চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ এবং মানবজাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ

আমরা এখন একটি প্রাযুক্তিক বিপ্লবের কিনারায় দাঁড়িয়ে। এই বিপ্লব মৌলিক পরিবর্তন আনবে আমাদের প্রতিদিনের জীবনধারায়, কর্মপ্রক্রিয়ায়। বিভিন্ন কর্মপ্রক্রিয়ায় একটির সাথে আরেকটির সম্পর্কেও আনবে ব্যাপক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের মাত্রা, পরিমাপ, সুযোগ ও জটিলতা এমন হবে, যার অভিজ্ঞতার ছোঁয়া এর আগে মানবজাতি কখনো উপলব্ধি করেনি। আমরা এখনো জানি না, কিভাবে এই পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট, এর মোকাবেলা করতে হবে সমন্বিত ও ব্যাপকভাবে। আর এতে সংশ্লিষ্ট করতে হবে গোটা বিশ্বের সব অংশীজনদের, যাতে সংশ্লিষ্ট থাকতে হবে সরকারি ও বেসরকারি খাত থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদ ও সুশীলজনদেরও।

প্রথম শিল্পবিপ্লবের সময় উৎপাদন প্রক্রিয়াকে কারিগরায়ন করে তোলার জন্য ব্যবহার হয়েছে পানি ও বাষ্পশক্তি। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবে বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহার হয় ব্যাপক হারে উৎপাদনের কাজে। আর তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে উৎপাদনের কাজকে স্বয়ংক্রিয় করে তোলার জন্য ব্যবহার হয় ইলেকট্রনিকস ও তথ্যপ্রযুক্তি। আর এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব গড়ে উঠছে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের তথা ডিজিটাল বিপ্লবের ওপর ভর করে, যার সূচনা বিগত শতাব্দীর মধ্যভাগে। এই শিল্পবিপ্লবকে বৈশিষ্ট্যায়িত করা হয় ফিউশন অব টেকনোলজি হিসেবে, যা ভৌত, ডিজিটাল ও জৈবিক জগতের মধ্যকার পার্থক্যরেখা অস্পষ্ট করে তুলছে।

আজকের এই পরিবর্তন কেনো নিছক তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের দীর্ঘস্থায়িত্বকে উপস্থাপন না করে বরং এর বদলে সম্পূর্ণ নতুন স্বতন্ত্র চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আগমনের কথা বলে, যার তিনটি কারণ রয়েছে। এই কারণগুলো হচ্ছে : গতি, সুযোগ ও ব্যবস্থার প্রভাব (velocity, scope and systems impact)। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই জোরালো পথ করে নেয়ার গতির কোনো ঐতিহাসিক পূর্ব-উদাহরণ নেই। এর সাথে যদি পূর্ববর্তী শিল্পবিপ্লবগুলোর তুলনা করি, তবে দেখতে পাবো চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যেখানে উদ্ভব ঘটছে গুণনীয়কভাবে, সেখানে পূর্ববর্তী শিল্পবিপ্লবগুলো বিকশিত হয়েছে সরলরৈখিকভাবে। সোজা কথায় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের গতি আগের শিল্পবিপ্লবের গতির তুলনায় অনেক বেশি জোরালো। অধিকন্তু, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব প্রতিটি দেশের প্রায় সবগুলো শিল্পে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। কোনো কোনো শিল্পকে ধ্বংসের মুখোমুখি নিয়ে দাঁড় করিয়েছে এবং সব দিক থেকে এসব পরিবর্তন এ বার্তাটিই দেয়- উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের পুরো ব্যবস্থাই পাল্টে যাবে।

