স্মৃতিচারণ : বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ

গুম সমাচার ও আমিনুর রহমান
পাঠক কলাম পড়ছেন আজ ৬ মার্চ। কলামটি প্রকাশের পর পাঠকের সুবিধামতো সময়ে অন্য বা অনাগত দিনগুলোতেও পাঠক পড়তে থাকবেন। বিগত সাত দিনের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ নিয়ে কিঞ্চিত আলোচনা করি। মার্চ মাসের ২ তারিখ ছিল শনিবার। তারুণ্যকে সম্মান জানাতে, তারুণ্যকে মূল্যায়ন করার অংশ হিসেবে কল্যাণ পার্টির সদস্যরা একজন তরুণ ব্যক্তিকেই মহাসচিব নির্বাচিত করেছিলেন ২০১৫ সালের কাউন্সিলে। ২০১৮ সালের মার্চ মাসের ২ তারিখ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির তরুণ মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান কারামুক্ত হয়েছিলেন। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে এক রাতে তিনি যখন নয়া পল্টনে পার্টির অফিসে কাজ সেরে মহাখালীতে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান কার্যালয়ের দিকে আসছিলেন, তখন পথিমধ্যেই তাকে হাইজ্যাক তথা গুম করা হয়েছিল। ১০০ দিনের বেশি তিনি গুম ছিলেন। আমরা প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে, রাজনৈতিকভাবে ও সামাজিকভাবে একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলাম তাকে উদ্ধার করার জন্য; তিনি যেন প্রাণে বেঁচে যান। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় গুলশানের রাজপথে কে বা কারা তাকে ছেড়ে দিলো এবং পরক্ষণেই মিনিটের মধ্যে ডিবি প্রকাশ্যভাবেই তাকে গ্রেফতার করল।

অতঃপর পুলিশের হেফাজতে নেয়া হলো, আদালতে নেয়া হলো, রিমান্ডে নেয়া হলো। প্রায় দুই মাস পর মহামান্য হাইকোর্ট থেকে জামিন মঞ্জুর হওয়ায় তিনি মুক্ত হয়েছিলেন। এখনো জামিনে আছেন। মুক্ত হওয়ার তারিখ হলো ২ মার্চ ২০১৮ সাল। কল্যাণ পার্টির মহাসচিবের কারামুক্ত হওয়ার খবরটি জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ খবর নয়। কিন্তু প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ বিধায় যৎকিঞ্চিত আলোচনা করলাম। এখনো অনেকে গুম অবস্থায় আছেন। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর খবর কেউ জানেন না। নিশ্চিত সংবাদের অভাবে, সেনাবাহিনীর কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসারও গুম অবস্থায় আছেন বলে অবসরপ্রাপ্তদের মহল সন্দেহ করছে। মাঝে মধ্যেই নিখোঁজ হওয়া, গুম হওয়া পরিবারের সদস্যরা কোনো জায়গায় একত্র হচ্ছেন কারো না কারো রাজনৈতিক বা সামাজিক উদ্যোগে। আমি এসব পরিবারের মানসিক অবস্থা কিঞ্চিত কল্পনা করতে পারি। গুম হওয়া, নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান আহ্বান করছি। কল্যাণ পার্টি সীমিত অবকাশে আমিনুর রহমানের কারামুক্তি দিবস পালন করেছে। আমাদের সীমিত অবকাশটি ২০১৮ সালে যা-ই থাকুক না কেন, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে একটু চকচকে-তকতকে হয়েছে। কারণ, এবার ফেব্রুয়ারি আমরা সাংগঠনিক মাস হিসেবে পালন করেছি। বহু আগ্রহী ব্যক্তি অনলাইনেই দলটির সদস্য হয়ে গিয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন, তাদেরকে স্বাগত। পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন কামনা করেন যারা, এই দর্শনে যারা বিশ্বাস করেন, তারা আমাদের সহকর্মী হিসেবে দলে প্রবেশ করছেন।

