একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সভায় দুই জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি দুইটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কথাটি সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির মুখ থেকে বের হয়েছে। তিনি বলেছেন, ইনশাআল্লাহ, আমরা অধিকৃত কাশ্মিরকে আমাদের জীবদ্দশায় স্বাধীন হতে দেখব। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, ‘আজাদ জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী রাজা মুহাম্মদ ফারুক হায়দার। তিনি দুঃখভরা কণ্ঠে বলেছেন, সাবেক স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফ কাশ্মির ইস্যুকে যতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন, ততটা ক্ষতি ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি করেননি।’ এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ কথা এমন এক সভায় বলা হয়েছে, যেখানে দীর্ঘ দিন পর গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা কাশ্মির সমস্যা নিয়ে পরামর্শের জন্য উপস্থিত ছিলেন।
এ সর্বদলীয় পরামর্শ সভার আয়োজন করেছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও মুত্তাহেদা মজলিসে আমলের নেতা মাওলানা ফজলুর রহমান। তার ডান দিকে ছিলেন মুসলিম লিগের (এন) চেয়ারম্যান সিনেটর রাজা জাফরুল হক ও আজাদ কাশ্মিরের প্রধানমন্ত্রী রাজা ফারুক হায়দার। তার বাম দিকে ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি এবং আজাদ জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের প্রেসিডেন্ট মাসউদ খান। এ সভায় কেন্দ্র ও দুইটি প্রদেশের ক্ষমতাসীন দল পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফের অনুপস্থিতি অসঙ্গত ছিল। তথাপি জোট সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন জোটমন্ত্রী ডক্টর খালেদ মকবুল সিদ্দিকী, যিনি এমকিউএম পাকিস্তানের সদস্য। এমকিউএম-এর আরো একজন নেতা আমির খানও ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের জোটভুক্ত দল বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টির সিনেটর আনওয়ারুল হক কাকারও ওই সভায় মজলুম কাশ্মিরি জাতির সাথে পরিপূর্ণরূপে একাত্মতা প্রকাশ করেন।
সভার আসল গুরুত্বপূর্ণ দিকটি ছিল- ওখানে অধিকৃত কাশ্মির ও আজাদ কাশ্মিরের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। অধিকৃত কাশ্মিরিদের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে সায়্যিদ ইউসুফ নাসিম তার ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় হাতের তালুতে রেখে ইসলামাবাদের মানুষগুলোর সামনে উপস্থাপন করেন, যা পাকিস্তানের সাথে ভালোবাসার সুবাসমণ্ডিত ছিল। আজাদ কাশ্মিরের পক্ষ থেকে রাজা ফারুক হায়দার থেকে শুরু করে আব্দুর রশীদ তুরাবিসহ সবাই এ বার্তা দিচ্ছিলেন যে, আমরা শুধুই জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবের আলোকে কাশ্মির সমস্যার সমাধান চাই। যদি কেউ এ বিষয়ে ‘আউট অব বক্স’ সমাধান আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে, তবে তা পাকিস্তানের সংবিধানের ধারা নং ২৫৭ বিরোধী হবে এবং কোনোভাবেই তা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
এ পরামর্শ সভায় বেরেলভি, দেওবন্দি, আহলে হাদিস ও শিয়া আলেমরা একসাথে বসেছিলেন। তেহরিকে ইসলামী ও শিয়া উলামা কাউন্সিলের সভাপতি আল্লামা সায়্যিদ সাজেদ আলী নাকভি বলেছেন, কাশ্মিরিদের আন্দোলন ও ত্যাগকে সাম্প্রদায়িকতা শেষ করে দিয়েছে। আর কাশ্মিরিদের সাহায্যের জন্য পাকিস্তানের জনগণ কর্তৃক সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করা প্রয়োজন। মাওলানা ফজলুর রহমান দুই বছর আগেও কাশ্মির নিয়ে একটি সর্বদলীয় কনফারেন্সের আয়োজন করেছিলেন। ওই সময় তিনি পার্লামেন্টের কাশ্মির কমিটির প্রধান ছিলেন। এখন তিনি পার্লামেন্টের সদস্য নন। তবে তিনি কাশ্মিরের জন্য একাত্মতা প্রকাশ দিবসের কয়েক দিন আগে কাশ্মিরের নামে শুধু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দলকেই নয়, বরং এমন দলকেও ডেকেছেন, যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং সাধারণত ওই দলের প্রতিনিধিদের এমন সভায় ডাকা হয় না, যেখানে পিপলস পার্টি ও মুসলিম লীগের (এন) কেন্দ্রীয় নেতারা থাকেন।
তবে এ পরামর্শ সভায় আসিফ জারদারি, মাওলানা ফজলুর রহমান, লিয়াকত বেলুচ, সাজেদ নাকভি, রাজা জাফরুল হক, জামায়াতুদ দাওয়ার কেন্দ্রীয় নেতা আমীর হামজা, আনসারুল উম্মাহর প্রধান মাওলানা ফজলুর রহমান খলীল এবং জেইউআই সামিউল হক গ্র“পের মাওলানা শাহ আব্দুল আজীজ একই টেবিলে বসেছিলেন। মনে হচ্ছিল, মাওলানা ফজলুর রহমান নামসর্বস্ব দলগুলো ও জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। জারদারি যখন বললেন- ‘ইনশাআল্লাহ, অধিকৃত কাশ্মির আমাদের জীবদ্দশায় স্বাধীন হবে, তখন কিছু আলেম তার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকালেন। তবে আমার পাশে বসা মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস চিনিওটির মুখ দিয়ে বের হলো- ইনশাআল্লাহ।’
