দক্ষিণ এশিয়ায় সৌদি পরিকল্পনা

পাকিস্তান-ভারত প্রবল উত্তেজনা প্রশমনে যে কয়েকটি দেশ সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রেখেছে তার অন্যতম হলো সৌদি আরব। কেবল টেলিফোন সংলাপ করেই ক্ষান্ত হয়নি দেশটি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবায়েরকে পাকিস্তান পাঠিয়েছে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের বিশেষ বার্তা নিয়ে। বার্তাটির বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয়নি, তিনি পাকিস্তানে কী কী নিয়ে আলোচনা করেছেন, তাও জানা যায়নি। এমনকি তিনি পাকিস্তান-ভারত উত্তেজনা হ্রাসের চেষ্টায় এই সফর করেছেন, তাও আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়নি। তবে তার দৌত্যকর্মেই হোক, আর চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার চেষ্টাই হোক আটক ভারতীয় পাইলটকে মুক্তি দিয়েছে পাকিস্তান, দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা সাময়িকভাবে হলেও প্রশমিত হয়েছে।

পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যকার বিরোধে সৌদি আরবের এ ধরনের অংশগ্রহণ নজিরবিহীন। এর পাশাপাশি আরেকটি ঘটনাও ঘটেছে। সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের আমন্ত্রণে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সম্মেলনে বক্তৃতা করেছেন। পাকিস্তানের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বক্তৃতা করার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু পরক্ষণেই আবার পাকিস্তানের পক্ষও ওআইসি নেয় এবং কাশ্মির প্রশ্নে দেশটির অবস্থান সমর্থন করে ও কাশ্মিরিদের ওপর ভারতীয় নির্যাতনের তীব্র নিন্দা করে।

সাম্প্রতিক সময়ে ক্রাউন প্রিন্সের পাকিস্তান, ভারত ও চীন সফরের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের প্রতি সৌদি আরবের গুরুত্বারোপের বিষয়টিই নতুন মাত্রা পেয়েছে এই কূটনীতিতে।

কেবল পাকিস্তান আর ভারতই নয়, আফগানিস্তান সঙ্কট নিরসনেও সৌদি আরব চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে সৌদি আরব যে বড় ধরনের পরিকল্পনা কষছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকে সামান্যই।

পাকিস্তানে যখন সৌদি আরব বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দেয়, তখন অনেকেই মনে করেছিল, সিরিয়া আর ইয়েমেনের যুদ্ধ ও নিজেদের প্রতিরক্ষা জোরদার করতেই পাকিস্তানের দিকে হাত বাড়িয়েছে সৌদি আরব। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বিষয়টি কেবল তাতেই সীমিত নয়। বরং ক্রাউন প্রিন্সের নেতৃত্বে দেশটি ভিশন ২০৩০-এর আলোকে অর্থনীতিকে নানামুখী করার যে স্বপ্ন দেখছে, এই অঞ্চলে বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন শুরু করেছে।
বিশেষ করে চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর যে সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে, সেই সুযোগটি পুরোপুরি লুফে নেয়ার পরিকল্পনা করছে সৌদি আরব।

প্রতিরক্ষা নয়, বরং পাকিস্তানের ব্যাপারে সৌদি অবস্থানে সবচেয়ে বেশি যা দেখা যাচ্ছে তা হলো, বিনিয়োগ। সৌদি বিনিয়োগের একটি বড় অংশ যাচ্ছে গোয়াদরে সৌদি আরামকো তেল শোধনাগারে। ভারত মহাসাগরের কৌশলগত স্থানে থাকা বন্দরটি এই অঞ্চলে দেশটির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি ইরানেরও খুব কাছে।

গোয়াদরে ও এর আশপাশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম এখনো গতিশীল হয়নি, এর পূর্ণ সম্ভাবনা বাস্তবায়িত করতে পারেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সৌদি তেল শোধনাগার একটি বড় বিষয়। এই শোধনাগারটি হরমুজ প্রণালীর ঠিক বাইরে, পারস্য উপসাগরীয় জাহাজ চলাচল লেনের কাছাকাছি একটি কৌশলগত স্থানে সৌদিদের পা রাখার একটি স্থান দেবে। তা ছাড়া পাকিস্তানের সৌদি অপরিশোধিত তেল কেনার বিষয়টি তো রয়েছেই।

