পরমাণু চুক্তি নিয়ে মতভেদের জের ধরে ইরানের ওপর আবার অবরোধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে বেশ নাজুক অবস্থায় পড়ে গেছে ইরান। বিশেষ করে প্রধান পণ্য তেল বিক্রি করা নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েছে দেশটি। আর এই সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে কয়েকটি দেশ।
গত ৫ নভেম্বর ইরান থেকে তেল কেনা প্রশ্নে অন্য সাতটি দেশের সাথে ভারতকেও ছাড় দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ভারত দেশটি থেকে মাসে ১.২৫ মিলিয়ন টন (প্রায় দিনে তিন লাখ ব্যারেলের সমপরিমাণ) সুযোগ পায়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ভারত আমদানি করে দিনে তিন লাখ দুই হাজার ব্যারেল তেল। অর্থাৎ আগের চেয়ে আমদানি হ্রাস করা হয় ৪১ শতাংশ। এতে মার্কিন অবরোধের সাফল্য দৃশ্যমান হলেও কার্যত ইরানের সাথে জ্বালানি সম্পর্ক জোরদার করছে ভারত। নয়াদিল্লি দক্ষতার সাথে অবরোধকে ব্যবহার করে তেহরানের কাছ থেকে অনুকূল শর্ত আদায় করে নিচ্ছে, ভারতের অর্থনীতিকে আরো গভীরভাবে টেনে আনছে, ভারতের জ্বালানি বাজার দেশটির বিশাল প্রাকৃতিক গ্যাসসম্পদের জন্য খুলে দেয়া হচ্ছে।
গত ডিসেম্বরে বিনামূল্যে জাহাজে পরিবহন, ৬০ দিন সম্প্রসারিত ঋণ ও পুরোপুরি রুপিতে তেল কেনা শুরু করে ভারত। জটিল বিনিময় ব্যবস্থায় ইরান তার পেট্রো-রুপিকে ব্যবহার করতে পারছে ভারত থেকে খাদ্য, ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী কেনার জন্য। ইরান রুপিভিত্তিক রাজস্বকে ভারতীয় অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে সরাসরি বিনিয়োগ করতে এবং ভারত সরকারের ঋণ সিকিউরিটি কেনায়ও ব্যবহার করতে পারে। ইরানি তেল আমদানির জন্য ভারত এই প্রথমবার পুরোপুরি রুপিভিত্তিক ব্যবস্থা ব্যবহার করছে। আগেকার অবরোধের সময় লেনদেনের ৬৫ শতাংশ ইউরো ব্যবহার করেছিল ভারত। ১০০ শতাংশ রুপি পদ্ধতির ফলে নয়াদিল্লি তার মুদ্রা দুর্বল হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারছে, আবার ইরানের ভারতীয় পণ্য কেনায় তেহরানের সাথে দিল্লির বাণিজ্য ভারসাম্যজনিত সমস্যার সমাধানও করে ফেলছে।
ন্যাশনাল ইরানিয়ান ওয়েল কোম্পানিকে (এনআইওসি) ভারতীয় ব্যাংকগুলো থেকে বিদেশী কোম্পানির পাওনা লাভের ওপর আরোপিত ৪০ শতাংশ কর শর্ত থেকে ছাড় দিয়েছে। এর ফলে ২০১৮ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে তেল কেনার জন্য ভারতীয় তেল শোধনাগারগুলোর আটকে রাখা ১.৫ বিলিয়ন ডলারও লাভ করেছে ইরান।
ইরান ও ভারতের মধ্যকার তেল সম্পর্ক পারস্পরিক সুবিধাজনক বিষয় নয়। ভারতের বাজার লাভের জন্য ইরান অনেক বেশি নির্ভরশীল। ২০১০ সাল থেকে ভারত তার মোট চাহিদার ৭-১০ শতাংশ তেল ইরান থেকে আমদানি করছিল, আর ইরানের মোট রফতানির ২০-২৩ শতাংশ যেত ভারতীয় বাজারে। ভারতের জ্বালানিনির্ভর ৭.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার জন্য সুবিধাটি কাজে লাগাচ্ছে।
আবার ছাড়ের যে মেয়াদ দেয়া হয়েছে, তাকে কাজে লাগিয়ে ইরানি তেল আমদানির বিকল্প কিছুর সন্ধানও করে ফেলার পর্যাপ্ত সুযোগ পাবে ভারত। আবার ইরানের প্রাকৃতিক গ্যাস শিল্পে নিজস্ব অবস্থান সৃষ্টি করতে পারে ভারত। ইরানি গ্যাসক্ষেত্র বিকাশ ও ইরানি গ্যাসের ভোক্তা উভয় হিসেবে তারা তা করতে পারে।
ভারতের জাতীয় ও গ্যাস কোম্পানি ওএনজিসি বিদেশ লি. (ওভিএল) ২০০৮ সালে ইরানের ফারজাদ-বি ব্লকে প্রাকৃতিক গ্যাস আবিষ্কার করে। সেখানে ৭৫৯ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আন্তর্জাতিক অবরোধের শেষ রাউন্ডে চাপের ফলে ওভিএল ও এর দুই ভারতীয় অংশীদার আট বিলিয়ন উন্নয়ন প্রকল্প খোয়ায়। নয়াদিল্লি এখন আবারো ফারজাদ-বি প্রকল্পের দিকে নজর দিয়েছে।
ইরানের সাথে ভারতের জ্বালানি সম্পর্কের গুরুত্ব আরেকটি কারণেও তাৎপর্যপূর্ণ, আর তা হলো- এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি প্রবাহ বেইজিংয়ের অনুকূলে নিয়ে নেয়ার চীনা প্রয়াস রুখে দিতে পারে। আগেরবারের অবরোধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে ভারত একইভাবে ইরান-পাকিস্তান-ভারত পাইপলাইন প্রকল্প থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। ওই প্রকল্প থেকে ভারতের বছরে ১১.৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার ইরানি প্রাকৃতিক গ্যাস প্রাপ্তির কথা ছিল। পাইপলাইনটি পাকিস্তান সীমান্ত পর্যন্ত এসে আটকে রয়েছে। ইরান-পাকিস্তান পাইপলাইনের প্রতি চীনের সম্মতির আগ পর্যন্ত এটি কার্যকর হতে পারছে না।
এর আগে ২০১৫ সালের ২ এপ্রিলের পর ইরান ও পি৫+১ জাতিগুলোর মধ্যে ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট সই হওয়ার দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে আইপি পাইপলাইনটির পাকিস্তান অংশের বড় ভাগ নির্মাণ করে ফেলে। পাকিস্তানের চীনা-নির্মিত গোয়াদর বন্দর থেকে নওয়াবশাহ পর্যন্ত পাইপলাইনটির নির্মাণকাজ তখনই শেষ হয়। এখান থেকেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্ক সংযুক্ত হতে পারে। অবরোধ প্রত্যাহারের পর গোয়াদর থেকে ইরানি সীমান্ত পর্যন্ত বাকি ৮০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পাকিস্তান।
আইপি পাইপলাইন চুক্তিটি ৪৬ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) অংশবিশেষ। এটি এই করিডোর দিয়ে জিনজিয়াঙের কাশগর নগরী পর্যন্ত যাওয়ার কথা রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশন দুই বিলিয়ন ডলার চীনা ঋণে ৮৫ শতাংশ নির্মাণকাজ সম্পন্ন করছে।
চীনের জন্য আইপি পাইপলাইনটি জ্বালানি ভূরাজনৈতিক মাস্টারস্ট্রোক। এটি সিল্ক রোড অর্থনৈতিক বেল্ট ও মেরিটাইম সিল্ক রোড ইনিশিয়েটিভ (উভয়টি মিলে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই নামে পরিচিত) এগিয়ে নেবে। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে পাকিস্তান হয়ে চীনের বিশাল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ পর্যন্ত ইরানি গ্যাস পৌঁছাতে পারবে। ফলে উত্তেজনাপ্রবণ প্রদেশটিতে উন্নয়ন ও একীভূতকরণ হতে পারে।
নয়াদিল্লি বিআরআইকে মোকাবেলা করতে চাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রানজিট করিডোরের হ্ন(আইএনএসটিসি) দিয়ে। এই প্রকল্পের মধ্যমণি হচ্ছে ইরানের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর চাহাবার। গোয়াদর থেকে ৭২ কিলোমিটার এই বন্দরে আধুনিক শিপিং স্ট্যান্ডার্ড ব্যবস্থা থাকবে। মার্কিন চাপের কারণে ভারত আরেকটি প্রকল্প স্থগিত করেছে। সেটি হলো ইরান হয়ে আফগানিস্তান পর্যন্ত একটি সড়ক ও রেললাইন নির্মাণ। এটি ইউরোপিয়ান-ইন্ডিয়ান ওশ্যান বাণিজ্যিক করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এর মাধ্যমে সময় ৪০ শতাংশ ও ব্যয় ৩০ শতাংশ কমবে বলে ধারণা করা হয়েছিল।
চাহাবার বন্দর দিয়ে ভারতের গ্যাস আমদানির সুযোগও ছিল। প্রস্তাবিত ইরান-ইন্ডিয়া পাইপলাইন দিয়ে বছরে ১১.৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস আমদানির পরিকল্পনা ছিল ভারতের।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি ইরানের তাসনিম এজেন্সি জানায়, ইরানের পেট্রোলিয়ামমন্ত্রী বিজাম জাঙ্গানেহ ঘোষণা করেছেন, রাশিয়ার জ্বালানিমন্ত্রী ও জ্বালানি জায়ান্ট গ্যাজপ্রম ইকটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছে পাইপলাইনটি নির্মাণ করার জন্য।
ভারত ও রাশিয়া তাদের জ্বালানি সম্পর্ক ইতোমধ্যেই ঘনিষ্ঠ করেছে। উভয় দেশই পারস্পরিক দেশে জ্বালানি খাতে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। সাগরের তলদেশ দিয়ে ইরানি গ্যাস ভারতে রফতানি শুরু হলে ইরানি-ভারতীয় কৌশলগত সম্পর্ক নতুন মাত্রা লাভ করবে। বদলে যেতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক সমীকরণই।