বেঙ্গল রেজিমেন্ট সমাচার
বেঙ্গল রেজিমেন্ট বলে দু’টি শব্দের সাথে সাধারণভাবে পাঠক সুপরিচিত। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ঢাকা সেনানিবাসের একেবারে উত্তর অংশে, কুর্মিটোলায় আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বা জন্ম নিয়েছিল প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ক্যাপ্টেন আবদুল গণি (পরবর্তীকালে মেজর আবদুল গণি) ও তার কয়েকজন বাঙালি সহকর্মীর আগ্রহ, উদ্যোগ ও পরিশ্রমের কারণেই প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে দ্রুত সংগঠিত করা সম্ভব হয়েছিল। মেজর গণিকে ‘বেঙ্গল রেজিমেন্টের জনক’ বললে অত্যুক্তি হবে না। ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৭ তারিখ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বা জন্ম নিয়েছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বা সেকেন্ড বেঙ্গল। ১৯৭০-এর সেপ্টেম্বরে কমিশন পেয়ে এই দ্বিতীয় বেঙ্গলেই যোগদান করেছিলাম এবং তাদের সাথেই মুক্তিযুদ্ধ করেছি। সুনির্দিষ্টভাবে, প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে দক্ষতা ও সাহসিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছিল লাহোর-শিয়ালকোট সীমান্তে। তিনজন ‘সিতারায়ে জুরাত’ খেতাব পেয়েছিলেন এবং সাতজন তমঘা জুরাত খেতাব পেয়েছিলেন। ১৯৭১-এর বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে, বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুইজন বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব; ৩৪ জন বীর উত্তম খেতাব, ৭৮ জন বীর বিক্রম খেতাব এবং ১৩৮ জন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেকের সাথে আমিও বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছি। তবে আমার ‘জন্ম’ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে হলেও দ্বিতীয় বেঙ্গলের অধিনায়ক হওয়ার সুযোগ পাইনি।

বেঙ্গল রেজিমেন্ট : সপ্তম ব্যাটালিয়নকে অভিনন্দন
৬ মার্চ ছিল বেঙ্গল রেজিমেন্টের সপ্তম ব্যাটালিয়ন বা সাদামাটা পরিভাষায় সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বা আরো সাদামাটা ভাষায় ‘৭ ইস্ট বেঙ্গল’ নামক ব্যাটালিয়নের প্রতিষ্ঠা দিবস বা জন্ম দিবস। সামরিক পরিভাষায় এটাকে বলা হয় ‘রেইজিং ডে’। ৫০ বছর শেষ করে এই ৭ ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নটি ৫১ বছর বয়সে পা দিলো ২০১৯ সালের ৬ মার্চ; গোল্ডেন জুবিলি বা স্বর্ণজয়ন্তী। ব্যাটালিয়নটি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার নানিয়ারচর উপজেলায় মোতায়েন আছে তথা দায়িত্ব পালন করছে। এই ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠার পরপরই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি মহানগরীর অদূরে অবস্থিত মালির ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তরিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ও পরবর্তীকালে ব্যাটালিয়নটি আটক ছিল পাকিস্তানে। পাকিস্তানে থাকাকালে এই ব্যাটালিয়নের দুইজন অধিনায়কের মধ্যে একজন ছিলেন তৎকালীন লেফটেন্যান্ট কর্নেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। মুক্তিযুদ্ধের পরে বাঙালি সৈনিকেরা যখন প্রত্যাবাসন বা রি-প্যাট্রিয়েট হলেন, তখন অন্য অনেক ইউনিটের মতো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেও সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পুনর্জন্ম লাভ করেছিল বা পুনর্গঠিত হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে ওই সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম এবং ১৯৭৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত (২ বছর ৯ মাস) সে দায়িত্বে ছিলাম। ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে ১৯৮০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত (১৮ মাস) এই সপ্তম ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার বা অধিনায়ক ছিলাম। একনাগাড়ে চার বছর তিন মাস ব্যাটালিয়নে চাকরি করেছিলাম। ওই ব্যাটালিয়নের সাথে স্মৃতিটি আবেগজড়িত। দুর্গম পার্বত্য এলাকায় স্পর্শকাতর কর্তব্য পালনে ব্যস্ত থাকায় জাঁকজমকের সাথে ব্যাটালিয়নটি গোল্ডেন জুবিলি পালন করতে পারছে না। তাদের প্রতি আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার কারণে আমি বা আমার মতো আরো দু-চারজনও তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যে অন্যতম নেতিবাচক দিক হলো নির্মোহ ও নিরপেক্ষ থাকতে অপারগতা। যেমন, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ও রণাঙ্গনে সাহসিকতার জন্য বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দিবস অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বরের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে দাওয়াত দেয়ার পরও দাওয়াত স্থলের গেট থেকে ফেরত দিতে একবিন্দু কুণ্ঠাবোধ করেনি বর্তমান রাজনৈতিক সরকার বা তাদের হুকুমে গেট প্রহরায় নিযুক্ত অনুগত কর্মকর্তারা। ওই ঘটনার অনুমিত কারণ : মুক্তিযোদ্ধা ইবরাহিম, বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনে, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাসীন দলের বিরোধী পক্ষে অবস্থান করে। ক্ষমতাসীন পক্ষের মতে, মুক্তিযোদ্ধা ইবরাহিম ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ’। মহান আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা ব্যক্তি ইবরাহিম অভিসম্পাত দিতে অভ্যস্ত নয়; প্রার্থনা করতে অভ্যস্ত। প্রার্থনা করি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারগুলোকে মহান আল্লাহ তায়ালা যেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি নির্মোহ ও নিরপেক্ষ হতে হেদায়েত দান করেন। এখন অন্য প্রসঙ্গে যাই; সেটিও মুক্তিযুদ্ধেরই আরেকটি আঙ্গিক।

