সুদানে কেন এত সঙ্ঘাত

সুদানে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় গত ১৯ ডিসেম্বর। প্রাথমিকভাবে আন্দোলনকারীদের অভিযোগ ছিল মূল্যস্ফীতি ও দারিদ্র্য। কিন্তু দ্রুতই তা সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। কারণ সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরকে আরো এক মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট পদে থাকার সুযোগ করে দিতে একটি সংশোধনী পাসের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সংসদের বেশির ভাগ সদস্য এই সংশোধনী পাসের পক্ষে থাকলেও বিরোধীরা প্রতিবাদ জানায়। গত ফেব্রুয়ারিতে জরুরি অবস্থা জারি করে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ের সরকার বিলুপ্ত ঘোষণা করেন তিনি। ভাইস প্রেসিডেন্ট করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী আওয়াদ মোহাম্মদ আহমেদ ইবনে আওয়াদকে।

টেলিভিশনে প্রচারিত এক ভাষণে বলেছিলেন, সবগুলো মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসন গঠন করছেন। পদে বহাল থাকছেন শুধু প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী। তার দাবি, তিনি অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন করবেন। তিনি বিরোধীদের আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানান। কিন্তু দেশটির সবচেয়ে বড় বিরোধী দল ‘ন্যাশনাল কনসেন্সাস ফোর্সেসের’ পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বছরব্যাপী জরুরি অবস্থার জারির যে ঘোষণা বশির দিয়েছেন, তার একমাত্র পরিণতি আরো তীব্র আন্দোলন।

ওমর আল বশির সুদানের সাবেক সেনাপ্রধান। ১৯৮৯ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ২০১০ ও ২০১৫ সালে নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট হিসেবে। তার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ৩০ বছর ধরে দেশটির প্রেসিডেন্ট তিনি। এই শাসনকালে এ বছরের মতো তীব্র বিক্ষোভ আর দেখা যায়নি। সবশেষ দলীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন বশির। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি।

মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি, গণমাধ্যমের ওপর আঘাত, অস্বচ্ছ নির্বাচন, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ওপর আঘাত, এমনই বিবিধ অভিযোগ রয়েছে বশির সরকারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ আজকের নয়, দীর্ঘ দিন ধরে বহু সংগঠনের রিপোর্টে বারবার উঠে এসেছে সুদানের ভয়াবহতার প্রসঙ্গ। এসেছে সেখানকার গোপন জেলের কথা। বহু মানবাধিকার কর্মীকে দীর্ঘ দিন জেলে আটকে রাখা হয় এবং অত্যাচার চালানো হয়। কিন্তু কোনো অভিযোগই মানতে রাজি নয় সরকার।

দীর্ঘ দিন ধরেই ‘কনফ্লিক্ট জোন’ বা যুদ্ধাঞ্চল হয়ে রয়েছে সুদান। সশস্ত্র সরকারবিরোধী শক্তির সাথে সেখানে লাগাতার সংঘর্ষ লেগে আছে সরকারপক্ষের। অভিযোগ, বিদ্রোহীদের কোণঠাসা করতে সাধারণ মানুষের ওপরেও নানারকম অত্যাচার চালায় সুদান সরকার।

দক্ষিণ সুদান আলাদা হওয়ার পর ২০১৫ সালে সুদানে প্রথম নির্বাচন হয়। বিরোধীদের বক্তব্য নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছিল। প্রায় সব ভোটই লুট করেছিল বর্তমান সরকার। সাধারণ মানুষের রায় ভোটে প্রতিফলিত হয়নি। কিন্তু বিরোধীদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে সরকার বলেন, দুর্নীতি প্রমাণ করুক তারা। আফ্রিকান ইউনিয়নও সুদানের নির্বাচনকে স্বচ্ছ বলতে রাজি ছিল না। তাদের কাছে রিপোর্ট ছিল, নির্বাচনের সময় বিরোধী তো বটেই, এমনকি বহু সাংবাদিককেও গ্রেফতার করে গোপন কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। সুদানের বিরুদ্ধে আরো একটি বড় অভিযোগ হলো, সেখানে সংবাদমাধ্যমকে ঠিকমতো কাজ করতে দেয়া হয় না। সরকারবিরোধী কথা বললেই সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হয়।

সাম্প্রতিক অতীতে সুদানে এমনই ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল যে, বিশ্বের প্রায় সব মানবাধিকার সংগঠন ঘটনাটিকে ‘গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছিল। খুন, ধর্ষণ, অকথ্য অত্যাচার কিছুই বাদ দেয়নি সরকারের সৈন্যবাহিনী। দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আসা মানবাধিকার কর্মীদের ওপরেও অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছিল।

অবস্থার পরিবর্তনও হয়। সুদানের ওপর থেকে ২০ বছর ধরে কঠোর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯৭ সাল থেকে আরোপ করা এই নিষেধাজ্ঞার কিছুটা প্রত্যাহার শুরু হয় ২০১৭ সালে। তখন যুক্তরাষ্ট্র বলে, খার্তুম সরকার তাদের সঙ্ঘাতপূর্ণ এলাকায় অনেকটা ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়েছে। সেই সাথে তারা সেখানে মানবিক ত্রাণ পৌঁছাতেও ভালো ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া তারা আঞ্চলিক সঙ্ঘাত দূরীকরণ ও সন্ত্রাসের হুমকি মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহায়তা কার্যক্রমও বজায় রেখেছে। আর এসব কারণেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর থেকে আরোপ করা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করছে।

সুদান আফ্রিকা মহাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি রাষ্ট্র। রাজধানী নাম খার্তুম। সরকারিভাবে এর নাম সুদান প্রজাতন্ত্র। এটি এলাকার দিক থেকে আফ্রিকার বৃহত্তম দেশ। এর উত্তরে মিসর, উত্তর-পূর্বে লোহিত সাগর, পূর্বে ইরিত্রিয়া ও ইথিওপিয়া, দক্ষিণ-পূর্বে কেনিয়া ও উগান্ডা, দক্ষিণ-পশ্চিমে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, পশ্চিমে চাদ এবং উত্তর-পশ্চিমে লিবিয়া অবস্থিত।

সুদান পৃথিবীর সবচেয়ে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেশগুলোর অন্যতম। এর উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর এলাকার বেশির ভাগ মানুষ মুসলিম। দক্ষিণাঞ্চলের অনগ্রসর এলাকার অধিবাসীদের বেশির ভাগ অমুসলিম। সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিভাজন ও মতবিরোধের ফলে সুদানে আধুনিককালের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে।

সুদানে ষাট হাজার বছর আগেও মানববসতি ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে এমনই প্রমাণ মেলে। প্রায় আট হাজার বছর আগে এ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে মানববসতি শুরু হয়। তারা গৃহে পশুপালন করত, শস্য ফলাত ও মাছ ধরত। প্রাচীনকাল থেকেই সুদানের সাথে মিসরের শক্তিশালী ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বন্ধন ছিল। দেশটির উত্তরাঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের এবং দক্ষিণাঞ্চলে খ্রিষ্টানদের আধিপত্য।

১৯৮৯ সালের ৩০ জুন কর্নেল ওমর আল বশির একদল সামরিক কর্মকর্তার সমর্থন নিয়ে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থান ঘটান। তিনি দেশটিতে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। ক্ষমতা দখলের পরপরই তিনি গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। ১৯৯৬ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি নিজেকে সুদানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। সে বছর দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও হয়। একমাত্র প্রার্থী ছিলেন তিনি নিজেই। এর পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সুদানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে।

সুদান জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রেসিডেন্সিয়াল যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান এবং সেনাপ্রধান হলেন প্রেসিডেন্ট। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সরকার ও নির্বাচিত দু’টি কক্ষের। বিচার বিভাগ স্বাধীন। দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ১৯৮৯ সালে বিপ্লবের পর দেশটিতে নতুন আঙ্গিকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ১৯৯৩ সালে সুদান একদলীয় সরকারের দেশে পরিণত হয়। সুদানে নিম্নকক্ষের সদস্য ৪৫০ জন এবং উচ্চকক্ষে ৫০ জন।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে তেমন ভালো সম্পর্ক নেই সুদানের। ১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র সুদানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। আলকায়েদার ঘাঁটি রয়েছে সন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র খার্তুমে মিসাইল হামলা চালায়।

