পৃথিবীর যে ভূ-ভাগে বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসবাস, সে ভূ-ভাগে ভাত ও মাছ অনাদিকাল থেকে সহজলভ্য হওয়ায় এ দু’টি বাঙালির প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচিত। আর সে কারণেই বাঙালিকে বলা হয়ে থাকে মাছে-ভাতে বাঙালি। আজ থেকে অর্ধশতাব্দী পূর্ব পর্যন্ত ধনী-গরিব নির্বিভেদে সবার ভাগ্যে ভাতের সাথে মাছ জুটত। বাংলাদেশের সর্বত্র প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মিঠাপানির মাছের যে সহজলভ্যতা ছিল, সেটি বিভিন্ন কারণে অনেকটা হারিয়ে গেছে।
আমাদের বাংলাদেশ ছাড়া বাঙালি জনগোষ্ঠী ভারতের পশ্চিম বাংলা, আসাম ও ত্রিপুরায় বসবাস করে। আমাদের এ অঞ্চলে দুই ধরনের মাছ পাওয়া যায়, যথা- মিঠা ও লোনা পানির মাছ। পুকুর, খালবিল, নদীনালা, উন্মুক্ত জলাশয়, ধানক্ষেত প্রভৃতিতে কিছুকাল আগেও প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে মিঠাপানির মাছের উৎপাদন হতো এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যেত পুকুরের সাথে ধানক্ষেত বা বিলের সংযোগ থাকত। বর্ষা শুরুর আগে খালবিল বৃষ্টির পানিতে পরিপূর্ণ হলে দেখা যেত পুকুর থেকে মাছ বেরিয়ে উন্মুক্ত জলাশয়ে ডিম ছাড়ছে। আবার বর্ষা শেষ হওয়ার পর দেখা যেত উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ আবার পুকুরে ঢুকছে। উন্মুক্ত জলাশয় বলতে খালবিলসহ এখানে আউশ, আমন ও বোরো ধান চাষ উপযোগী ধানক্ষেতের অন্তর্ভুক্ত। উচ্চ ফলনশীল ধান আবাদে অধিক হারে কীটনাশক প্রয়োগের কারণে বর্ষায় ধানক্ষেতে মাছের বিচরণ ও বংশবিস্তার হুমকিতে পড়েছে। এর ফলে মিঠাপানির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত মাছের পরিমাণ ব্যাপক হারে কমেছে। তবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের কারণে পুকুরে কয়েক প্রজাতির মাছের চাষ ও উৎপাদন ব্যাপক বেড়েছে। এসব মাছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কৈ, শিং, মাগুর, তেলাপিয়া, নাইলোটিকা, পাঙ্গাশ, বিভিন্ন প্রজাতির কার্প, রুই, কাতল, মৃগেল প্রভৃতি। পুকুরে পাঙ্গাশ চাষের কারণ পূর্ববর্তী পাঙ্গাশ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে ছিল। তখন এ মাছটি অভিজাত ও ধনিক শ্রেণীর খাবারের তালিকায় সুস্বাদু ও উপাদেয় খাবার হিসেবে মাঝে মধ্যে স্থান পেত। কিন্তু আজ সে পাঙ্গাশ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পুকুরে চাষের কারণে সহজলভ্য এবং এমনকি প্রান্তিক নিম্নবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। বর্তমানে চাষের কৈ মাছও সহজলভ্য ও মূল্যসাশ্রয়ী। এখন নিম্নবিত্তের অনেকের পক্ষে সপ্তাহে প্রতিদিন না হলেও দু-চার দিন চাষের পাঙ্গাশ বা কৈ খাওয়া সম্ভব। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তাদের অনেকের চাষের পাঙ্গাশ ও কৈ মাছের প্রতি অনীহা।
পৃথিবীর উন্নত দেশের বিপরীতে এখন আমাদের দেশে সামুদ্রিক মাছের চেয়ে মিঠাপানির প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছের দাম তিন-চার গুণ বেশি। আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে আমাদের দেশের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল ছাড়া অবশিষ্টাংশ মানুষের কাছে সমুদ্র থেকে সংগৃহীত মাছ মূল্যসাশ্রয়ী হওয়া সত্ত্বেও আকর্ষণীয় আমিষ হিসেবে বিবেচিত হয়নি। তবে বর্তমানে মূল্য তুলনামূলক বিচারে বৃদ্ধি পেলেও আগের অনীহা অনেকটাই কেটে গেছে।
উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ব্যাপক হারে বিশেষত শিশুরা নাইলনের জাল দিয়ে পোনা আহরণে নিয়োজিত থাকায় দেখা যায় একটি গলদা চিংড়ি মাছের পোনা আহরণ করতে গিয়ে ৯৯টি সামুদ্রিক মাছসহ অন্যান্য জলজপ্রাণীর মৃত্যু ঘটানো হচ্ছে। এতে করে সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ধানের চাষের চেয়ে মাছের চাষ লাভজনক হওয়ায় দেশের কিছু অঞ্চলে বর্ষাকালে ধানী জমিতে ধানের পরিবর্তে মাছের চাষ হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দি থেকে চান্দিনা পর্যন্ত দুই ধারে বছরের ৮-৯ মাস সময়কাল এ দৃশ্যটি চোখে পড়ে। এসব জমিতে শীতকালে শুধু রবিশস্যের আবাদ হয় আর বছরের অবশিষ্টাংশ সময় মাছের চাষ হয়।
আগে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মিঠাপানির মাছের সরবরাহের বিপুল অংশ আসত খালবিল, নদীনালা, উন্মুক্ত জলাশয় ও উন্মুক্ত পুকুর থেকে। বর্তমানে পরিবেশগত বিপর্যয় ও বংশ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ না থাকায় জলে আবৃত ও মৎস্য উৎপাদন উপযোগী এক বিপুল অঞ্চল মৎস্য উৎপাদনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ বিপুল জলাভূমিকে দূষণমুক্ত করে মৎস্য উৎপাদনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হলে সরবরাহের অফুরন্ত জোগানের সৃষ্টি হবে। এর কিছু অংশ অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং অবশিষ্টাংশ রফতানির কাজে ব্যবহৃত হতে পারে।
বর্তমানে বাঙালি ব্যাপক জনগোষ্ঠী বিদেশে বসবাস করছে। তাদের কাছে সামুদ্রিক মাছের চেয়ে মিঠাপানির মাছের চাহিদা বেশি। বিদেশে সামুদ্রিক ও মিঠাপানির মাছ প্রক্রিয়াজাত করে পাঠাতে পারলে রফতানি আয় ২-৬ গুণ পর্যন্ত বাড়বে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যেকোনো মাছের ফিশ ফিলেট (ঋরংয ঋরষষবঃ) পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার। আমরা প্রতি বছর বিদেশে যে পরিমাণ মিঠা ও লোনা পানির মাছ রফতানি করছি, এর এক-দশমাংশও যদি ফিশ ফিলেট করে রফতানি করা যেত তাহলে শুধু প্রক্রিয়াজাতকরণের কারণেই অনেক উচ্চমূল্যে রফতানি করা যেত। একইভাবে অন্যান্য মাছও প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে টিনজাত করে রফতানি করা গেলে মাছ খাত থেকে রফতানি আয় বহুগুণে বাড়বে।
আগে সাগর থেকে মাছ ধরা হতো হস্তচালিত নৌযান ব্যবহার করে। এসব নৌযান উপকূলের কাছাকাছি অবস্থান করে মাছ ধরত। বর্তমানে যন্ত্রচালিত নৌযান ও ট্রলারের আবির্ভাবে গভীর সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
সামুদ্রিক ও মিঠাপানির মাছ ধরায় নির্ধারিত আকারের মাছ শিকার নিষিদ্ধ করা হলে এবং প্রজননের সময় মাছ ধরায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে দু-এক বছরেই মাছের প্রাপ্যতা দু-এক গুণ বাড়বে। আর এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা গেলে এ দেশে কখনো মাছের দুষ্প্রাপ্যতা দেখা দেবে না।
আমাদের দেশে দুই ধরনের চিংড়ি পাওয়া যায়। লোনাপানিতে যে চিংড়ির চাষ করা হয় এবং সমুদ্র থেকে যে চিংড়ি মাছ আরহণ করা হয় তাকে বলা হয় গলদা চিংড়ি। আর মিঠাপানিতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ও চাষের মাধ্যমে যে চিংড়ি পাওয়া যায় তাকে বলা হয় বাগদা চিংড়ি। বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক হারে গলদা চিংড়ির চাষ হচ্ছে এবং এর প্রায় শতভাগই বিদেশে রফতানি হচ্ছে।