কিছু মানুষ জারদারির কথাকে একটি রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে অভিহিত করে তা উপেক্ষাও করতে পারেন, তবে ওই কথার গুরুত্ব তাদেরকে জিজ্ঞাসা করুন, যারা বিগত দিনে অধিকৃত কাশ্মিরে জানাজা কাঁধে উঠিয়েছেন এবং নিজেদের যুবকদের ও শিশুদেরকে পাকিস্তানি পতাকায় জড়িয়ে দাফন করেছেন। ওই পরামর্শ সভায় পাকিস্তান বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান কামরান মুরতাজা বলেন, সরকার ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সাবেক স্পিকার সায়্যিদ ফখরে ইমামকে পার্লামেন্টের কাশ্মির কমিটির সভাপতি বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফখরে ইমামের নাম শুনে বৈঠকে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন বিস্ময় প্রকাশ করেন। মাওলানা শাহ আহমদ নুরানির সাহেবজাদা এবং এমএমএ’র তথ্যসচিব শাহ উয়াইস নুরানি তার বক্তৃতায় বলেন, ফখরে ইমামকে কাশ্মির কমিটির সভাপতি বানানোর সিদ্ধান্ত এক অবিবেচক সরকারের অবিবেচক কাশ্মির পলিসির স্বরূপ প্রকাশ করছে। কেননা কাশ্মির সমস্যার সাথে ফখরে ইমামের কখনো কোনো সম্পর্ক ছিল না। কাশ্মির বিষয়ক কোনো কনফারেন্সে তাকে কখনো দেখা যায়নি।
জামায়াতে ইসলামির লিয়াকত বেলুচও বর্তমান সরকারের কাশ্মির পলিসিকে অবিবেচক আখ্যায়িত করেছেন। আজাদ কাশ্মিরের প্রধানমন্ত্রী ফারুক হায়দার বলেন, রাজা জাফরুল হক অথবা সিনেটর শিরি রহমান কাশ্মির কমিটির সভাপতি হওয়ার বেশি উপযুক্ত। ওই পরামর্শসভায় বেশির ভাগ আলোচক নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খান, বেনজীর ভুট্টো ও কাজী হুসাইন আহমদকে বারবার স্মরণ করেছেন, যারা কাশ্মির সমস্যাকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিতে সাধ্যাতীত চেষ্টা করেছিলেন। কয়েকজন বক্তা ইঙ্গিতে এবং কয়েকজন খোলাখুলি এ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, পর্দার আড়ালের কিছু মানুষের পক্ষ থেকে আবারো মোশাররফের ওই চার দফা ফর্মুলার আলোচনা চলছে, যা কাশ্মিরি নেতারা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আজাদ কাশ্মিরের প্রেসিডেন্ট মাসউদ খান একজন প্রাক্তন কূটনৈতিক।
তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, মোশাররফের ফর্মুলা এবং তার সাথে জোড়াতালি দেয়া অন্য কোনো ফর্মুলা যার উদ্দেশ্য সীমান্ত পরিবর্তন ব্যতিরেকে স্বাধীনতার দাবি থেকে হাত গুটিয়ে নেয়া, তা কাশ্মিরিদের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। পাকিস্তানের অভিজাত প্রশাসনকে আজাদ কাশ্মিরের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে চিন্তা করা উচিত। ওই ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে কেউই অস্বীকার করতে পারবে না, সেনা স্বৈরশাসকরা কাশ্মিরিদের সর্বদা ক্ষতি করেছেন এবং ভারতের ধোঁকাবাজ শাসকেরা ওই পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের সাথে হাত মিলিয়ে কাশ্মিরিদের ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এখন ইমরান খানকে বলা হয়েছে, ‘ভারতের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত সামান্য অপেক্ষা করুন। নির্বাচনে বিজেপিকে জিততে দিন, মোদিকে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হতে দিন; এরপর সেই মোদির সাথে মিলেমিশে কাশ্মির সমস্যার সমাধান করা যাবে।’ তাদের যুক্তি-প্রমাণ হচ্ছে, ‘মোদি নিজে একজন কট্টর হিন্দু মৌলবাদী। আর পাকিস্তানের সাথে আলোচনার বিরোধিতাকারীদের সাথে শুধু মোদিই দাপট দেখাতে পারবেন।’ তবে মোদি কি কাশ্মির সমস্যার এমন কোনো সমাধানে রাজি হবেন, যা কাশ্মিরিদের চেহারায় হাসির ঝিলিক ছড়াবে?
মাওলানা ফজলুর রহমান ৩ ফেব্র“য়ারি মোদির শ্রীনগর সফরের একদিন আগে ইসলামাবাদে কাশ্মির বিষয়ক পরামর্শ সভার মাধ্যমে মোদির সফরের বিরুদ্ধে ডাকা হরতালের প্রতি সমর্থন এবং ওই আলোচনার কঠোর পর্যবেক্ষণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, যা নির্বাচনের পর নতুন দিল্লি ও ইসলামাবাদে শুরু হবে। পাকিস্তানের অভিজাত প্রশাসনের মনে রাখা উচিত, কাশ্মিরিরা তাদের চেতনা ও মনন থেকে ভারতকে বের করে দিয়েছে। তারা মানসিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন তাদের দৈহিক স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে, এর শুধু ঘোষণা বাকি। সুতরাং পর্দার আড়ালের কোনো ‘মোশাররফি ফর্মুলা’ চলবে না। এমন ফর্মুলার দ্বারা পাকিস্তান লাঞ্ছনা ছাড়া আর কিছুই পাবে না।
হামিদ মীর : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব