কাশ্মিরের ‘ইনতিফাদা’

কাশ্মিরে নৃশংসতা চলছে বিরামহীনভাবে। পাঁচ লাখ ভারতীয় সেনা এখনো কাশ্মিরে মোতায়েন রয়েছে। প্রকারান্তরে সেনারা কাশ্মির দখল করে রেখেছে। শত্রুসৈন্যদের দ্বারা ঘেরাও করে রাখা এটা হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় বন্দিশিবির বা নির্যাতন কেন্দ্র। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে বা অঞ্চলের প্রতি বেসামরিক লোকের বিপরীতে এত বিপুলসংখ্যক সেনা কোথাও মোতায়েন করা হয়নি। কাশ্মিরি এবং ফিলিস্তিনিরা বিশ্বের অন্য যেকোনো শত্রু বা প্রতিপক্ষ দখলদার বাহিনীর চেয়ে অত্যধিক নির্যাতিত ও অমানবিকভাবে জীবনযাপন করছেন। সম্প্রতি পুলওয়ামা আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলার মধ্য দিয়ে কাশ্মিরি ইনতিফাদার সংক্ষিপ্ত রূপ ও ভয়াবহতা প্রকাশ পেয়েছে। ভারতের নিয়ন্ত্রণহীন যুদ্ধংদেহী মনোভাব, ঔদ্ধত্য এবং সাহসের বাহাদুরির কারণে যেকোনো সময় একটি বড় ধরনের যুদ্ধ সংঘটিত হতে পারে।

বেশির ভাগ মানুষ যেটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে সেটা হলো- পুলওয়ামা হামলার মাধ্যমে কাশ্মিরের কৌশলগত পরিবেশ এবং কাশ্মিরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গেছে। কাশ্মিরের যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতের ব্যাপারে উভয় পক্ষের মধ্যে যে কৃত্রিম বা বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্য ও ধারণা প্রচলিত ছিল, সে ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে বিস্তৃতি ঘটেছে এবং সহিংসতার মাত্রা আকাশচুম্বী পর্যায়ে তথা আকাশে রকেট নিক্ষেপের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। এটা আর বেশি দিন ডেভিড ভার্সেস গোলিয়াথ স্টোরির পর্যায়ে থাকবে না। আধা-স্বয়ংক্রিয় ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের বিরুদ্ধে ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা এবং পেলেট গান বা ছররা গুলিবর্ষণের অভিশাপের মধ্যেই অবস্থা সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে না।

প্রাণঘাতী দখলদার ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কাশ্মিরিদের ইনতিফাদায় একটি নতুন উপাদান চালু করা হয়েছে। কাশ্মিরের যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মঘাতী বোমা হামলা সংযোজনের মাধ্যমে কাশ্মির উপত্যকায় সহিংসতার মাত্রা আরো প্রাণঘাতী ও মারাত্মক পরিণতির দিকে এগিয়ে গেল। এই সময়ের কাশ্মিরের অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা আহমদ আদিলদার- (যিনি একজন স্থানীয় তরুণ) পুলওয়ামায় আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালান বলে জানা গেছে। দখলদার ভারতীয় বাহিনীর নির্যাতন, নিষ্পেষণ, স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ, কারারুদ্ধ করা, অপমান, খুন, মারধর ও পিটুনি, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, তল্লাশি অভিযান এবং বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিশোধ নিতে গিয়ে কাশ্মিরি ইনতিফাদা এক নতুন পর্যায়ে পৌঁছেছে।
আত্মঘাতী বোমা হামলা, গাড়িবোমা হামলা বা অন্যভাবে হামলার মাধ্যমে ভারতীয় দখলদার বাহিনীর ওপর নতুন করে হামলার হুমকি সৃষ্টি করেছে। অপর দিকে, কাশ্মিরি ইনতিফাদার বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী আইএএফ ফাইটার বোম্বার ব্যবহার করে বোমা হামলা চালানোর বিষয় বিবেচনা করছে বলে জানা গেছে। কাশ্মিরে সহিংসতার মাত্রা এখন অনেক বেড়েছে।