শুঁটকি বাঙালির একটি প্রিয় খাবার। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন, জাপান, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে শুঁটকি অত্যন্ত পছন্দের ও উপাদেয় খাবার হিসেবে বিবেচিত। আমাদের দেশে সাধারণত মাছ ধরা বেশি হলে এবং বাজারে চাহিদা ও মূল্য নিম্নমুখী হলে জেলেরা শুঁটকি উৎপাদনে উদ্যোগী হন। বর্তমানে আমাদের দেশে শুঁটকির চাহিদার তুলনায় উৎপাদন আশানুরূপ না হওয়ায় অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রফতানির জন্য কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ সহজলভ্য হচ্ছে না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে পার্শ্ববর্তী ভারত ও মিয়ানমার থেকে আমদানি করা হচ্ছে। তা ছাড়া, ভারত ও মিয়ানমার থেকে প্রচুর মিঠাপানির রুই ও কাতল আমদানি করা হচ্ছে। আমরা সঠিকভাবে উৎপাদন করতে পারলে মাছ ও শুঁটকি কোনোটিরই আমদানির প্রয়োজন পড়ত না।
কোনো এক সময় বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ নিম্নবিত্তের আমিষ খাবারের প্রধান জোগান দিত। আজ সে ছোট মাছ এক দিকে সহজলভ্য নয়; অপর দিকে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের এক বিরাট অংশের কাছে উপাদেয় খাবার হিসেবে বিশেষভাবে সমাদৃত। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে ছোট মাছের প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন শহর ও শহর সন্নিকটস্থ পুকুর ও জলাশয় নগরায়নের প্রভাবে যেভাবে ভরাট হয়ে যাচ্ছে তাতে অচিরেই হয়তো শহরতলির পুকুর ও জলাশয়ের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে, যা প্রকারান্তরে ছোট ও বড় মাছ উভয়ই সরবরাহে কিছুটা হলেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে।
মানুষের খাদ্যাভ্যাসের কারণে মানুষভেদে বিভিন্ন ধরনের মাছ বিভিন্ন মানুষের কাছে প্রিয় খাবার হিসেবে বিবেচিত। যেমন- কারো কাছে হয়তো পুঁটিমাছ খুব প্রিয়, আবার কারো কাছে টেংরা। কারো কাছে হয়তো গুলশা, কারো কাছে কাইক্কা। কারো কাছে হয়তো খলসে, বৈচা এমন অনেক। আবার এমনও অনেকে আছেন যারা ছোট মাছ একদম পছন্দ করেন না, তবে বড় মাছের প্রতি আসক্ত। বিভিন্ন ছোট মাছের দুষ্প্রাপ্যতা বিষয়ে সেদিন কথার ছলে এক ভদ্রলোক বললেন, এ দেশের আবাসন ব্যবসায়ের পথিকৃৎ তার মৃত্যুশয্যায় শেষ বাসনা হিসেবে খলসে-বৈচা মাছ দিয়ে ভাত খেতে চাইলে তার আত্মীয়স্বজন বহু চেষ্টা করেও মাছটি জোগাড় করে তাকে খাওয়ানোর আগেই তার জীবনাবসান ঘটে। আমাদের ছোট মাছের বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এসব প্রজাতির মাছ খুঁজে বের করে প্রাকৃতিক বা বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রজনন ঘটিয়ে বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করতে হবে।
এ কথা অনস্বীকার্য, সামুদ্রিক ও মিঠাপানির মাছের প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্রের ব্যাঘাত করা না হলে প্রাকৃতিকভাবেই উভয় শ্রেণীর মাছের উৎপাদন বাড়বে। পুকুরে মাছ চাষের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন করা হলে স্বল্পতম সময়ে সর্বোচ্চ উৎপাদনের মাধ্যমে সফলতা আশা করা যায়।
আমাদের অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক যে জলভূমি রয়েছে, এ জলভূমিতে পরিকল্পিতভাবে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মাছের প্রজনন ও বিচরণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, মাছের অফুরন্ত ভাণ্ডার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক চাহিদা মিটিয়ে কখনো নিঃশেষিত হবে না। সংশ্লিষ্ট সবাই সচেতনতা ও নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ প্রবাদটি সমহিমায় চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। এর মাধ্যমেই আমরা আমাদের মৎস্য উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে সম্ভাবনাকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারি।
লেখক : সাবেক জজ ও কলামিস্ট
E-mail: iktederahmed@yahoo.com