রোহিঙ্গাদের নিরাপদ অঞ্চল প্রস্তাবে চীন আসিয়ানের সাড়া

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য সেইফ জোন বা নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রস্তাবে চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্র ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশ তৃতীয়পক্ষের উপস্থিতিতে উত্তর রাখাইনের এক সময়ের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় বেসামরিক নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করেছে।

রাখাইনে অনুকূল পরিস্থিতি না থাকায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশ বিকল্প হিসেবে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় ওপরেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করছে।

রাখাইনে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেছিলেন। আর পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক গত বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারের অভ্যন্তরে অসামরিক নিরাপদ অঞ্চল সৃষ্টির প্রস্তাবটি জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে তুলে ধরেন।

বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুযায়ী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমার নিরাপত্তাবাহিনীর নজিরবিহীন নৃশংসতার মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার আগে রাখাইনে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোকে নিয়ে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হবে। তবে এটি রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারের সরকারের তৈরি করা আইডিপি (অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি) ক্যাম্পের মতো হলে হবে না।

নিরাপদ অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের চলাফেরাসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। মিয়ানমারকেই এই অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর তৃতীয়পক্ষকে থাকতে হবে ব্যবস্থাপনা বা পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে। এখানে তৃতীয়পক্ষ বলতে জাতিসঙ্ঘ বা মিয়ানমারের কাছে গ্রহণযোগ্য এক বা একাধিক দেশের প্রতিনিধিদের বোঝানো হয়েছে।

জানা গেছে, অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় চীন সম্প্রতি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের প্রস্তাবের ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। তারা প্রস্তাবটির খুঁটিনাটি জানতে চেয়েছে। এ ছাড়া আসিয়ান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি দেশও এই প্রস্তাবের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে।

দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের ক্ষেত্রে অগ্রগতি না হওয়ায় মিয়ানমারের ওপর প্রভাব রয়েছে এমন দেশগুলোর সহযোগিতায় বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুটি সমাধানের চেষ্টা করছে। মিয়ানমারের ওপর চীনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতাধর চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতার জন্য রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব পাস করা যায় না। ব্রিটেনসহ পশ্চিমা দেশগুলোর একাধিক প্রচেষ্টা এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে।

তাই রাখাইনে নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় চীনের সম্পৃক্ততার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া মিয়ানমার আসিয়ানভুক্ত একটি দেশ। তাই আসিয়ানকেও এই প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে চাইছে সরকার।

গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত বিশেষ অধিবেশনে মিয়ানমার থেকে আর কোনো শরণার্থী নিতে পারবে না বলে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদকে জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। রাখাইনে সামরিক বাহিনীর সহিংসতার মুখে সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার ১৮ মাস পর নিরাপত্তা পরিষদকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক। এর আগে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে রাখাইনের বৌদ্ধসহ অন্যান্য উপজাতিরা বান্দরবানে আশ্রয় নেয়া শুরু করলে মিয়ানমারের সাথে সীমান্ত সিল করে দেয় বাংলাদেশ।

নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমি দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, মিয়ানমার থেকে আর কোনো মানুষকে আশ্রয় দেয়ার অবস্থানে নেই বাংলাদেশ। তিনি বলেন, মিয়ানমার সহায়ক পরিস্থিতি নিশ্চিত না করায় একজন রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশ থেকে ফেরত পাঠানো যায়নি। এ সময় শহীদুল হক মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও বাধা সৃষ্টির জন্য অভিযুক্ত করেন।

গত ১৫ নভেম্বর থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এ ব্যাপারে একমত পোষণ করে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে তাদের প্রস্তুতির কথাও জানিয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে প্রত্যাবাসনের জন্য দুই হাজার ২৬০ জন রোহিঙ্গার তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের প্রতিবাদের মুখে তালিকাভুক্ত একজনকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে পারেনি বাংলাদেশ।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাখাইনে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি না হলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ফিরতে চাইবে না। এ ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘ সংস্থাগুলোরও উদ্যোগী ভূমিকা দেখা যায় না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পরিবেশ সৃষ্টিতে জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন তহবিল ইউএনডিপি এবং জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সাথে মিয়ানমারের চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এই চুক্তি অনুযায়ী রাখাইনে তাদের কর্মতৎপরতা চোখে পড়ছে না।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের সর্বশেষ অধিবেশনে মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধি ক্রিশ্চিন বারগেনার বলেছেন, রাখাইনে জাতিসঙ্ঘের প্রবেশাধিকার সীমিত। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর যে মাত্রার নির্যাতন হয়েছে এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ রয়েছে, তাতে এটি প্রমাণিত হয় যে রোহিঙ্গা নির্যাতন এ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাগুলোর একটি।

তবে নিরাপত্তা পরিষদের এ অধিবেশনেও মিয়ানমার নিয়ে অবস্থান পরিবর্তন করেনি চীন ও রাশিয়া। জাতিসঙ্ঘে চীনের সহকারী রাষ্ট্রদূত উ হাইতাও বলেন, এই সমস্যাটি শুধু বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের। তাই তাদেরকেই এই সঙ্কটের সমাধান করতে হবে। রুশ দূত দিমিত্রি পলিয়ানস্কি চীনের বক্তব্যকে সমর্থন করেন।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top