সম্ভাবনা আছে, তখন কোটি কোটি মানুষ সংযুক্ত থাকবে মোবাইল ডিভাইসের সাথে। আর এই মোবাইল ডিভাইসের থাকবে অভূতপূর্ব প্রসেসিং পাওয়ার ও স্টোরেজ ক্যাপাসিটি। প্রবেশাধিকার থাকবে সীমাহীন জ্ঞানতথ্যে। আর এই সম্ভাবনা আরো শতগুণে বেড়ে যাবে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন নতুন অগ্রগতির পথ বেয়ে। এসব অগ্রগতি ঘটবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, ইন্টারনেট অব থিংস, স্বয়ংক্রিয় যান, থ্রিডি প্রিন্টিং ইত্যাদি ক্ষেত্রের প্রযুক্তিসহ ন্যানোপ্রযুক্তি, জৈবপ্রযুক্তি, বস্তুবিজ্ঞান, জ্বালানি মজুদপ্রযুক্তি এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের প্রযুক্তির ক্ষেত্রে। এই অগ্রগতি কী মাত্রায় ঘটবে, তা আমাদের অনেকের কল্পনারও বাইরে।

ইতোমধ্যেই আমাদের চারপাশের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সদর্প পদচারণা দেখতে পাচ্ছি আজকের এই দিনে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ওপর ভর করে এরই মধ্যে আমরা পেয়ে গেছি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলা গাড়ি ও ড্রোন থেকে শুরু করে ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট ও অনুবাদক ও বিনিয়োগকারী সফটওয়্যার পর্যন্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবাক করার মতো অগ্রগতি ঘটেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির জগতে। গুণনীয়ক হারে বেড়েছে কম্পিউটিং পাওয়ার। সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বিপুল পরিমাণ ডাটা বা উপাত্ত পাওয়ার ক্ষেত্রে। সফটওয়্যার ব্যবহার করে উদ্ভাবিত হচ্ছে নতুন নতুন ওষুধ, করা হচ্ছে ননা অ্যালগরিদম। সফটওয়্যার ব্যবহার করে আমাদের সংস্কৃতির আগ্রহের বিষয়গুলো জানার কাজটিও সম্পাদন করা হচ্ছে। অপর দিকে ডিজিটাল ফেব্রিকেশন টেকনোলজি প্রতিদিন মিথস্ক্রিয়া করছে জৈবজগতের সাথে। প্রকৌশলী, নকশাবিদ ও স্থাপত্যবিদেরা একীভূত করছেন কম্পিউটেশনাল ডিজাইন, অ্যাডিটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং, ম্যাটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং ও সিনথেটিক বায়োলজি, মাইক্রো-অরগ্যানিজম ও আমাদের দেহ, আমাদের ভোগ্যপণ্য এমনকি আমরা যে ভবনে বসবাস করি, তার মধ্যে প্রথমবারের মতো একটি সিমবায়োসিস তথা সামঞ্জস্যপূর্ণ সংযোগ গড়ে তুলতে।

সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ
আগের বিপ্লবগুলোর মতো চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যেমন আমাদের জন্য বয়ে আনবে নানা সুযোগ, তেমনি ছুড়ে দেবে নানা চ্যালেঞ্জও। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব খুবই সম্ভাবনাময় বিশ্বের মানুষের আয়ের মাত্রা বাড়িয়ে তোলার ব্যাপারে। ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে বিশ্ব জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে। আজকের এই দিন পর্যন্ত যারা এই চতুর্থ শিল্প থেকে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, তাদের প্রযুক্তি সেবা ও পণ্য ভোগে অংশ নিতে হয়েছে বা হচ্ছে। এই প্রযুক্তি সেবা তাদের ব্যক্তিগত জীবনে দক্ষতা ও সুখবোধ বাড়িয়ে তুলেছে। এখন দূর থেকেই আমরা একটি ক্যাব ভাড়া করতে পারছি, বিমানের ফ্লাইট বুকিং দিতে পারছি, পারছি অনলাইনে একটি পণ্য কিনতে, অর্থ পরিশোধ করতে, গান শুনতে, চলচ্চিত্র দেখতে অথবা গেম খেলতে এবং এমন আরো কত কী!

আগামী দিনে প্রাযুক্তিক উদ্ভাবন সরবরাহের ক্ষেত্রে সৃষ্টি করবে অবাক করা সব সেবা, তা দীর্ঘমেয়াদে উপকার বয়ে আনবে দক্ষতা অর্জন ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোয়। পরিবহন ও যোগাযোগ খরচ অনেক কমে যাবে। আনুষঙ্গিক ও বিশ্ব সরবরাহ ব্যবস্থা হয়ে উঠবে আরো কার্যকর। কেনাবেচার খরচ প্রায় নেমে আসবে শূন্যের কোটায়। এসব কিছু প্রভাবে সৃষ্টি হবে নয়া বাজার এবং বাড়িয়ে তুলবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি।

অর্থনীতিদি এরিক ব্রিনজলফসন এবং অ্যান্ড্রু শ্যাকাফি উল্লেখ করেছেন, একই সাথে এই বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারে আরো বড় ধরনের বৈষম্য। বিশেষ করে তা অস্থিরতা সৃষ্টি করবে শ্রমবাজারে। কারণ, বিশ্ব অর্থনীতিতে তখন চলবে অটোমেশনের জয়জয়কার। তখন শ্রমিকের কাজ করবে মেশিন। তখন মূলধনের বিপরীতে আয় বাড়লেও শ্রমিকদের আয় কমে যাবে। অপর দিকে প্রযুক্তি দখল করে বসবে শ্রমিকদের স্থান। তখন সবচেয়ে মুশকিলে পড়তে পারে আমাদের মতো শ্রমঘন অর্থনীতির দেশগুলো। আমরা এখনো আন্দাজ করতে পারছি না, ভবিষ্যতের শ্রমিক চিত্রটি কী দাঁড়াতে পারে। তবে অভিজ্ঞজনেরা বলছেন, ভবিষ্যতে মূলধনের চেয়ে বরং মেধাই বেশি কাজ করবে উৎপাদনের ক্ষেত্রে। তখন চাকরির বাজারচিত্র হতে পারে এমন : ‘কম দক্ষতা কম বেতন, বেশি দক্ষতা বেশি বেতন।’

এর জের ধরে বাড়তে পারে সামাজিক উত্তেজনা। এর বাইরে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সূত্রে সৃষ্টি হওয়া বড় ধরনের সামাজিক বৈষম্য একইভাবে সমাজে ও জাতীয় জীবনে বয়ে আনতে পারে বড় ধরনের অস্থিরতা। উদ্ভাবন থেকে সবচেয়ে বেশি উপকারভোগীরা চাইবে বুদ্ধিভিত্তিক ও ভৌত মূলধনের প্রোভাইডার হতে। অর্থাৎ এরা চাইবে উদ্ভাবক, শেয়ার মালিক ও বিনিয়োগকারী হতে। এর অর্থ হচ্ছে, মূলধনের মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সম্পদবৈষম্য বেড়ে যাবে। এর ফলে প্রযুক্তি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়াবে উচ্চ আয়ের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আয়ে স্থবিরতা আসার কিংবা সম্পদ কমে যাওয়ার। এরই মধ্যে, অতি দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বেড়েছে। অপর দিকে কম দক্ষ ও কম শিক্ষিত শ্রমিকদের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু মাঝারি দক্ষতার শ্রমিকদের চাহিদা কমছে। ফলে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক তাদের চাকরির ব্যাপারে আতঙ্কে ভুগছে। শ্রমবাজারে এই অস্বস্তি আছে ডিজিটাল টেকনোলজির সর্বব্যাপিতা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্যে তথ্য বিনিময়ের বিষয়টি নিয়ে। বর্তমানে বিশ্বে ৩০ শতাংশের বেশি মানুষ যোগাযোগ, সংযোগ রক্ষা, শিক্ষা ও তথ্য বিনিময়ের জন্য ব্যবহার করছে সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফরম। একটি আদর্শ বিশ্বে এসব মিথস্ক্রিয়া সুযোগ সৃষ্টি করবে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে জানাজানি ও বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে।

ব্যবসায়ে প্রভাব
উদ্ভাবনের গতি ও বাধাবিপত্তির গতিপ্রকৃতি কী হারে বাড়বে তা এখনো সংশ্লিষ্টরা উপলব্ধি করতে পারছেন না। এমনকি যারা প্রযুক্তির সাথে সবচেয়ে বেশি জড়িত, তারাও তা অনুধাবনে হিমশিম খাচ্ছেন। অবশ্য পুরো প্রযুক্তি শিল্পজুড়ে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি রচনাকারী প্রযুক্তির বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে ব্যবসায়ের ওপর। সরবরাহের ক্ষেত্রে, অনেক শিল্প খাতই নতুন প্রযুক্তি সূচনার কথা ভাবছে, যা বিদ্যমান চাহিদা পূরণ করবে পুরোপুরি নতুন উপায়ে এবং বর্তমান ভ্যালু চেইনকে ব্যাপকভাবে এলোমেলো করে দেবে। এই এলোমেলো করে দেয়ার কাজটি আরো ক্ষিপ্রগতির হতে পারে উদ্ভাবনামূলক প্রতিযোগীদের মাধ্যমে। এরা গ্লোবাল ডিজিটাল রিসার্চ, ডেভেলপমেন্ট, মার্কেটিং, সেলস প্ল্যাটফরমের সুবাদে তাদের মান, গতি উন্নয়ন ও সরবরাহ মূল্য কমিয়ে এনে আরো দ্রুত পরাভূত করতে পারবে সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিপক্ষকেও। চাহিদার ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে চলেছে। কারণ, স্বচ্ছতা বাড়ছে, ভোক্তার সম্পৃক্ততা বাড়ছে এবং ভোক্তার আচরণের ধরনও পাল্টাচ্ছে। এর ফলে কোম্পানিগুলো বাধ্য হচ্ছে পণ্য ও ডিভাইসের ডিজাইন, বিপণন ও সরবরাহে নয়া উপায় অবলম্বনে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের একটি মুখ্য প্রবণতা হচ্ছে প্রযুক্তিসমৃদ্ধ প্ল্যাটফরম তৈরি করা, যা চাহিদা ও সরবরাহ উভয় ক্ষেত্রের বর্তমান শিল্পকাঠামোকে বাধাগ্রস্ত করছে, যা আমরা দেখতে পাচ্ছি শেয়ারিং ও অন-ডিমান্ড ইকোনমিতে। এসব প্রযুক্তি প্ল্যাটফরম স্মার্টফোনের মাধ্যমে ব্যবহার খুবই সহজ। এল ফলে এ প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ভোগ্যপণ্য ও সেবা। অধিকন্তু তা কমিয়ে আনছে ব্যবসায়ের ও ব্যক্তির সম্পদ অর্জনের বাধা। আর এতে পরিবর্তন হচ্ছে ব্যক্তিগত ও পেশাগত পরিবেশ। নতুন প্ল্যাটফরম বিজনেস বহুগুণে বাড়িয়ে তুলছে নতুন সেবা, লন্ড্রি থেকে শুরু করে কেনাকাটা পর্যন্ত, পার্কিংয়ের টুকটাক কাজ থেকে পর্যটনের সংবাদ পর্যন্ত। সামগ্রিকভাবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব চারটি মূল প্রভাব ফেলছে ব্যবসায়ের ওপর : গ্রাহকের প্রত্যাশার ওপর, পণ্য জোরালো করার ওপর, সহযোগিতামূলক উদ্ভাবনের ওপর এবং সাংগঠনিক ধরনের ওপর।

গ্রাহকেরাই ক্রমবর্ধমান হারে চলে আসছে ইকোনমির ইপিসেন্টারে তথা কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রশ্ন আসছে, কী করে গ্রাহকেরা সেবা পাবে, ভৌতপণ্য অথবা সেবা এখন জোরদার করা যাবে ডিজিটাল সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে, যা বাড়িয়ে তুলবে পণ্য ও সেবার মূল্য। নতুন প্রযুক্তি সম্পদকে করে তোলে আরো ভঙ্গুর ও সহনীয়। ডাটা ও অ্যানালাইটিকস পরিবর্তন আনছে এগুলোর ব্যবস্থাপনায়। গ্লোবাল প্ল্যাটফরম ও নতুন নতুন বিজনেস মডেলের উদ্ভবের ফলে শেষ পর্যন্ত ফল দাঁড়াচ্ছে- মেধা, অনুশীলন ও সাংগঠনিক ধরন নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সাধারণ ডিজিটালাইজেশন থেকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উদ্ভাবনভিত্তিক প্রযুক্তি একীভূত করার অপ্রতিরোধ্য নির্মম পরিবর্তন কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করছে তাদের ব্যবসায় করার পুরো ধরনকে নতুন করে পরীক্ষা করতে। সারকথা হচ্ছে, ব্যবসায়ী নেতারা ও ঊর্ধ্বতন ব্যবসায়িক নির্বাহী পরিবর্তিত পরিবেশকে ভালো বুঝতে হবে। এটাই হচ্ছে তাদের জন্য আলোচ্য শিল্পবিপ্লবের একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

সরকারের ওপর প্রভাব
যেহেতু ভৌত, ডিজিটাল ও জৈবজগৎ অব্যাহতভাবে একীভূত হচ্ছে, তাই নতুন প্রযুক্তি ও প্ল্যাটফরম ক্রমবর্ধমান হারে নাগরিক সাধারণকে সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট করবে। নাগরিক সাধারণ তাদের অভিমত তুলে ধরার সুযোগ পাবে, এমনকি জনগণ সরকারি কর্তৃপক্ষকেও তত্ত্বাবধান করবে। একই সাথে সরকার অর্জন করবে নয়া প্রাযুক্তিক ক্ষমতা, যার মাধ্যমে সরকার জনগোষ্ঠীর ওপর অধিকতর নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পাবে। সরকারের হাতে থাকবে পারভেসিভ সার্ভিল্যান্স সিস্টেম ও ডিজিটাল অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। তা সত্ত্বেও সরকার সামগ্রিকভাবে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়বে নীতিনির্ধারণের ব্যাপারে বর্তমান প্রবণতা বদলাতে। শেষ পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থা ও সরকারি কর্তৃপক্ষের সক্ষমতাই নির্ধারণ করবে সরকার টিকে থাকবে কি থাকবে না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তায়। এর প্রভাব পড়বে দ্বন্দ্বের প্রকৃতিতেও। আন্তর্জাতিক যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ইতিহাস হচ্ছে প্রযুক্তি উদ্ভাবনেরই ইতিহাস। আজকের দিনেও এর ব্যতিক্রম নেই। আধুনিক সময়ের দ্বন্দ্বের প্রকৃতি ক্রমবর্ধমান হারে শঙ্কর ধরনের। যুদ্ধ ও শান্তির মধ্যকার পার্থক্য, আক্রমণাত্মক বা আত্মরক্ষামূলক, সন্ত্রাসী বা অসন্ত্রাসী, সাইবার যুদ্ধ ইত্যাদি হয়ে উঠছে দুঃসহভাবে দুর্বোধ্য।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও নতুন প্রযুক্তি প্রক্রিয়ায় স্বয়ংক্রিয় ও জৈব অস্ত্র (অটোনোমাস ও বায়োলজিক্যাল ওয়েপন) ব্যবহার ক্রমেই সহজ হয়ে উঠছে। ব্যক্তি ও ছোট ছোট গোষ্ঠী রাষ্ট্রের সাথে যোগ দিচ্ছে বড় ধরনের ক্ষতি সাধনের কাজে। এই নতুন ধরনের ভঙ্গুরতা মানবজাতির জন্য সৃষ্টি করছে নানা নয়া আতঙ্ক। কিন্তু একই সাথে প্রযুক্তিতে অগ্রসরতা নতুন ধরনের সুরক্ষা উদ্যোগ (যেমন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানায় আরো যথার্থতা) কমিয়ে আনবে সন্ত্রাসের প্রভাবমাত্রা।

