, আকাশে ছ’টি যুদ্ধবিমানের যুদ্ধ দেখেছি। তার মধ্যে একটি এসেছিল ভারতের দিকের পাহাড়ের আড়াল থেকে। সেটাকে তাড়া করছিল অন্য একটি যুদ্ধবিমান, সম্ভবত সেটি পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর। দু’টোই আকাশে চক্কর কাটছিল। তার পর হঠাৎই একটিতে আগুন ধরে গেল। যখনই সেটা নীচের দিকে আগুনের গোলার মতো নেমে আসছিল, তখনই তার ভিতর থেকে একজন যেন ছিটকে বেরিয়ে গেল। তারপর প্যারাসুট নিয়ে পাখির মতো নেমে এল মাটিতে।’

কামরান বলেন, ‘আমি দেখলাম প্যারাসুটে ভারতীয় পতাকা ছিল। কিন্তু ওই পাইলট যেখানে নেমেছিলেন, বুঝতে পারছিলেন না জায়গাটা কোথায়। ততক্ষণে পাকিস্তানের লোকজন তাকে প্রায় ঘিরে ধরেছে। তখনই অভিনন্দন জানতে চান, ‘এটা ভারত না কি পাকিস্তান’। স্থানীয়রা হেয়ালী করে জানায় ওই জায়গা ভারতের মধ্যে। অভিনন্দন নিজে আরো নিশ্চিত হতে জিজ্ঞেস করেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম কী’? উত্তরে স্থানীয়রা বলেন ‘মোদী’। তখন অভিনন্দন নিশ্চিন্ত হয়ে স্লোগান দেন, ‘ভারত মাতা কি জয়’। এবার কিন্তু আর হেয়ালির ধার ধারেনি স্থানীয়রা। পাকিস্তানের নামে স্লোগান দিয়ে উঠতেই অভিনন্দন বুঝে যান, জায়গাটা পাকিস্তান।’

এর পরপরই অভিনন্দন কিছু নথিপত্র বের করে টুকরো করে ছিঁড়ে মুখে পুরে দেন এবং চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন। এরপর তিনি পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে শুরু করলে জনতা তাকে ধাওয়া করে। এ সময় অভিনন্দন শূন্যে কয়েকটি গুলি ছোড়েন। তারপর একটি পুকুরে নেমে পড়েন। স্থানীয় লোকজনের প্রতি পিস্তল তাক করায় ক্ষিপ্ত হয়ে তারা অভিনন্দনকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়তে শুরু করে। ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের সেনা অফিসাররা চলে এসে অভিনন্দনকে তাদের কব্জায় নিয়ে নেন।

কামরান ও আরো কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, যে সময় অভিনন্দনের মিগ-২১ ধ্বংস হয়, বিষয়টি আর কয়েক সেকেন্ড পড়ে ঘটলে তিনি ভারতের মাটিতেই নামতে পারতেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পাকিস্তানের ধাওয়া খেয়ে বিমানটি তখন ভারতের দিকে পালাচ্ছিল। ধ্বংস হওয়ার সময় বিমানের গতিমুখও ছিল ভারতের দিকে। আর মিগটির ধ্বংসাবশেষ যেখানে মিলেছে, সেই জায়গাটি নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে। আর তার ২০০ মিটার এলাকার মধ্যেই ধরা পড়েন অভিনন্দন।

স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, ‘আর দুই-তিন সেকেন্ড সময় পেলেই ভারতের আকাশসীমায় ঢুকে যেতে পারতেন অভিনন্দন।’’ কিন্তু সেই সৌভাগ্য হয়নি। ফলে পাকিস্তানী সেনার হাতে ধরা পড়েন অভিনন্দন।

অনেকে যেমন সারা জীবন হিসেব করতে থাকেন, পরীক্ষায় আর মাত্র কয়েকটি নাম্বার পেলে হয়তো জীবনের মোড়টাই ঘুরে যেতে পারতো, ঠিক তেমনি হয়তো অভিনন্দনও হিসেব করতে থাকবেন, আর কয়েকটি সেকেন্ড পেলে হয়তো জীবনের ইতিহাসটাই অন্য রকম হতো।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top