যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য মাত্র দিন তিরিশের মতো সময় হাতে আছে। কিন্তু এখনো ব্রিটেন তাদের ব্রেক্সিট চুক্তি পার্লামেন্টে পাস করাতে পারেনি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ব্রেক্সিট নিয়ে পার্লামেন্টে গো-হারা হারার পর নতুন করে পরিকল্পনা করতে যাচ্ছেন বলে শোনা গেছে। কিন্তু নতুন সেই ব্রেক্সিট পরিকল্পনাটা কী এখনো তা জানা যায়নি। এতে করে দেশটির ভাগ্য ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে।
ব্রিটেন ইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য মার্চের ২৯ তারিখ নির্ধারণ করছে। চুক্তি হোক বা না হোক, এ দিনই ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করা হবে।
ইতোমধ্যে ব্রেক্সিট নিয়ে নতুন করে হাজারো প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি দুই বছর ধরে তুমুল আলোচনা হওয়ার পর এখন নতুন করে বেক্সিট বাতিলের জন্য গণভোটের দাবি তোলা হচ্ছে। আরেকটি ব্রেক্সিট গণভোটের দাবিতে র্যালি-সমাবেশ করবে ব্রিটিশ নাগরিকেরা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের খসড়া ব্রেক্সিট চুক্তির বিরোধীরা আরেকটি গণভোট চান। গণভোটের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতেই নতুন করে র্যালি-সমাবেশের পরিকল্পনা করছে তারা। আগামী ২৩ মার্চ শনিবার লন্ডনে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে দ্য গার্ডিয়ান।
এমন সব চাপের মধ্যেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ইইউর সাথে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়ে আনুষ্ঠানিক চুক্তি সম্পন্ন করতে যাচ্ছেন। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে পুনরায় ইইউর সাথে খসড়া চুক্তি নিয়ে আলোচনার সুযোগ খুঁজছেন। তবে, ইইউ কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়েছে খসড়া চুক্তি নিয়ে পুনরায় আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।
থেরেসা মে পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট চুক্তি নিয়ে ব্যাপক পরাজয়ের সম্মুখীন হন। ব্রিটিশ এমপিরা এ চুক্তির বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। এমন অচলাবস্থায় যদি কোনো কারণে চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট সম্পন্ন হয়, তবে তা ব্রিটেনের জন্য মহাবিপর্যয় নিয়ে আসবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। এরই মধ্যে আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি থেরেসা মে ইইউর সাথে তার আলোচনার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তার বক্তব্য তুলে ধরবেন। এ দিন মে’র নতুন পরিকল্পনার ওপর এমপিরা পুনরায় ভোট দেবেন।
২৯ মার্চকে সামনে রেখে ব্রেক্সিট চুক্তির বিতর্কিত আয়ারল্যান্ড ব্যাকস্টপের অংশটিতে পরিবর্তনের চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। ব্রেক্সিটবিষয়ক চুক্তির আইনি বাধ্যবাধকতার পরিবর্তনে ইউরোপীয় নেতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে ফের ইইউ নেতাদের সাথে বসবেন থেরেসা মে। চুক্তি নিয়ে নতুন আলোচনা শুরুর আগে তিনি বলেছেন, তার দেশ আয়ারল্যান্ড সীমান্তের ‘ব্যাকস্টপের ফাঁদে’ আটকে থাকবে না।
বিচ্ছেদের পর ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মধ্যে যে চুক্তিই হোক না কেন, তাতে যেন আয়ারল্যান্ড সীমান্তে চেকিংয়ের বিষয়টি এড়ানো যায়, তা অর্জনই থেরেসার লক্ষ্য। ২৯ মার্চ ব্রেক্সিট কার্যকরের আগে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে পার্লামেন্ট সদস্যদের সম্মতি দরকার এ কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রীর। চুক্তি নিয়ে দুইপক্ষ কোনো সমঝোতায় না পৌঁছাতে পারলে ২৯ মার্চ কোনো চুক্তি ছাড়াই যুক্তরাজ্যকে ২৮ দেশের জোটটি ছেড়ে যেতে হবে।
ব্যাকস্টপ কী
ব্রেক্সিটের পর ইইউর সাথে একমাত্র সীমান্ত যুক্তরাজ্যের অংশ উত্তর আয়ারল্যান্ড ও ইইউ সদস্য রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ড। স্বাভাবিকভাবেই এই আইরিশ বর্ডারে সম্পর্কচ্ছেদের পর সীমান্ত ব্যবস্থা কেমন হবে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বর্ডার দিয়ে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থা কেমন হবে তাকেই ‘ব্যাকস্টপ’ বলা হচ্ছে।
উভয়েই বিচ্ছেদের পর সীমান্ত ব্যবস্থায় কড়াকড়ি চাইছে না। আয়ারল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড ‘গুড ফ্রাইডে চুক্তি’ অনুযায়ী চলতে চাইছে। দীর্ঘ ৩০ বছরের সঙ্ঘাতের অবসান ঘটিয়ে উত্তর আয়ারল্যান্ডে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ১৯৯৮ সালের এপ্রিলে বেলফাস্ট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এ চুক্তির অধীনেই উত্তর আয়ারল্যান্ডের বর্তমান সরকারব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। উত্তর আয়ারল্যান্ড ও স্বাধীন রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ডের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে তা এ চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে। রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ডের সাথে যুক্তরাজ্যের সম্পর্কও এ চুক্তি দ্বারা নির্ধারিত।
‘গুড ফ্রাইডে চুক্তি’ অনুযায়ী যুক্তরাজ্যের অংশ নর্দান আয়ারল্যান্ড এবং স্বাধীন আয়ারল্যান্ডের মধ্যকার সীমান্ত উন্মুক্ত থাকবে। এই চুক্তিতে আয়ারল্যান্ডের উভয় অংশের মধ্যকার লোকজন ও পণ্যের অবাধ যাতায়াতের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
ব্রেক্সিটের ‘ব্যাকস্টপ’ চুক্তি অনুযায়ী বলা হচ্ছে, নর্দান আয়ারল্যান্ড ইইউ আইনের অধীনে থাকবে। সীমান্তে বাধা সৃষ্টি না করে নর্দান আয়ারল্যান্ডে বাণিজ্যিক শুল্ক ও যাচাই-বাছাইয়ের কাজগুলো করা হবে।
এখন এই ধারাটি পরিবর্তনের দাবি তুলেছে যুক্তরাজ্য। কিন্তু ইইউ সেই পরিবর্তনে নারাজ। শেষ সময়ে এসে দুই পক্ষের দুই মেরুতে অবস্থানের কারণে চুক্তি ছাড়াই বিচ্ছেদ এবং এর সম্ভাব্য ক্ষতির বিষয়গুলো বারবার সামনে চলে আসছে। আয়ারল্যান্ড সীমান্ত নিয়ে চুক্তিতে উল্লিখিত ‘বেকস্টপ’ বিষয়ক ধারাটির গ্রহণযোগ্য পরিবর্তন করা হলে চুক্তিটি অনুমোদন করবে বলে জানিয়েছেন ব্রিটিশ এমপিরা। কিন্তু ইইউ নেতারা বলেছেন, সম্পাদিত চুক্তি পরিবর্তনের সুযোগ নেই।
১৯৭৩ সালে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হয়েছিল। ২০১৬ সালের জুন মাসে ঐতিহাসিক একটি গণভোটে সে দেশের মানুষজন এই অঞ্চলে থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এরপর থেকেই ব্রিটেনের রাজনীতিবিদরা বিতর্ক করে চলেছেন ব্রেক্সিট কিভাবে হবে। এ সমস্যা সমাধানে থেরেসা মে নতুন কী পদক্ষেপ নেনÑ সেটাই এখন দেখার বিষয়।