নিপাহ ভাইরাস : প্রতিরোধ ও প্রতিকার

১৯৯৪ সালে অস্ট্রেলিয়ায় সর্বপ্রথম নিপাহ ও হেন্দ্রা ভাইরাসজনিত মস্তিষ্ক প্রদাহ শনাক্ত করা হয়। তখন অবশ্য এই ভাইরাসটির নিপাহ নামকরণ করা হয়নি। পরবর্তীকালে ১৯৯৮-৯৯ সালে মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে এ ধরনের মস্তিষ্ক প্রদাহের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার কয়েকটি এলাকায় শূকর খামারের কর্মী ও শ্রমিকদের মধ্যে এ রোগটি দেখা দেয়। এ সময়ে প্রায় তিন শতাধিক মানুষ মস্তিষ্ক প্রদাহের আক্রান্ত হয় এবং তাদের মধ্যে ১০৫ জন মৃত্যুবরণ করে। ফলে রোগটি চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং বিস্তারিত গবেষণার ফলে নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব হয়। দেখা গেল, নিপাহ ভাইরাস আসলে এক ধরনের প্যারা মিক্সোভাইরাস। অনেক প্যারামিক্সো ভাইরাসের মধ্যে আমাদের অতি পরিচিত একটি প্যারামিক্সোভাইরাস হচ্ছে- হামের ভাইরাস। গবেষকেরা পরীক্ষা করে দেখতে পেয়েছেন নিপাহ ভাইরাস প্যারামিক্সোভাইরাস হলেও এটি একটি নতুন ধরনের ভাইরাস এবং প্রাণিদেহ থেকে এটি মানুষের শরীরে সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে।

বনের বাদুড়ের মুখগহ্বরে মূলত এই ভাইরাস বসবাস করে। মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে এ ভাইরাস মূলত মানুষ এবং শূকরের শরীরে সংক্রমণ ঘটিয়েছিল; তবে এর দ্বারা বিড়াল, কুকুর এবং ঘোড়া আক্রান্ত হওয়ার নজির পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাস : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং মার্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এবং মার্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যাবলি থেকে দেখা যায়- বাংলাদেশে এ বছর মার্চ মাসের মধ্য ভাগ থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ছয় সপ্তাহে ফরিদপুর জেলার ৩০ জন মানুষ এ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন এবং তাদের মধ্যে ১৮ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে বাংলাদেশে এবারই প্রথম নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটল তা কিন্তু নয়। অতীতে একাধিকবার বাংলাদেশ নিপাহ ভাইরাসজনিত মস্তিষ্ক প্রদাহের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। এর মধ্যে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে মেহেরপুর (মে, ২০০১), নওগাঁ (জানুয়ারি, ২০০৩), মান্দা ও জয়পুরহাটে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০০৪) আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে। ২০০১ সালের এপ্রিল-মে মাসে মেহেরপুরে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ৯ জন মৃত্যুবরণ করেন। তাদের মধ্যে ৭ জন একই পরিবারের সদস্য ছিলেন। এই সময়ে ওই এলাকায় আরো ১৮ জন একই রকম রোগে আক্রান্ত হয়ে ছিলেন। তবে তারা আরোগ্য লাভ করেন। মেহেরপুরে আক্রান্ত রোগীদের গড় বয়স ছিল চার বছর।

২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে নওগাঁর দুটি গ্রামে আবার এই ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এ সময়ে ১৭ জন আক্রান্ত হন এবং এদের মধ্যে আটজন মৃত্যুবরণ করেন।
এ দুটি স্থানে সংক্রমণের ফলে আক্রান্ত অন্তত ২৫ জন রোগীর শরীরে নিপাহ ভাইরাসের উপস্থিতি প্রমাণ হয়েছে।

