ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাভেদ জারিফ গত সপ্তাহে পদত্যাগ করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ইনস্টাগ্রামে তিনি তার পদত্যাগের ঘোষণা দেন। অবশ্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তার পদত্যাগের বিষয়টি নাকচ করে দেয়া হয়েছে।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ এক অঘোষিত সফরে তেহরানে আসার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার পদত্যাগের কথা জানান। সফরের সময় বাশার আল আসাদ ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এবং সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনির সাথে সাক্ষাৎ করেন। সিরীয় প্রেসিডেন্টকে ইরানের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে যে সংবর্ধনা দেয়া হয়, সেই অনুষ্ঠানে কেবল এলিট ফোর্স ইসলামী রেভ্যুলশনারি গার্ড বাহিনীর (আরআরজিসি) কমান্ডার কাসেম সুলাইমানি এবং খামেনির রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী আকবর বেলায়েতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। অনেকে মনে করেন, প্রেসিডেন্ট বাশারের সাথে সাউডলাইনে জারিফের সাক্ষাৎই হচ্ছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগের প্রকৃত কারণ। সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের সাথে ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাইডলাইনে আলোচনার সময় বাশার ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জারিপকে সিরিয়া সফরের আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু রুহানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সিরিয়া সফরের বিষয়টি নাকচ করে দেন। প্রকৃতপক্ষে, ইরানে বাশার আল আসাদের সফরের সময় কী ঘটেছিল- সেটাই হলো আসল রহস্য।
জারিফ তার পদত্যাগের ঘোষণা দেয়ার এক সপ্তাহ আগে যে মন্তব্য করেছিলেন, নিঃসন্দেহে তা গুরুত্বপূর্ণ। মিউনিখের নিরাপত্তা সম্মেলন অথবা অন্যান্য ফোরামে তিনি যে মন্তব্য করেছিলেন তাতে বোঝা যায়, তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি নজিরবিহীনভাবে তার অসন্তোষের বিষয় প্রকাশ করেছিলেন। এ ছাড়াও, আসাদ তেহরানে পৌঁছার আগে জারিপের জেনেভা সফরের বিষয় নির্ধারিত ছিল। ওই সফরে তার জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনের ৪০তম অধিবেশনে ইরান সরকারের পক্ষ থেকে বক্তৃতা করার কথা ছিল। ফাঁস হয়ে যাওয়া রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তিনি আকস্মিক ওই সফর বাতিল করেন। তিনি ইসলামিক কনসালটেটিভ অ্যাসেম্বলির পররাষ্ট্রনীতি এবং জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির চেয়ারম্যান হেসমাতুল্লাহ ফালাহাতপিসকে তার সফর বাতিল করার সিদ্ধান্তের কথা জানান। এদিকে ফাঁস হওয়া আরো কয়েকটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, জারিপ কমপক্ষে আরো তিনবার পদত্যাগপত্র পেশ করেছিলেন। কিন্তু সরকার তা নাকচ করে দিয়েছিল। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আগে কয়েকবার তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় এবার তিনি প্রকাশ্যে এবং নিয়ম লঙ্ঘন করেই পদত্যাগের বিষয়টি ইনস্ট্রাগ্রামের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
জাভেদ জারিফ কেন এ ধরনের পদক্ষেপ নিলেন এবং এটা তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে কী ফল বয়ে আনতে পারে? তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার পেছনে যেসব ফ্যাক্টর কাজ করেছে তার প্রধান কারণ হচ্ছে- সরকারের নেতৃত্বের সাথে নীতিগত ব্যাপারে মারাত্মক মতপার্থক্য বা মতদ্বৈধতা। বিশেষভাবে এটা সত্য যে, প্রেসিডেন্ট রুহানি এবং জারিপ দু’জনে ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক পরমাণু চুক্তি রক্ষা তথা চুক্তি বজায় রাখতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ইরানের অর্থনীতি মারাত্মক সঙ্কটে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে ইরানের সরকার ও পার্লামেন্টের মধ্যে টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়। সরকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে যে অর্থায়ন করে, সেটা নিয়ে পার্লামেন্ট ও সরকারে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জাভেদ জারিফ কোণঠাসা হয়ে পড়েন। আর ইরানের পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে খামেনির ছায়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলায়াতি এবং সুলাইমানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকায় জারিপ পদত্যাগ করেন বলে কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন। কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, জারিফ তার পদত্যাগের কথা জানানোর মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে জনপ্রিয়তা যাচাই করায় সুযোগ নিয়েছেন। আবার অন্য কারো কারো মতে, আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান।
এতে কোনো সন্দেহ নেই, জাভেদ জারিফ দেশে বিশেষত তরুণদের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়। তিনি তাদের সমর্থন ও সহানুভূতি পাবেন। তিনি অনেকটা উদারপন্থী। কট্টরপন্থীরা হয়তো তাকে চায় না। কিন্তু জারিপের পদত্যাগের ঘোষণার পর সুলেমানি ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পক্ষে জারিপের অবদানের প্রশংসা করেন। তিনি খামেনির প্রতি তার আনুগত্যেরও প্রশংসা করেন। এতে মনে হয় সুলেমানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাকে সমর্থন করেন।
সব শেষে বলা যায়, পদত্যাগের ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে জারিফ বেশ জনসমর্থন পেয়েছেন। ওই ঘোষণার মাধ্যমে হয়তো তার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্যারিয়ারের অবসান ঘটতে পারে এবং তিনি হয়তো বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে দেশ ত্যাগ করে পশ্চিমা কোনো দেশে গিয়ে ইরানের হয়ে কোনো থিংকট্যাংকের অথবা সরকারের শিক্ষাবিষয়ক কোনো সংগঠনে যোগ দিতে পারেন। এরপর তিনি হয়তো জার্মানিতে ইরানের সাবেক রাষ্ট্রদূত সায়িদ হোসেন মুসাভির মতো (যিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ভার্সিটির ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করছেন) সরকারের হয়ে কাজ করতে পারেন। ইরানের অনেকের অভিমত হচ্ছে, মুসাভি আমেরিকার ইরান সরকারের একজন অনানুষ্ঠানিক রাষ্ট্রদূত- তবে মুসাভি নিজেকে ইরান সরকারের বিরোধী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন।