মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি সেফ জোন বা নিরাপত্তা অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে সেখানে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করার প্রস্তাবে চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট ‘আসিয়ান’ভুক্ত কিছু দেশ ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতরের সূত্রের বরাত দিয়ে একাধিক সংবাদমাধ্যমে এ খবর প্রকাশ পায়। খবরে বলা হয়, রাখাইনে অনুকূল পরিস্থিতি না থাকায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশ বিকল্প হিসেবে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার ওপরেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করছে। তৃতীয়পক্ষের উপস্থিতিতে উত্তর রাখাইনের একসময়ের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় বেসামরিক নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার এই প্রস্তাব এর আগে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করেছে।
প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন। আর পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অসামরিক নিরাপদ অঞ্চল সৃষ্টির প্রস্তাবটি জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে তুলে ধরেছেন।
বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর নজিরবিহীন নৃশংসতার মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার আগে রাখাইনে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোকে নিয়ে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। তবে এটি রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারের সরকারের তৈরি করা আইডিপি (অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি) ক্যাম্পের মতো হলে হবে না। নিরাপদ অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের চলাফেরাসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে মিয়ানমারকেই। আর তৃতীয়পক্ষকে থাকতে হবে ব্যবস্থাপনা বা পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে। এখানে ‘তৃতীয়পক্ষ’ বলতে জাতিসঙ্ঘ বা মিয়ানমারের কাছে গ্রহণযোগ্য এক বা একাধিক দেশের প্রতিনিধিদের বোঝানো হয়েছে।
জানা গেছে, অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় চীন সম্প্রতি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রস্তাবের ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। তারা প্রস্তাবটির খুঁটিনাটি জানতে চেয়েছে। এ ছাড়া আসিয়ান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি দেশও এই প্রস্তাবের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে।
মিয়ানমারের সাথে দ্বিপক্ষীয়ভাবে রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান করতে পারেনি বাংলাদেশ। সেজন্যে বাংলাদেশ এখন মিয়ানমারের ওপর প্রভাব রয়েছে এমন দেশগুলোর সাহায্য নিতে চায়। এটা সুবিদিত একটি বিষয় হলো, মিয়ানমারের ওপর অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে চীনের প্রভাব অনেক বেশি। জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতার কারণেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব পাস করানো যায়নি। ব্রিটেনসহ পশ্চিমা দেশগুলোর একাধিক প্রচেষ্টা এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। তাই রাখাইনে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় চীনের সম্পৃক্ততার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া মিয়ানমার আসিয়ানভুক্ত একটি দেশ। তাই আসিয়ানকেও এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে চাইছে সরকার।
গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে মিয়ানমার থেকে ‘আর কোনো শরণার্থী নিতে পারবে না’ বলে জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। রাখাইনে সামরিক বাহিনীর সহিংসতার মুখে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার ১৮ মাস পর নিরাপত্তা পরিষদকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব। এর আগে ‘আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে রাখাইনের বৌদ্ধ ও অন্য উপজাতিরা বান্দরবানে আশ্রয় নেয়া শুরু করলে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশ সীমান্ত সিল করে দেয়।
নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, মিয়ানমার থেকে আর কোনো মানুষকে আশ্রয় দেয়ার অবস্থানে নেই বাংলাদেশ। তিনি বলেন, মিয়ানমার সহায়ক পরিস্থিতি নিশ্চিত না করায় একজন রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশ থেকে ফেরত পাঠানো যায়নি। এ সময় তিনি মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও বাধা সৃষ্টির দায়ে অভিযুক্ত করেন।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল গত বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এ ব্যাপারে একমত পোষণ করে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে তাদের প্রস্তুতির কথাও জানিয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে প্রত্যাবাসনের জন্য দুই হাজার ২৬০ জন রোহিঙ্গার তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের প্রতিবাদের মুখে তালিকাভুক্ত একজনকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পারেনি বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাখাইনে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি না হলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরতে চাইবে না। এ ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোরও উদ্যোগী ভূমিকা দেখা যায় না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন তহবিল ইউএনডিপি এবং জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সাথে মিয়ানমারের চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এই চুক্তি অনুযায়ী, রাখাইনে সংস্থা দু’টির তেমন কোনো তৎপরতা নেই।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের সর্বশেষ অধিবেশনে মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধি ক্রিশ্চিন বারগেনার বলেছেন, রাখাইনে জাতিসঙ্ঘের প্রবেশাধিকার সীমিত। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর যে মাত্রার নির্যাতন হয়েছে এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ রয়েছে, তাতে প্রমাণিত হয় যে, রোহিঙ্গা নির্যাতন এ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাগুলোর একটি।
তবে নিরাপত্তা পরিষদের এ অধিবেশনেও মিয়ানমার নিয়ে অবস্থান পরিবর্তন করেনি চীন ও রাশিয়া। জাতিসঙ্ঘে চীনের সহকারী রাষ্ট্রদূত উ হাই তাও বলেন, এই সমস্যাটি শুধু বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের। তাই তাদেরই এই সঙ্কটের সমাধান করতে হবে। রুশ দূত দিমিত্রি পলিয়ানস্কি চীনের বক্তব্য সমর্থন করেন।
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর রোহিঙ্গা সমস্যা বড় ধরনের বোঝার মতো চেপে আছে। মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেয়া হলেও বছরের পর বছর এই বোঝা বয়ে নেয়া বাংলাদেশের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শুধু অর্থনৈতিক বোঝাই নয়, রোহিঙ্গাদের যেখানে আশ্রয় দেয়া হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশীরা হয়ে পড়েছে সংখ্যালঘু এবং সে কারণে কোণঠাসা। নানা ধরনের সামাজিক সঙ্কটও ঘনীভূত হয়ে উঠছে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে ঘিরে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। এলাকার পরিবেশগত সমস্যা তীব্র হতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি গুরুতর।
তবে চীন যদি সত্যিই বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবে ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসে তাহলে সেটা হবে রোহিঙ্গা সঙ্কটের আপাত সমাধানের পক্ষে একধাপ অগ্রগতি। কারণ মিয়ানমারে চীনের রয়েছে বিশাল অর্থনৈতিক স্বার্থ।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের কারও কারও মতে, মিয়ানমারের মাটির নিচে থাকা প্রাকৃতিক সম্পদই রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণ। রাশিয়ার একজন বিশ্লেষকের মতে, রোহিঙ্গা সঙ্কটের রয়েছে অন্ততপক্ষে ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্য। প্রথমত, এটি চীনবিরোধী একটি খেলা যা খেলছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের প্রভাবশালী দেশগুলো। কারণ, রাখাইনে চীনের বিশাল বিনিয়োগ আছে। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুসলিম উগ্রপন্থা ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে এমনটা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলসহ ভারতের মিজোরাম এবং মিয়ানমারের কিছু এলাকা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর একটি খ্রিষ্টীয় রাজ্য গড়ে তোলার ষড়যন্ত্রের কথা সচেতন মহলের অনেকেরই অজানা নয়। সেটিও রোহিঙ্গা সঙ্কট সৃষ্টির পেছনে সক্রিয় বলে মনে করেন অনেকে। রুশ বিশ্লেষকের মতে, রোহিঙ্গা সঙ্কটের পেছনে তৃতীয় যে কারণ বিদ্যমান সেটি হলো, আসিয়ানের মধ্যে অনৈক্য তৈরির প্রচেষ্টা এটি। অর্থাৎ মিয়ানমারের সাথে মুসলিমপ্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করা।
রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণ যা-ই হোক, রাখাইনে চীনের স্বার্থের বিষয়টি উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। চীন আন্তর্জাতিক ফোরামে বারবার মিয়ানমারের পক্ষে সমর্থন দিয়ে আসছে তার মূল কারণ এটাই।
মিয়ানমারের সাবেক সেনাশাসক থান শুয়ের ব্যক্তিগত মালিকানায় বিপুল সংখ্যক গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে। পাশাপাশি, আরাকানের উপকূলীয় অঞ্চলে হাউড্রোকার্বন রয়েছে বলে অনেকটাই নিশ্চিত। ২০০৪ সালে রাখাইনে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি সম্পদের সন্ধান পাওয়ার পর সেখানে চীনের দৃষ্টি পড়ে। ২০১৩ সাল নাগাদ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য পাইপলাইন নির্মাণের কাজ শেষ করেছে দেশটি। এ পাইপলাইন মিয়ানমারের বন্দর শহর কিয়াউকপিউকে চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংকে যুক্ত করেছে। তেলের এ পাইপলাইনটির মাধ্যমে বেইজিং মালাক্কা প্রণালী হয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলে তেল সরবরাহের সুযোগ পায়। আর গ্যাস পাইপলাইনটি ব্যবহার করা হয়, মিয়ানমারের উপকূলীয় ক্ষেত্র থেকে চীনে হাইড্রোকার্বন সরবরাহের জন্য।
আমরা জানি, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে কোনো বহিরাগত নয়। ব্রিটিশ শাসনামলেরও আগে থেকে তারা রাখাইনে বসবাস শুরু করে।
প্রবীণ শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত প্রফেসর এবনে গোলাম সামাদ তার এক নিবন্ধে জানান, ‘রোহিঙ্গারা ব্রিটিশ শাসনামলে আরাকানে যায়নি। গিয়েছে বহু আগেই। আর তারা গিয়েছে স্থলপথে, সমুদ্রপথে নয়। ব্রিটিশ শাসনামলেও চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে অনেক লোক গিয়েছে আরাকানে জীবিকার অন্বেষণে। ইংরেজ আমলে আরাকানি মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষিতের হার ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি। তারা আরাকানে বৌদ্ধদের তুলনায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন অধিক সংখ্যায়। মুসলিম আরাকানিরা ইংরেজ আমলে তাই সরকারি চাকরি পেয়েছেন বেশি। তারা তুলনামূলকভাবে বড় চাকরি করেছেন সরকারি সাধারণ দফতরে। এ ছাড়া তারা পুলিশ বিভাগে চাকরি করেছেন বেশি। বেশির ভাগ আরাকানি পুলিশ ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত। আরাকানের নদীতে যেসব স্টিমার চলত এবং আকিয়াব ও চট্টগ্রামের মধ্যে যেসব স্টিমার যাতায়াত করত, তার মাঝিমাল্লা ও সারেং ছিলেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুসলমান। ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও আরাকানি মুসলমানেরা ছিলেন এগিয়ে। এরা সবাই যে, শুধু ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রাম থেকে আরাকানে গিয়েছিলেন তা-ও নয়। কিন্তু এখন বার্মা সরকার বলতে চাচ্ছে, সেখানে সব মুসলমানই হলেন বহিরাগত। এর ফলে সৃষ্টি হতে পারছে রোহিঙ্গা-সমস্যা।’
চীন ও আসিয়ানের কোনো কোনো দেশের সহযোগিতায় নিরাপত্তা অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হলে উন্মূল হয়ে পড়া রোহিঙ্গাদের সমস্যার কতটা সমাধান হবে- তা বলার সময় হয়নি। তবে এটি হতে পারে সমাধানের লক্ষ্যে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। আমরা শুভ সূচনার অপেক্ষায় রইলাম।