ঘটনাবহুল মার্চের স্মৃতিচারণ
আজ বুধবার, ৬ মার্চ। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যপূর্ণ। আগামীকাল বৃহস্পতিবার ৭ মার্চ। ৪৮ বছর আগের তথা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দিন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ। আমি তখন ঢাকা মহানগরের ৩০ কিলোমিটার উত্তরে, বর্তমান গাজীপুর জেলার সদরে তথা ১৯৭১-এর ঢাকা জেলার জয়দেবপুর থানার সদরে অবস্থিত, ঐতিহাসিক ভাওয়াল রাজবাড়িতে অবস্থানরত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি করি। বেঙ্গল রেজিমেন্ট সম্বন্ধে একটু সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এই কলামেরই ওপরের অংশে আছে। ১৯৭১-এর ঘটনাবহুল মার্চ মাসের ২, ৩, ৭ এবং ১৯ তারিখের ঘটনা আমার জীবনকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে। এই প্রেক্ষাপটেই বলছি, মার্চ মাস এলেই মনের দৃষ্টি ভিন্নদিকে মোড় নেয়। আজকের বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সাথে পরিচিত শুধু বইপুস্তক, পত্রিকার কলাম, টেলিভিশন টকশো এবং রাজনৈতিক নেতাদের অনিরপেক্ষ ভাষণের মাধ্যমে। ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামক শব্দটি যতবার না শোনে, তার থেকে বেশি শোনে ‘মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি’ নামক শব্দমালা। এখন টেলিভিশনের যে রকম ছড়াছড়ি, ১৫-২০ বছর আগেও তা ছিল না; ১৯৯৯ সালের আগে বিটিভিই ছিল একমাত্র সম্বল। এখন নিজের মনের মতো করে, মনের মাধুরী মিশিয়ে, যেমন ইচ্ছা তেমন গল্প কিংবা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেমন ইচ্ছা তেমন ব্যাখ্যা সমগ্র জাতির সামনে উপস্থাপন করা সহজতর। যা হোক, এ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত তথা পেশাগত জীবনের একটি স্মৃতি যা মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত, পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলোতে বর্ণনা করছি।

বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি
১৯৯৩ সালের মে মাসের ১০ তারিখ থেকে ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখ পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলার ভাটিয়ারিতে অবস্থিত বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (বিএমএ) নামক প্রখ্যাত সামরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান তথা কমান্ড্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। বিএমএ-তে সেমিস্টার পদ্ধতি অনুসরণ হয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই। তবে ‘সেমিস্টার’ কথাটি ব্যবহার করা হয় না; ব্যবহৃত শব্দটি হচ্ছে ‘টার্ম’। ২১ থেকে ২৩ সপ্তাহ একেকটি টার্মের মেয়াদ। অতঃপর তিন সপ্তাহের বিরতি বা ছুটি। উদাহরণস্বরূপ, জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে যে টার্ম শুরু হলো, সেটি জুন মাসের মাঝামাঝি শেষ হবে। অতঃপর কম-বেশি তিন সপ্তাহের বিরতি; নতুন টার্ম শুরু হবে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বা দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে। মিলিটারি একাডেমিতে যারা প্রশিক্ষক, তাদের বেশির ভাগই মেজর এবং ক্যাপ্টেন র‌্যাংকের। কিছু আছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল র‌্যাংকের। আরো দু-চারজন আছেন কর্নেল র‌্যাংকের। এখন থেকে ছয় বছর আগেও একজন মাত্র থাকতেন ব্রিগেডিয়ার র‌্যাংকের এবং তিনি হতেন কমান্ড্যান্ট। সাম্প্রতিককালে তথা পাঁচ-সাত বছর আগে, সামরিক বাহিনীর কিছু দায়িত্বের পদমর্যাদাকে আপগ্রেড করা হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় অতীতে বিএমএ-এর কমান্ড্যান্ট হতেন একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এবং এখন বিএমএ-এর কমান্ড্যান্ট হন একজন মেজর জেনারেল। এই লক্ষণ ভালো এবং এটাকে স্বাগত জানাই। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি সেনাবাহিনীর সৈনিক ও অফিসারদের র‌্যাংকের নাম বা পরিচিতি আংশিকভাবে পরিবর্তন করেছিলেন; যেমন ব্রিগেডিয়ারের বদলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। যখন ভাটিয়ারিতে অবস্থিত বিএমএ-এর কমান্ড্যান্ট ছিলাম তখন আমার র‌্যাংক ছিল ব্রিগেডিয়ার। আমি ১০ মে ১৯৯৩ থেকে ১২ কিংবা ১৩ ডিসেম্বর ১৯৯৫ পর্যন্ত বিএমএ-এর কমান্ড্যান্ট ছিলাম।

বিসিএস অফিসারদের ট্রেনিং
বিএমএ-তে যখন কমান্ড্যান্টের দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন ২৮ বিএমএ লং কোর্স পাসিং আউটের জন্য অর্থাৎ কমিশন প্রাপ্তির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তিন-চার সপ্তাহ পরই ওই টার্ম শেষ এবং বিরতি বা টার্ম ব্রেক শুরু। জুলাই ১৯৯৩ সালে নতুন টার্ম শুরু হলো। ওই সময় রেওয়াজ ছিল, প্রত্যেক টার্মে চার সপ্তাহের জন্য, একদল বেসামরিক অফিসার, বিএমএ-তে আসতেন। উদ্দেশ্য, সামরিক বাহিনীর সাথে ফ্যামিলিয়ারাইজেশন বা ওরিয়েন্টেশন, তথা পরিচিত হওয়া। বেসামরিক অফিসারদের চাকরির মেয়াদ হতো নিম্নে তিন এবং ঊর্ধ্বে ছয় বছর। বেসামরিক অফিসারদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই ছিলেন বিসিএস অ্যাডমিন ক্যাডারের। ওই চার সপ্তাহের প্রশিক্ষণ মেয়াদকে ‘বিসিএস ওরিয়েন্টেশন ট্রেনিং’ বলা হতো। কিছু প্রশিক্ষণ ক্লাসরুমের ভেতরে একাডেমিক পরিবেশে, কিছু প্রশিক্ষণ ক্লাসের বাইরে মাঠে-ময়দানে এবং সম্ভব হলে রাঙ্গামাটি বা খাগড়াছড়িতে একটি প্রশিক্ষণ কাম বিনোদন সফর। জুলাই ১৯৯৩-তে টার্ম শুরু হলো; কয়েক সপ্তাহ পর বিসিএস ব্যাচ এসে গেল। তাদের একাডেমিক সিলেবাসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ৪০ মিনিটের তিনটি পিরিয়ড ছিল। ক্লাসটি নিতেন ক্যাপ্টেন বা মেজর র‌্যাংকের প্রশিক্ষক, যাদেরকে আমরা প্লাটুন কমান্ডার বা টার্ম কমান্ডার বলতাম। প্রশিক্ষকেরা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের জ্ঞান অর্জন করতেন লেখাপড়ার মাধ্যমে এবং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সরবরাহ করা পাঠ্যপুস্তক থেকে। এরূপ পাঠ্যপুস্তককে সেনাবাহিনীর পরিভাষায় ‘প্রেসি’ বলা হয়। মজার গল্পটা এখান থেকেই শুরু।