সুদানি তেলের অন্যতম গ্রাহক চীন। স্বাভাবিকভাবেই দেশটির সাথে ভালো সম্পর্ক রয়েছে সুদানের। তবে প্রতিবেশী দেশ শাদ ২০০৫ সালে সুদানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ২০০৮ সালে সুদান শাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।

সুদানের সরকারি ভাষা আরবি ও ইংরেজি। উত্তরাঞ্চলের প্রধান ভাষা আরবি। এ ছাড়া পূর্ব, পশ্চিম ও মধ্য সুদানেও আরবি প্রচলিত। তবে এসব এলাকায় উপজাতীয় ভাষাও প্রচলিত রয়েছে। সুদানের সব অঞ্চলেই শিক্ষিত উপজাতীয়রা ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করে। সুদানে বর্তমানে দেশটিতে ১৩৩টি ভাষা টিকে আছে। দেশটির ৭০ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। আদিবাসী ২৫ শতাংশ ও মাত্র পাঁচ শতাংশ খ্রিষ্টান। এখানকার খ্রিষ্টানরা রোমান ক্যাথলিক চার্চের অনুসারী।

যুদ্ধাক্রান্ত এক রুক্ষ মরুভূমির দেশ সুদানের বিস্তীর্ণ মরু এলাকায় রয়েছে হাজার বছরের পুরনো বহু পিরামিড। আকারে কিছুটা ছোট হয় সুদানের পিরামিড, যাদের সংখ্যা ২৫০টিরও বেশি।
সুদানের সামরিক বাহিনীর নাম ‘সুদানিস পিপলস আর্মড ফোর্সেস’। মোট সদস্য দুই লাখ। সেনা, নৌ, বিমান, সীমান্ত ও নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত আর্মড ফোর্সেস বাহিনী। সুদানের এই বাহিনীটি অত্যন্ত দক্ষ।

উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও সুদানের অর্থনীতিতে সমস্যা লেগেই আছে। ফলে আইএমএফের পরামর্শে ১৯৯৭ সালে সুদান সামষ্টিক অর্থনীতিতে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করে। ১৯৯৯ সালে দেশটি অপরিশোধিত তেল রফতানি শুরু করে। সে বছরই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রফতানি আয় সম্ভব হয়। তেল রফতানির ফলে ২০০৩ সালে দেশটিতে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ছয় দশমিক এক শতাংশে। বর্তমানে দেশটির প্রধান রফতানি পণ্য হচ্ছে তেল। আর দেশটিতে তেলের উৎপাদন দিন দিন নাটকীয়ভাবে বাড়ছে। পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস, স্বর্ণ, সিলভার, ক্রোমি, অ্যাসবেস্টস, ম্যাঙ্গানিজ, জিপসাম, জিঙ্ক, লোহা, সিসা, ইউরেনিয়াম, কপার, কোবাল্ট, গ্রানাইট, নিকেল ও তামাসহ গুরুত্বপূর্ণ খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ সুদান।

তবে দেশটির অর্থনীতির অন্যতম খাত হচ্ছে কৃষি। উৎপাদক শ্রেণীর ৮০ শতাংশই এ পেশায় নিয়োজিত। দেশের মোট জাতীয় আয়ের ৩৯ শতাংশের জোগান আসে কৃষি থেকে। কিন্তু সেচের ক্ষেত্রে এখনো সুদানিরা বেশির ভাগ সময় বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। ধারাবাহিক অস্থিতিশীলতার কারণে কৃষিপণ্যের দাম এখানো খুব বেশি। এই কৃষিপণ্যের দাম নিয়েই শুরু হয়েছে চলমান বিক্ষোভ। চলতি বছর রুটির ওপর ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্ত নিলে সুদানে রুটির মূল্য দ্বিগুণ হয়ে যায়। এর জেরে দেশটিতে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হলে বাধ্য হয়ে গত নভেম্বরে আটার ওপর ৪০ শতাংশ ভর্তুকি বাড়ায় সরকার। সম্প্রতি সরকারের ভর্তুকির আটা ও জ্বালানি তেলের সঙ্কটের কারণে বিক্ষোভ শুরু হয়। একপর্যায়ে আতবারা শহরে ক্ষমতাসীন দলের সদর দফতরসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের পর জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। জরুরি অবস্থা উপেক্ষা করেও সেখানে রাস্তায় নেমে আসে বিক্ষোভকারীরা। যার ধারাবাহিকতা চলছে এখনো।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top