বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে গত একবছরেরও বেশি সময় ধরে নানামুখী চেষ্টা চললেও তা এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। উল্টো রাখাইনে অন্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সাথে সেদেশের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে নতুন করে মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে আসার শংকা তৈরি হয়েছে।
এমন প্রেক্ষিতে ফের নতুন করে উদ্বেগ বাড়ছে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্টদের।
সেটি দেখতে আমি গিয়েছিলাম উখিয়ার বালুখালি পাহাড়ে। এই পাহাড়েই দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে থাকেন মোমেনা বেগম।
দেড় বছর আগে রোহিঙ্গারা যখন নতুন করে বাংলাদেশে আসা শুরু করে, তখন মোমেনা বেগম তার নিজ বাড়ির উঠানেই জায়গা দিয়েছিলেন একটি রোহিঙ্গা পরিবারকে।
পাশাপাশি বাড়ির বাইরে নিজের জায়গায় রোহিঙ্গাদের অন্তত ৭০টি ঘর তুলতে দিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু মোমেনা বেগমের মনে এখন শংকা ভর করেছে – এসব জায়গা তিনি আদৌ ফিরে পাবেন কি-না।
‘ওরা বেশিদিন থাকবে না – এটা মনে করেই জায়গা দিয়েছিলাম। এখন তো ফেরত যাচ্ছে না।’
এদেরকে আর রাখতে চান না বলে তিনি জানান, ‘এরা অর্ধেক ভালো তো অর্ধেক খারাপ। ওদের জনসংখ্যাও বেশি। কিছু বললে দা-বটি নিয়ে তেড়ে আসে।’
পাহাড় থেকে এবার নিচে চলে আসি। নিচে সমতল ভূমিতে মিষ্টি কুমড়োর চাষ করছেন রিয়াদ মোহাম্মদ।
তিনি বলছিলেন, রোহিঙ্গাদের জায়গা দিতে গিয়ে তার চাষের জমি কমেছে। এছাড়া এখানকার গৃহিণীরা আগের মতো আর গরু-ছাগল পালন করতে পারছেন না।
মি. রিয়াদ বলছিলেন, ‘আমাদের জমির যেগুলো এখনও বাকি আছে, সেখানে আগের মতো ফলন হয় না।’
কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ‘জমির পাশেই রোহিঙ্গাদের টয়লেট, গোসলখানা। ওদের মানুষ বেশি, চাষের জমিতেই ময়লা ফেলে।’
‘আগে বছরে ১ লাখ টাকার আম বিক্রি করতাম। গতবার আম পাকার আগেই সবাই খেয়ে ফেললো।’
এবার আসা যাক শিক্ষা কার্যক্রমে।
উখিয়ার বালুখালি ক্যাম্পের উল্টোপাশেই গড়ে উঠেছে বালুখালি কাশেমিয়া উচ্চবিদ্যালয়। স্কুলটিতে রোহিঙ্গা নিবন্ধন ক্যাম্প থাকায় গত একবছর ধরে শিক্ষা কার্যক্রম একরকম বন্ধই ছিলো।
এখন সেটা চালু হলেও এলাকার যুবসমাজের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন স্কুলটির একজন শিক্ষক।
‘গতবার এসএসসিতে আমাদের স্কুলের রেজাল্ট অনেক খারাপ হয়েছে। এবারো আমরা খুব একটা আশাবাদি না।’
তিনি জানান, ‘স্কুলে এখন শিক্ষার্থীরা কম আসে। …বিশেষ করে যুবক শ্রেণি এখন ক্যাম্প এলাকায় ঘোরাঘুরি করে বেশি। অপরাধ আর অসামাজিক কার্যকলাপ বেড়েছে।’
গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহেই শিশু অপহরণকারী সন্দেহে কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিককে বেধড়ক পেটায় রোহিঙ্গারা।
এছাড়া নিজেদের মধ্যে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটেছে।
প্রশাসনের মধ্যেও উদ্বেগ
উখিয়া এবং টেকনাফে যেখানে স্থানীয় মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ, সেখানে রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা ১১ লাখেরও বেশি ছাড়িয়েছে। ফলে বিভিন্ন ধরণের মানসিকতার এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে।
জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বিবিসিকে জানান, উখিয়া এবং টেকনাফের পরিস্থিতি নিয়ে তারাও উদ্বেগে আছেন।
তিনি বলছিলেন, ‘এখানকার ডেমোগ্রাফিক সিচুয়েশন পরিবর্তন হয়ে গেছে। রোহিঙ্গারাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ।’
এভাবে দীর্ঘদিন সবকিছু চালিয়ে নেয়া কঠিন ব্যাপার হবে বলে তিনি মনে করেন।
‘আমাদের সামাজিক স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তার দিক থেকেও অনেক ঝুঁকি আছে এখানে। এখানকার আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি, নিরাপত্তা পরিস্থিতি কতদিন আমরা ধরে রাখতে পারবো সেটা একটা কঠিন প্রশ্ন।’
সবমিলিয়ে যে অবস্থা তাতে করে রোহিঙ্গাদের দ্রুত নিজ দেশে ফেরানোকেই সমাধান মনে করছে বাংলাদেশ।
এমন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার জাতিসঙ্ঘে নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য সংস্থাটির পক্ষ থেকে কার্যকর সিদ্ধান্ত কামনা করেন।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে নতুন করে সরকারের মধ্যে কেন এই উদ্বেগ?
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বিবিসিকে বলছিলেন, ‘মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোর সাথে সেখানকার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ হচ্ছে। সেখানে ভীতির সঞ্চার হয়েছে।’
‘আমরা আশংকা করছি যে, নতুন করে অনেকে বাংলাদেশে আসার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন।’
‘…আমরা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার দ্রুত অগ্রগতি আশা করেছিলাম। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আরো জোরালো ভূমিকা যেন আসে, সে বিষয়ে আমরা নতুন করে চেষ্টা করছি।’
মনে করা হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ এখন যে সংকট মোকাবেলা করছে তা অনেকটাই কমে যেতো যদি যথাসময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হতো।
কিন্তু একদিকে যেমন সেটা শুরুই হচ্ছে না, অন্যদিকে মিয়ানমার আদৌ তাদের ফেরত নিতে চায় কি-না – সেটা নিয়েও নতুন করে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।
ফলে কক্সবাজারের এই বিশাল এলাকায় রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বেগও বাড়ছে স্থানীয় মানুষ ও প্রশাসনের মধ্যে।
প্রতিবেদন : তাফসীর বাবু, বিবিসি বাংলা