পরবর্তী সময়ে কী হবে?
ভারত সরকারের বিভিন্ন সেকশন, রাজনীতিবিদ, মিডিয়া এবং সাধারণ মানুষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ ছাড়াই প্রথাগতভাবে দোষারোপ এবং ভিত্তিহীন নিদারুণ যন্ত্রণা দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভবত তাৎক্ষণিকভাবে পুলওয়ামার ঘটনা ঘটে। অবশ্য পুলওয়ামার ব্যাপারে আগেই আভাস দেয়া হয়েছিল। ভারতীয়রা স্বাভাবিকভাবে আগের মতোই অভিযোগকারী, প্রত্যক্ষদর্শী, কৌঁসুলি বিচারক হিসেবে ঘটনার কয়েক মিনিটের মধ্যে একতরফা এই ঘটনার রায় দেয়। এরপর ভারতের প্রিন্ট মিডিয়া ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে একতরফাভাবে অপপ্রচার চালায়। একইভাবে ভারত সরকার পাকিস্তানকে একঘরে করার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। এটা মনে হয়, ইতোমধ্যে তৈরি করা সুপরিকল্পিত ‘আকস্মিক পরিকল্পনা’ (মুম্বাই, পাঠান কোর্ট, ইউরি, চিট্টিচিংপোরা ইত্যাদি এবং এখন পুলওয়ামা)!

অপর দিকে, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান (আইকে) অত্যন্ত পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি স্থিতিশীল এবং রাষ্ট্রনায়কোচিতভাবে সাড়া দিয়েছেন। তিনি মোদির বক্তব্যকে ধাপ্পাবাজি বলে অভিহিত করেছেন এবং স্বচ্ছ, সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য রেখেছেন। তিনি পুলওয়ামার ঘটনায় পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার প্রমাণ দিতে বলেছেন এবং ভারতীয়রা বিশ্বাসযোগ্য কার্যকর গোয়েন্দা তথ্য দিতে পারলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইমরান খান সন্ত্রাসবাদের ব্যাপারে আলোচনায় বসার এবং সাথে সাথে ঘটনার একটি যৌথ অথবা স্বাধীন বা স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক তদন্তের প্রস্তাব দিয়েছেন।

তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ন্ত্রণরেখা/ডব্লিউবি বা আন্তর্জাতিক সীমান্ত বরাবর যেকোনো কুমতলবে দুঃসাহসিক অভিযানের উদ্যোগ গ্রহণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে একটি দুঃখজনক ক্যাচ ২২ পরিস্থিতিতে রেখে তাৎক্ষণিকভাবে অধিকতর প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং তার দল বিজেপি সম্ভবত নিজেদের বাগাড়ম্বরের কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে তার ভিক্টিমে পরিণত হয়েছে। তারা প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কথা শুনে আলোচনায় বসলে তার প্রতিশোধের হুমকিতে ধরাশায়ী হবেন এবং এতে তারা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবেন এবং দুর্বল নেতা ও দুর্বল দল হিসেবে গণ্য হয়ে নির্বাচনে হেরে যাবেন। আর মোদি যদি ভুল স্থানে শক্তির বাহাদুরি দেখিয়ে একটি যুদ্ধ ও সঙ্ঘাত শুরু বা সংঘটিত করেন, তাহলে তিনি নিজে গোটা অঞ্চলের চেয়ে বরং দুটো দেশকেই ডুবাবেন।

সঙ্ঘাত, যুদ্ধ বা বিরোধের ক্ষেত্রে ভারতীয়রা মনে হয় একটি হাইব্রিড যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য বহুমুখী কৌশল অনুসরণ করবে। তারা পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলীয় উভয় সীমান্তকে হয়তো চালু করতে চাইতে পারে। এ পর্যায়ে তারা তাদের স্লিপার সেলগুলোর মাধ্যমে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ফ্রন্টকে অস্থিতিশীল বা অচল করে দিতে পারে। এই কৌশল পূর্বাঞ্চলীয় দিক (নিয়ন্ত্রণরেখা/আন্তর্জাতিক সীমান্ত) থেকে হামলার মাধ্যমে জোরদার হবে। আর আফগানিস্তান ও ইরান থেকে একই সময়ে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো হামলা চালাতে পারে। একই সাথে ভাতরীয়রা পাকিস্তানের ভেতরেও তাদের স্লিপার সেলগুলোকে সক্রিয় করে তুলতে পারে।

এসব স্লিপার সেল সন্ত্রাসীদের সাথে যুক্ত হয়ে অসন্তোষ ও অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করে সরা দেশে দেশবিরোধী ও অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাবে। তারা বিলুপ্ত দলগুলোর নেতাদেরকেও টার্গেট বা লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারে। এসব দল হয়তো কৃত্রিমভাবে কিছু সময় ভারতীয়দের অথবা অন্যদের ক্ষতি করতে পারে। এসব বিলুপ্ত দলের নেতারা সিপিইসি/বিআরআই প্রকল্প অচল করে দেয়ার চেষ্টাও করতে পারে। অধিকন্তু, তারা যুগপৎভাবে সাইবার হামলা এবং সাথে সাথে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক, মিডিয়া এবং তথ্যপ্রবাহের মাধ্যমে নিজেদের পক্ষে প্রচার-প্রপাগান্ডা চালাতে পারে। কাশ্মির ও পাকিস্তান নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির স্থূল দৃষ্টিভঙ্গি এবং ক্ষতিকর বা বিপর্যয়কর নীতির কারণে উপমহাদেশজুড়ে এই সহিংসতা বৃদ্ধি এবং কার্যকরভাবে নৃশংসতার দিকে মোড় নিয়েছে। তাকে (মোদিকে) উপলব্ধি করতে হবে, কাশ্মির হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ইস্যু। অতিরিক্ত সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে ওই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। কাশ্মিরি জনগণের ওপর চরম বর্বরতা চালিয়ে তাদের বিচ্ছিন্ন করে সম্পূর্ণভাবে বিরোধী পক্ষের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। আর পাকিস্তানকেও এভাবে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। এই রাজ্যের বিষয়ে মতপার্থক্য বা ফাটল অব্যাহত থাকলে এবং তা আরো দীর্ঘস্থায়ী হলে এই ফুসকা বা ফুসকুড়ি এবং ঐতিহাসিক ইস্যুটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া আরো অনেক কঠিন হয়ে যাবে।

ভারতের নিয়ন্ত্রণহীন যুদ্ধংদেহী মনোভাব, ঔদ্ধত্য এবং সাহসের বড়াই শেষ পর্যন্ত একটি বড় ধরনের যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। কাশ্মির যে খুব সম্ভবত বিশ্বের নিউক্লিয়ার প্লাস পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত সেটার জন্য নয়, বরং প্রধানমন্ত্রী মোদিকে সুপরামর্শ দেয়া প্রয়োজন যে, তিনি যেটা সম্ভবত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না- সেটা বা সে ধরনের কোনো কিছু তার শুরু করা উচিত হবে না। তার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চাভিলাষ হয়তো গোটা মধ্য এশিয়া এবং এমনকি বৃহত্তর আর্থবিশ্বকে সম্ভাব্য একটি পরমাণু যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী মোদিকে অবশ্যই পরিস্থিতির গুরুত্ব এবং তার নীতির প্রতি প্রতারণার বিষয় অনুধাবন করতে হবে। তাকে বুঝতে হবে কাশ্মিরি ইনতিফাদা এখন একটি পরমাণু যুদ্ধের দিকে ঝুঁকছে- তথা এগিয়ে যাচ্ছে।
(দ্য নেশন থেকে)

অনুবাদ : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top