অতীতেও বাংলাদেশে এ ধরনের মস্তিষ্ক প্রদাহের সংক্রমণ ঘটেছে। তবে তখন রোগের কারণ অনুসন্ধান এবং ভাইরাস শনাক্ত করার এত কলাকৌশল জানা ছিল না। ফলে এসব রোগের কারণ অজানা রয়ে গেছে, তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই ধারণা নিপাহ ভাইরাসের অস্তিত্ব বাংলাদেশের জন্যও সম্ভবত নতুন কিছু নয়।

নিপাহ ভাইরাস মানুষের শরীরে কী করে?
নিপাহ ভাইরাস মানুষের শরীরে ঢুকে কিভাবে কী করে, তা আসলে এখনো তেমন স্বচ্ছ নয়। তবে বিগত ১০ বছরে অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশে এই রোগটি নিয়ে যে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে, তা থেকে অনেক তথ্য উদঘাটিত হয়েছে।

এখন সব বিশেষজ্ঞই একমত যে, নিপাহ ভাইরাস মানুষের শরীরে ঢোকার পরে, রক্তনালীর অন্তরাবরণীর কোষ এবং মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষকে আক্রমণ করে। রক্তনালীর ভেতরের আবরণী কোষ আক্রান্ত হওয়ায় প্রদাহ সৃষ্টি হয় এবং তার ফলে রক্তনালীতে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। অর্থাৎ রক্তনালীর প্রদাহ এবং রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া (ঠধংপঁষরঃরং ধহফ ঃযৎড়সনড়ংরং) এ রোগের মূল ক্ষতিকর প্রক্রিয়া নিপাহ ভাইরাস মস্তিষ্কের ভেতরের রক্তনালী ছাড়া ফুসফুস হৃৎপিণ্ড এবং কিডনির রক্তনালীকেও আক্রমণ করতে পারে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে- এই ভাইরাস এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছোট ছোট রক্তনালীতে প্রদাহ সৃষ্টি করলেও মাঝারি এবং বড় রক্তনালীতে কোনো প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে না। এ ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে মস্তিষ্ক প্রদাহের পর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় ফুসফুস এবং এ কারণে রোগীর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হতে দেখা যায়।
নিপাহ ভাইরাসজনিত মস্তিষ্ক প্রদাহের লক্ষণ-উপসর্গ :

বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় আক্রান্ত রোগীদের বিবরণ এবং মালয়েশিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, নিপাহ ভাইরাসজনিত মস্তিষ্ক প্রদাহের রোগীদের প্রধান লক্ষণ উপসর্গ হচ্ছে- স্বল্প স্থায়ী কিন্তু উঁচু মাত্রার জ্বর। জ্বরের সাথে বেশির ভাগ রোগীর তীব্র মাথাব্যথা থাকে (৬০-৮০%)। আক্রান্ত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই রোগীরা ঝিমুতে থাকে এবং সহসা অচেতন কিংবা অজ্ঞান হয়ে যায়। বাংলাদেশে আক্রান্ত রোগীদের অনেকেরই কাশি এবং তীব্র শ্বাসকষ্ট ছিল। যার ফলে মনে হতে পারে এরা নিউমোনিয়া কিংবা হাঁপানিতে আক্রান্ত। এ ছাড়া, অনেকের বমি, খিঁচুনি, ডায়রিয়া এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তক্ষরণের ইতিহাস পাওয়া গেছে।

