ইসরাইলি বর্বরতা ও ফিলিস্তিনি জনতার নৈতিক বিজয়

গত সপ্তাহে ফিলিস্তিন একটি নৈতিক বিজয় লাভ করেছে। ফিলিস্তিনের শান্তিপ্রিয় জনতার ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালানোর ওপর জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিল (ইউএনএইচআরসি) একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিপোর্টে গত বছরের মার্চ থেকে শান্তিপ্রিয় ফিলিস্তিনের গাজাবাসীর ওপর ইসরাইলি হত্যার বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

স্বাধীনভাবে পরিচালিত এই আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে দেখানো হয়- ইসরাইলের বিরুদ্ধে গাজায় ফিলিস্তিনি নাগরিকদের বিক্ষোভ মূলত বেসামরিক প্রতিবাদ এবং স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক লক্ষ্যে এ প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

জাতিসঙ্ঘের তদন্তকারীরা ইসরাইলি সৈন্যদের অভিযুক্ত করে যে, ‘তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ওপর গুলিবর্ষণ করেছে। তারা না সরাসরি কোনো যুদ্ধ করছিল, আর না তারা ইসরাইলি সৈন্যদের জন্য হুমকি ছিল। এরপরেও ইসরাইলি বাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ চালায়।

তদন্তকারীরা সতর্ক করেছেন যে, ইসরাইলি সৈন্যদের এই গুরুতর মানবাধিকার ও মানবিক আইন লঙ্ঘনের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা যেতে পারে।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনের দেয়া তদন্ত অনুযায়ী, গত বছরের ৩০ মার্চ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সময়ে ১৮৯ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। কমিশন জানিয়েছে, ইসরাইলের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ১৮৩ জন নিহত হয়েছেন এবং ছয় হাজার ১০৬ জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়াও তিন হাজার ৯৮ জন ফিলিস্তিনি বুলেট, রাবার বুলেট বা টিয়ার গ্যাসের আঘাতে আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩৫ জন শিশু, তিনজন স্বাস্থ্যকর্মী ও দুইজন সাংবাদিক যাদের স্পষ্ট পরিচয় ছিল।

উপরন্তু, ইসরাইলি স্নাইপাররা সাংবাদিক, স্বাস্থ্যকর্মী, শিশু ও প্রতিবন্ধী মানুষের পরিচয় নিশ্চিত হয়েই গুলি চালিয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আর অন্যান্য প্রতিবেদনের মতো এই প্রতিবেদনটিও ইসরাইল প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ একে পক্ষপাতদুষ্ট ও ‘ইহুদিবিরোধী’ প্রতিবেদন বলে উল্লেখ করেছে।

কিন্তু এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর কী হবে? এতসব প্রতিবেদন থাকার পরেও ইসরাইল তার সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে বেরিয়ে আসছে না। উদাহরণস্বরূপ ২০০২ সালে ইসরাইলি সৈন্যরা পশ্চিম তীরের জেরিন রিফিউজি ক্যাম্পে আক্রমণ করে। এ আক্রমণ নিয়ে পরবর্তীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ সময় ইসরাইলি বাহিনী ৫২ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে যাদের মধ্যে ২২ জনই বেসমারিক ফিলিস্তিনি নাগরিক। বেশির ভাগের মতে, তারা নির্বিচারে ও অনৈতিক উপায়ে এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। তদন্তে এটাও পাওয়া যায় যে, ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ‘মানব ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করে এবং তারা বাছবিচারহীন ও জোরপূর্বক বল প্রয়োগ করে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সিনিয়র গবেষক এবং তদন্ত দলের সদস্য পিটার বুকার্ট উল্লেখ করেন, জেনিনে ইসরাইলি বাহিনীর যেসব অপরাধ নথিভুক্ত করা হয়েছে সেগুলো অত্যন্ত গুরুতর এবং কিছু ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধের শামিল বলে মনে হয়। ইসরাইল প্রতিবেদনটিতে নিজেদের বিভিন্ন দিক তুলে সেটি অস্বীকার করে।

জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং টিমের জন্য একটি প্রস্তাবনা পাঠান, এটা ‘দুঃখজনক’ যে, ইসরাইল এ প্রতিবেদনটি অস্বীকার করেছে। এ সময় নিরাপত্তা পরিষদে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নেয়া রেজুলেশন যুক্তরাষ্ট্র ঠেকিয়ে দেয়ার সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যায়।

জাতিসঙ্ঘে কিউবার প্রতিনিধি ১৪০৫ (২০০২) রেজুলেশনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে বলেন, এটা হাস্যকর যে এই দেশটিই প্রথমে এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে এখন আবার তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছে। এ সময় তিনি বলেন, জাতিসঙ্ঘের অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া উচিত। কেননা তারা ইসরাইলকে যুদ্ধবিমান ও বিভিন্ন মরণাস্ত্র সরবরাহ করে, যা দিয়ে তারা ফিলিস্তিনের ওপর হামলা চালায়।

২০০৯ সালে ইউএনএইচআরসি অন্য আরেকটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘ফিলিস্তিন ও অন্যান্য আরব অঞ্চলের মানবাধিকার’ শিরোনামে, যা গোল্ডস্টোন প্রতিবেদন নামে পরিচিত। এটি ২০০৮-০৯ সালে গাজা উপত্যকায় চালানো ইসরাইলি বাহিনীর বিভিন্ন অপরাধের প্রতিবাদ ছিল। এই প্রতিবেদনটি দক্ষিণ আফ্রিকার বিচারক রিচার্ড গোল্ডস্টোনের করা ছিল। ইসরাইল এই প্রতিবেদনটি সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে।

২০১৭ সালেও পশ্চিম এশিয়ার অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পরবর্তীতে ইসরাইলি চাপের কারণে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস নিজেকে এর থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন।

এসব প্রতিবেদনের সবই ইসরাইলি বর্বরতার স্বাক্ষর রয়েছে। আর তারা যতই বল প্রয়োগ করে প্রতিবেদন ধামাচাপা দিয়ে থাকুক, সত্য এক দিন প্রকাশিত হয়ে পড়বে।

সুতরাং এটা আশার কথা যে, এটা শুধু ফিলিস্তিনিদের নৈতিক বিজয় নয়, বরং এর ফলে ইসরাইলকে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর ইসরাইলি জোট চাপ সৃষ্টি করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হতে হবে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top