সৌদি সরকারি মালিকানাধীন মিডিয়া হাউজ আল-আরাবিয়া সম্প্রতি পাকিস্তানে সৌদি বিনিয়োগ, বিশেষ করে গোয়াদর প্রসঙ্গে বলেছে যে, গোয়াদরে বিনিয়োগ করার ফলে সৌদি আরবের বিনিয়োগ বৈচিত্র্যমুখী হবে, এটি ভিশন ২০৩০-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও এর ফলে তেলের ওপর সৌদি আরবের নির্ভরশীলতা কমাবে।

অধিকন্তু, গোয়াদরে সৌদি তেল শোধনাগারটি উপসাগর থেকে চীনের তেল পরিবহনের রুটে তাকে অবস্থান করার সুযোগ দেবে। প্রতিবেদনটিতে যথাযথভাবেই বলা হয়েছে, বিশ্ব বাণিজ্য ট্রাফিকে অংশগ্রহণের ভালো একটি সুযোগ পেয়েছে। গোয়াদরের কৌশলগত অবস্থান অনেক নতুন নতুন বিকল্প সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্বের অন্যতম বড় তেল ভোক্তা হিসেবে চীনকে বিবেচনা করে গোয়াদরে সৌদি উপস্থিতি সব পক্ষের জন্যই উইন উইন অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে।

বিদেশে বিশাল বিশাল বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যমুখী করার সৌদি প্রয়াস প্রতিফলিত হয় এ ধরনের বিনিয়োগে। আবার বাস্তবতা হলো- কেবল পাকিস্তানেই শোধনাগার প্রতিষ্ঠা করছে না সৌদি আরব, ভারতের দিকেও দেশটির নজর রয়েছে।

গত এপ্রিলে সৌদি আরামকো ভারতে একটি পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা এবং ভারতের রাজ্য-মালিকানাধীন ৪৪টি কোম্পানির একটি কনসোর্টিয়ামের সাথে ৪৪ বিলিয়ন ডলারের তেল শোধনাগার নির্মাণের চুক্তি করেছে। বলা হচ্ছে, এ প্ল্যান্টটি হবে অন্যতম বৃহত্তম শোধনাগার ও বিশ্বের পেট্রোক্যামিক্যাল কমপ্লেক্স। এটি জ্বালানির দ্রুত বর্ধমান চাহিদা ও ভারত ও অন্যান্য স্থানে পেট্রোকেমিক্যালের প্রয়োজন পূরণ করবে।

মাত্র কয়েক দিন আগে আরামকো ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের শোধনাগার ও পেট্রোকেমিক্যালস চুক্তি করেছে। এটি বিশ্বব্যাপী দেশটির অবস্থান জোরদার করা ও বিদ্যমান প্ল্যান্টগুলোর সামর্থ্য বাড়ানোর প্রয়াস।

অর্থাৎ পাকিস্তানে সৌদি বিনিয়োগ বিশেষ কিছু নয়। এমনকি ইয়েমেন বা সিরিয়ার যুদ্ধের সাথেও এর কোনো সম্পর্ক নেই। বরং সৌদি আরবের নিজস্ব বৈশ্বিক অর্থনীতি সম্প্রসারণের মধ্যে এর শেকড় নিহিত রয়েছে।

অবশ্য এই অঞ্চলে সৌদি উপস্থিতির একটি ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে, বিশেষ করে গোয়াদর ও ইরানের চাহাবার বন্দরের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকায়। উল্লেখ্য, ভারতের ধীরে চলার নীতি থেকে ইরান বের হয়ে আসার চেষ্টা করলে চাহাবার বন্দরটিকেও চীন তার মুঠোয় নিয়ে নেয়ার অপেক্ষায় আছে।
তবে এই অঞ্চলে সৌদি আরবের উপস্থিতি আঞ্চলিক সমীকরণ বেশ বদলে দিতে পারে। আর তা হতে পারে ভূ-কৌশলগত প্রেক্ষাপটে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top