নিপাহ ভাইরাসজনিত মস্তিষ্ক প্রদাহ কিভাবে নির্ণয় করা যায়
নিপাহ ভাইরাস ছাড়া অন্তত আরো ১০০টি ভাইরাস মানুষের মস্তিষ্ক প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের মস্তিষ্ক প্রদাহের রোগীদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- কয়েক দিনের উঁচু মাত্রার জ্বরের পরেই রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়। কিন্তু এই মস্তিষ্ক প্রদাহ কী দিয়ে, কেমন করে ঘটলো- তা বের করার জন্য অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ল্যাবরেটরির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার হয়। আক্রান্ত রোগীর মস্তিষ্ক রস, রক্ত, নাক ও গলগহ্বরের রস, মলমূত্র ইত্যাদি সংগ্রহ করে এসব পরীক্ষা করতে হয়। এসব পরীক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছেÑ আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে নিপাহ ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হয়েছে কি না তা খুঁজে দেখা কিংবা নিপাহ কি না তা খুঁজে দেখা কিংবা নিপাহ ভাইরাসের মূল গাঠনিক উপাদান আরএনএ শনাক্ত করার চেষ্টা চালানো। ইমিউনো হিসেট্রাকেমিস্ট্রি এবং পিসিআর প্রযুক্তির সাহায্যে এ কাজগুলো করা হয়।
নিপাহ ভাইরাসজনিত মস্তিষ্ক প্রদাহের সাথে মিল রয়েছে যেসব রোগের :

বেশ কতগুলো রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গের সাথে নিপাহ ভাইরাসজনিত মস্তিষ্ক প্রদাহের মিল রয়েছে, যেমন- মস্তিষ্কাবরণীয় প্রদাহ বা মেনিনজাইটিস, সান্নিপাতিক বা আন্ত্রিক জ্বর, মস্তিষ্ক কান্দের রক্তক্ষরণ যকৃত প্রদাহজনিত মস্তিষ্ক বিকলতা, মৃগী রোগ ইত্যাদি।

নিপাহ ভাইরাসজনিত মস্তিষ্ক প্রদাহের চিকিৎসা :
যেহেতু এ ধরনের মস্তিষ্ক প্রদাহের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, এ জন্য তাড়াতাড়ি রোগ শনাক্ত করা যায়, ততই মঙ্গল। এ ধরনের রোগীদের মূলত উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা দেয়া হয়। অন্যান্য ভাইরাসজনিত রোগের মতো এ ক্ষেত্রেই পূর্ণ বিশ্রাম, উপযুক্ত পুষ্টি ও পানীয় পান, জ্বর নিবারক ওষুধ ইত্যাদি দিতে হবে। ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটলে কিংবা ঘটার আশঙ্কা থাকলে নিপাহ উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক সেবন প্রদাহের করানো যেতে পারে। রোগীকে ঘন ঘন পাশ বদলিয়ে দিতে হবে। যেন শরীরে ঘা না দিয়ে যায়।
বর্তমানে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে ওষুধ আবিষ্কার করার জন্য ব্যাপক গবেষণা চলছে। স্টেরয়েড ব্যবহার করে অনেক ক্ষেত্রে সুফল পাওয়া গেছে।

কিভাবে প্রতিরোধ করা যেতে পারে
বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে বাদুড় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা বাদুড়ে খাওয়া ফল, তালগাছের রস কিংবা খেজুর গাছের রস খেয়ে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। অতএব এ জাতীয় খাদ্য গ্রহণের আগে নিশ্চিত হতে হবে যে তা বাদুড়ের সংস্পর্শে আসেনি। এ ছাড়া আক্রান্ত রোগী দ্রুত শনাক্ত করে তা উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। নিপাহ ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখনো কোনো টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। তবে এর জন্য ব্যাপক গবেষণা চলছে। বাংলাদেশে ভাইরাসজনিত মস্তিষ্ক প্রদাহের প্রকোপ ও কারণ শনাক্ত করার জন্য আইসিডিডিআরবি, সিডিসি এবং কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজের উদ্যোগে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মাঠপর্যায়ে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দ্রুত শনাক্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে।

পরিশেষে একটি কথা বলতে হয়, নিপাহ ভাইরাসজনিত মস্তিষ্কে প্রদাহ একটি ঘাতক ব্যাধি। এ রোগে মৃত্যুর হার ৩০-৪০ শতাংশ। অতএব এ রোগ প্রতিরোধের জন্য শুরু থেকেই আমাদের তৎপর হতে হবে এবং এ জন্য যথেষ্ট জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top