দেশের শতকরা ৮৮জন নারী রাস্তায় চলার পথে অপমানজনক মন্তব্যের মুখোমুখি হন। এদের মধ্যে ৮৬ শতাংশ চালক ও চালকের সহকারীর দ্বারা এবং শতকরা ৬৯জন দোকানদার এবং বিক্রেতার মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের শিকার হন।
শিল্পকলা একাডেমিতে একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত ‘শব্দে জব্দ নারী’ অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে আসে। প্রতিবছর ভিন্নধর্মী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে একশনএইড বাংলাদেশ। এবারে শব্দের মাধ্যমে কিভাবে নারীর ক্ষমতায়নের পথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তা দেখাতে চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এজন্য নারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক, সিনেমা এবং প্রাত্যহিক জীবনে যে ধরনের অবমাননাকর শব্দের শিকার হন তার প্রদর্শনীর আয়োজন করে প্রতিষ্ঠানটি। একইসাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আয়োজন করা হয় একটি আলোচনার। অনুষ্ঠানটির শিরোনাম তাই রাখা হয় ‘শব্দে জব্দ নারী’।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন অতিথিরা। এরপর তারা আলোচনায় যোগ দেন। আলোচনা অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘শব্দে জব্দ নারী’ বিষয়ে একটি ধারণাপত্র তুলে ধরেন একশনএইড বাংলাদেশ-এর ম্যানেজার কাশফিয়া ফিরোজ। যেখানে একশনএইড বাংলাদেশ-এর ‘সেইফ সিটিজ ফর উইমেন’ ক্যাম্পেইনের এ গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। গবেষণা আরো বলা হয় ঘরে-বাইরে অবমাননাকর শব্দের ব্যবহার নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করছে। এতে নারীর মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি এখনও প্রশ্নের মুখে। আর এজন্য সমাজ বিশেষজ্ঞরা তাই বলেছেন, ভাষার ব্যবহারে সংবেদনশীলতা না আসলে নারীর ক্ষমতায়ন আসবে না।
এমন পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করে একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ‘ঘরে-বাইরে প্রথমেই একজন নারীকে ভাষার মাধ্যমে হেয় করা হয়, যাতে সে মানসিক ও সামাজিকভাবে আগাতে না পারে। শব্দ, বাক্য এবং উক্তি-তে কোন লিঙ্গ থাকার কথা না। কিন্তু সেই ভাষাকেই লিঙ্গ অনুযায়ী ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন- অনেক সময় মেয়েদের পরিচয় করিয়ে দিতে মেয়ে মানুষ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। মানুষ হিসেবে পরিচয় করানো হয় না। আমরা বুঝে না বুঝে সবাই-ই ভাষার মাধ্যমে নারীকে হেয় করি। এর পরিবর্তন আনতে নারীকেই প্রথমে নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে।’
নারী নেত্রী খুশি কবির বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে নারীদের সব সময় প্রমাণ করতে হয় যে তারাও পারে।আমাদের সমাজে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে নারীদের একটা গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা হয়। শব্দকে তৈরি করা হয় নারীর বিরুদ্ধে।’
দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন বলেন, ‘আমাদের সমাজ ব্যবস্থা অধিকাংশ নারীকে শব্দজটের মধ্যে আটকে রেখেছে। আমরা হয়তো অনেক কিছুই গুরুত্ব দেই না। এজন্য সংবাদ মাধ্যমেও নারীর প্রতি অসংবেদনশীল শব্দ ব্যবহার করা হয়। যদি এই বিষয়ক কোন নীতিমালা থাকতো তাহলে বিষয়টি এতো হালকা হিসেবে দেখা হতো না।’
একশনএইড বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিষদের সদস্য ডা. খলিলুর রহমান বলেন,‘যুগ যুগ ধরে নারীদের দুর্বল হিসেবে দেখার বিষয়টি চলে আসছে। তাদের শব্দের মাধ্যমে জব্দ করা হয়েছে। কিছু কিছু শব্দ আছে যা শুধু জব্দ করে না ধ্বংসও করে। শব্দের অপব্যবহারের কারণে নারীরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন ‘জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নারী শব্দজটে আটকানো হয়। যেমন মেয়েরা বিদ্রোহী হবে এটা আমাদের ভাষার অভিধানেই নেই।’
চিত্র নির্মাতা শামীম আক্তার বলেন, আমরা যতদিন না এই বিষয়গুলো ভালভাবে বুঝবো, প্রতিবাদ করবো ততদিন এর সমাধান আসবে না।
নিউজ২৪ এর বার্তা প্রধানশাহনাজ মুন্নী বলেন, ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য অবশ্যইআমাদের ভিতরের জগতটাকে পরিবর্তন করতে হবে। সামাজীকিকরণে আনতে গুনগত পরিবর্তন।
প্রকাশক মাহরুখ্ মহিউদ্দীন বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনে পুরুষদের যুক্ত করতে হবে। নারী-পুরুষ একে অপরের সম্পূরক। সম্পূরক হিসেবে তারা সমাজকে কিভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে তা নিয়ে কাজ করতে হবে। বাংলা ভাষায় সাহিত্যে লিঙ্গ সংবেদনশীলতা নিয়ে কাজ এবং সমালোচনার সুযোগ থাকতে হবে।’