জনগণের ওপর প্রভাব
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শুধু আমাদের কর্মজীবনেই পরিবর্তন আনবে না, পাল্টে দেবে মানবজাতিকেও। তখন আমরা আর আজকের আমরা থাকব না। এটি প্রভাব ফেলবে আমাদের পরিচয় সত্তায় এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সব কিছুতে : আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তায়, আমাদের সম্পদ মালিকানার ধরনে, আমাদের ভোগের ধরনে, আমাদের কাজ ও বিশ্রামের সময়ে, আমাদের কর্মজীবন গড়ায়, আমাদের দক্ষতা চর্চায়, মানুষের সাথে সাক্ষাতে এবং আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কে। এই পরিবর্তন তালিকা অন্তহীন। এটি সীমিত একমাত্র আমাদের কল্পনায়।
অনেকের ব্যক্তিগত জীবনে প্রযুক্তিকে স্বাগত জানানোর ব্যাপারে প্রবল উৎসুক। কিন্তু এরা কখনো কখনো অবাক হন, আমাদের জীবনে এই অদম্য প্রযুক্তির সমন্বয় ধ্বংস করে দিতে পারে আমাদের কিছু অতি প্রয়োজনীয় পরিপূর্ণ মানবিক গুণাবলি, যেমন- সমবেদনা ও সহযোগিতা। এ ক্ষেত্রে আমাদের স্মার্টফোন একটি বিবেচ্য। অব্যাহত সংযুক্তি আমাদের বঞ্চিত করতে পারে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ থেকে : একটু থামার, প্রতিফলন ঘটানোর ও অর্থপূর্ণ কথাবার্তা বলার সময়।

ব্যক্তিজীবনে নতুন প্রযুক্তি যে চ্যালেঞ্জটি নিয়ে এসেছে বা আনবে তা হচ্ছে, আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বিনষ্ট হওয়া। আমরা তাৎক্ষণিকভাবেই বুঝতে পারি, কেন এটি এতটা অপরিহার্য। এর পরও আমাদের সম্পর্কিত তথ্যের ওপর নজরদারি ও বিনিময় হচ্ছে নতুন কানেক্টিভিটির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মৌলিক বিষয়ে বিতর্ক, যেমন আমাদের অন্তর্জীবনে এর প্রভাব হবে আমাদের ডাটার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ আসছে বছরগুলোতে আরো জোরদার হবে। একইভাবে, জৈবপ্রযুক্তি তথা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিতে ঘটে চলা বিপ্লব আমাদের বর্তমান জীবনকাল, স্বাস্থ্য, বোধশক্তি ও সক্ষমতাকে পেছনে ঠেলে দিয়ে মানুষ হওয়ার সংজ্ঞা পাল্টে দিচ্ছে। বিষয়টি আমাদের বাধ্য করবে নৈতিক ও জীবনবিধান সম্পর্কিত সীমানা নতুন করে সংজ্ঞায়নে।

মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণ
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সাথে আসা প্রযুক্তি কিংবা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একটি বাহ্যিক শক্তি, যার কোনোটির ওপরই মানবজাতির নিয়ন্ত্রণ নেই। এর উদ্ভবের জন্য আমরা সবাই দায়ী। এ কাজটি আমরা করছি আমাদের নাগরিক, ভোক্তা ও বিনিয়োগকারী হিসেবে প্রতিদিনের সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায়। অতএব, আমাদের সুযোগ ও ক্ষমতা কাজে লাগাতে হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে নতুন আকার দেয়ায় এবং তাকে এমন এক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে হবে, যাতে প্রতিফলন থাকে মানবজাতির অভিন্ন লক্ষ্য ও মূল্যবোধের।

সব কিছুই নির্ভর করে মানুষ ও মানবজাতির মূল্যবোধের ওপর। আমাদের প্রয়োজন মানবজাতির জন্য এমন একটি ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ, যা আমাদের সবার জন্য উপকার বয়ে আনে, আমাদের জন্য তা কার্যকর প্রমাণিত হয়। জোর দিতে হবে মানুষের ওপর এবং মানুষের ক্ষমতায়নের ওপর। সবচেয়ে উচ্চাকাক্সক্ষী ডিহিউম্যানাইজড আকারের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের হয়তো সম্ভাবনা আছে মানবজাতিকে রোবটায়িত করার। তবে তার জন্য আমাদেরকে হারাতে হবে হৃদয় ও আত্মা। কিন্তু সম্পূরক হিসেবে মানবপ্রকৃতি- সৃজনশীলতা, সহমর্মিতা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বের সর্বোত্তম অংশ হচ্ছে একটি নতুন ধরনের যৌথ নৈতিকতা বোধ, যার ভিত্তি আমাদের পরিণতি বোধ। সেটি নিশ্চিত করাই আমাদের সবার দায়িত্ব। আর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এটি আমাদের কারো ভুলে থাকার অবকাশ নেই।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top