বিসিএস অফিসারদের প্রথম আবেদন
আমি ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, এইরূপ কোনো একটি সময়ের কথা বলছি। বিসিএস ব্যাচের ছাত্ররা তথা বেসামরিক অফিসাররা একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরল এবং একটি আবেদন জানাল। তাদের পর্যবেক্ষণ ও আবেদনটির সারমর্ম হলো- বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির কমান্ড্যান্ট যখন নিজেই রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধা, তখন আমাদের মতো তরুণ অফিসার প্রশিক্ষণার্থীদের অধিকার আছে, প্লাটুন কমান্ডারদের কাছ থেকে তাদের পুঁথিগত বিদ্যাভিত্তিক বর্ণনা না শুনে, কমান্ড্যান্টের কাছ থেকেই মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে শোনা। আমাদের আবেদন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত আমাদের পিরিয়ডগুলো কমান্ড্যান্ট মহোদয় নিজে নেবেন। প্রস্তাবটি যখন যথাযথ মাধ্যমে আমার কাছে এলো, এটাকে আনন্দচিত্তেই ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করলাম। যেহেতু আমি নিজে বিএমএ-এর প্রধান, সেহেতু পিরিয়ড সংখ্যা বাড়ানো-কমানো প্রসঙ্গে হুকুম দেয়া বা প্রস্তাব অনুমোদন করা সাদামাটা কাজ। যেদিন ক্লাসটি নেবো, সেদিন তিন পিরিয়ডের বদলে দু-এক পিরিয়ড বাড়ানোর মতো সুযোগ রেখে দিলাম; যেন সময়ের অভাবের অজুহাতে ছাত্ররা অসন্তুষ্টচিত্তে ফিরে না যান। যারা ওই সময় ক্লাসে ছিলেন, তাদের বয়স ৩০ বছরের ঊর্ধ্বে এবং ৩৭-এর নিচে ছিল।

পরীক্ষা ও আমার কাছে একটি আবেদন
বেসামরিক অফিসারদের সাথে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খোলামেলা ইন্টারঅ্যাকশন আমার পেশাগত জীবনে ওটিই ছিল প্রথম। দীর্ঘ সময় ক্লাস হলে ছাত্রদের বা শ্রোতাদের মনোযোগ ও দৃষ্টি অব্যাহতভাবে আকর্ষণ করে রাখা কঠিন কাজ। কিন্তু এ কাজটি সহজভাবে করার অভ্যাস আমার ছিল এবং এখনো আছে। পরিকল্পিতভাবে বিরতি দিতে হয়; অপরিকল্পিত সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন-উত্তর পর্ব রাখতে হয়, সুনির্দিষ্ট পাঠ বা বক্তৃতার বাইরে কিছু মজাদার বা চমকপ্রদ রেফারেন্স আনতেই হয়। ছাত্রদের পক্ষ থেকে মনের ভেতর লুক্কায়িত এবং সুযোগমতো প্রকাশিত অন্যতম প্রশ্ন ছিল, বঙ্গবন্ধু এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নিয়ে। সম্মানিত পাঠক খেয়াল করবেন, ১৯৯৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধের কথা বলছি এবং সেই সময় বাংলাদেশে ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। প্রশ্নের ধরন, এর শব্দ চয়ন ইত্যাদির বিশ্লেষণে আমার বুঝতে কোনো কষ্ট হয়নি যে, ছাত্ররা কী জানতে চান এবং আমাকে কোন পরীক্ষায় ফেলছেন। ছাত্ররা মেধাবী, স্মার্ট ও পরিশীলিত। আমার জন্য পরীক্ষা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও বর্ণনা উপস্থাপন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এবং শহীদ জিয়াকে কোন মানদণ্ডে ও কোন আপেক্ষিকতায় উপস্থাপন করি। অবস্থা অনেকটা এ রকম দাঁড়াল যে, ছাত্ররা হয়ে গেলেন অঘোষিত পরীক্ষক, আর নিজে হয়ে গেলাম অঘোষিত পরীক্ষার্থী! তবে পরীক্ষায় পাস করেছিলাম। ক্লাসের শেষের দিকে বিসিএস অফিসারদের পক্ষ থেকে একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাবও ছিল। প্রস্তাবটি ছিল, আপনি ব্রিগেডিয়ার ইবরাহিম যেহেতু একজন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, সেহেতু আপনি কমান্ড্যান্ট হিসেবে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে, বিএমএ-এর সিলেবাসে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন করে যাবেন। উদ্দেশ্য, এখানে প্রশিক্ষণরত সামরিক বাহিনীর ক্যাডেটরা যেন মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে যত বেশি সম্ভব, ততটা জ্ঞান নিয়ে যেতে পারে। প্রয়োজন হলে তিন পিরিয়ডের জায়গায় বারো-চৌদ্দ পিরিয়ড বরাদ্দ করুন সিলেবাসে এবং প্রেসিগুলো বর্ধিত করুন।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির জন্য নিজের উদ্যোগ
বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিসহ সেনাবাহিনীর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রেওয়াজ মোতাবেক, নিয়মিতভাবেই শিক্ষা কার্যক্রম, সিলেবাস, পিরিয়ড বরাদ্দ, প্রশিক্ষক বরাদ্দ ইত্যাদি পর্যালোচনা করা হয়। বিএমএ-তে এ কাজটি প্রতি টার্মের শেষে তথা বছরে দুইবার অবশ্যই করা হয়। এইরূপ পর্যালোচনার এক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য পিরিয়ড যত বরাদ্দ করা আছে, সেটি বাড়ানো হবে কি হবে না, এই সিদ্ধান্তের প্রশ্ন আসে। আমি ভাবলাম এবং সহকর্মীদের বললাম একটা কথা। তা হলো- পিরিয়ড বাড়িয়ে দেয়া বা প্রেসির আকার বড় করা আমার জন্য কোনো সমস্যা নয় এবং তোমরাও এটা তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করে ফেলবে; এটি নিয়ে চিন্তিত নই। কিন্তু আমি চলে যাওয়ার পর, আবার যে সে পিরিয়ড কমানো হবে না বা প্রেসির সাইজ ছোট করা হবে না, তার নিশ্চয়তা কী? আলোচনার পর, সহকর্মীরা প্রস্তাব করলেন, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড্যান্ট হিসেবে আমি যেন এমন কিছু একটা করে যাই যেটা স্থায়ী হবে, নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ হবে এবং যেটা প্রশিক্ষণার্থী বা ক্যাডেটদের জন্য নীরব উৎসাহের উৎস হবে। পর্যালোচনা সভায় উপস্থিত সহকর্মীরা সবাই সম্মত হলেন এবং আমিও সম্মত হলাম। অতএব, ওই মর্মেই চিন্তাভাবনা করলাম এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলাম।

মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য ও স্বাধীনতা মানচিত্র
বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির এলাকার ভেতরে, অভ্যন্তরীণ প্রধান সড়কের পাশেই মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণ করলাম। বছরখানেক লেগেছিল কাজটি সম্পন্ন করতে। সেই স্মারক ভাস্কর্যের নাম দিয়েছিলাম ‘স্বাধীনতা মানচিত্র’। আংশিক নির্মাণ শেষ হয়েছিল ১৯৯৫-এর জুন মাসে এবং চূড়ান্ত করা হয়েছিল ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে। এই ভাস্কর্যের উদ্দেশ্য ছিল, প্রশিক্ষণার্থী ক্যাডেটরা যেন মুক্তিযুদ্ধের একজন নীরব শিক্ষক পায়। ওই ভাস্কর্য যেন কথা বলে। কী কথা বলে, সেটি স্থানাভাবে এখানে লিখতে না পারলেও তার রেফারেন্স দিচ্ছি। আমার লেখা বই ‘মিশ্র কথন’-এ ছয় নম্বর অধ্যায়; অধ্যায়ের নাম ‘মুক্তিযুদ্ধ : পিছনে ফিরে দেখা’। পৃষ্ঠা ২২৭ থেকে ২৩৩। ওই ভাস্কর্য এখনো স্থিত আছে, সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে, বয়সের সাথে সাথে ভাস্কর্যের ম্যাচিউরিটি এসেছে। ছুটির দিনগুলোতে বিএমএ-এর প্রবেশপথে নিরাপত্তাকর্মীদের অনুমতি সাপেক্ষে, সাধারণ নাগরিকেরা এটি দেখতে যান প্রায়ই। ক্যাডেটদের পিতামাতা বা আত্মীয়স্বজন যখন তাদেরকে দেখতে যান, তখন এই ভাস্কর্যের এলাকাটি একটি মনোমুগ্ধকর মিলনস্থানে পরিণত হয়। নিয়ন্ত্রিত এলাকা হওয়ায় যখন ইচ্ছা তখন যাওয়া যায় না, সাংবাদিকদের প্রবেশে প্রায়ই অসুবিধা হয়।

লেখক : মেজর জেনারেল (অব.); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

www.generalibrahim.com.bd

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top